Durgesh Dubey Exclusive: ভারতীয় ক্রিকেটে হইচই ফেলা দেওয়া দুর্গেশ ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজও করেছেন!
পরপর ৮ বলে ৮ উইকেট! বল হাতে সেরকমই ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছেন ভদ্রেশ্বরের দুর্গেশ দুবে। হুগলি জেলা সিনিয়র নক আউট ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে রাজবলহাটের বিরুদ্ধে চুঁচুড়া টাউন ক্লাবের হয়ে।
ভদ্রেশ্বর: পরপর ৮ বলে ৮ উইকেট! বুক ক্রিকেটেও হয়তো ভাবা যায় না। বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বোলার পরপর আট বলে আট উইকেট নিয়েছেন। ভারতে যা কখনও কোনও পর্যায়ের ক্রিকেটেই হয়নি।
বল হাতে সেরকমই ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছেন ভদ্রেশ্বরের দুর্গেশ দুবে (Durgesh Dubey)। হুগলি জেলা সিনিয়র নক আউট ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনালে রাজবলহাট ক্লাবের বিরুদ্ধে চুঁচুড়া টাউন ক্লাবের হয়ে ৮ বলে ৮ উইকেট নিয়েছেন ২৪ বছরের পেসার।
দুর্বেশের স্পেলের মতোই তাঁর উত্থানের কাহিনিও চমকপ্রদ। অভাবের তাড়নায় যিনি এক সময় ক্রিকেট ছেড়ে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজও করেছেন! পরে ফের মাঠে ফেরেন। আর ফিরেই বল হাতে সাফল্য।
এবিপি লাইভকে দুর্গেশ বলেছেন, ‘এরকম কীর্তি গড়ে ফেলব, ভাবতে পারিনি। স্বপ্নের স্পেল বললেও কম বলা হয়। বেশ অদ্ভুত লাগছে।‘
রাজবলহাট ইনিংসের ৩.২ ওভার থেকে দুর্গেশের উইকেট পাওয়া শুরু। ৪.৩ ওভার পর্যন্ত চলে বল হাতে তাঁর তাণ্ডবলীলা। পরপর ৮ বলে তুলে নেন ৮ উইকেট। প্রথমটি এলবিডব্লিউ। বাকি আট শিকার বোল্ড হন। হ্যাটট্রিক নয়, একেবারে ডাবল হ্যাটট্রিক। দুর্গেশের কীর্তিতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু সকলে খুব খুশি। ম্যাচের বলটি রেখে দিয়েছেন স্মারক হিসাবে। এক জ্যেঠু উপহার হিসাবে টাকা দিয়েছেন কিছু। চুঁচুড়া টাউন ক্লাবের তরফে একটি বিশেষ টুপি পেয়েছেন। সেমিফাইনালে উঠেছে টাউন ক্লাব।
দুর্গেশের ২৪ বছর বয়স। বলছিলেন, ‘ভদ্রেশ্বরের পাইকপাড়ায় টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতাম। বাংলার ক্রিকেটার অর্ণব নন্দী আমাকে দেখে বলে, ভাল বল করছিস। টেনিস বলে না খেলে পেশাদার ক্রিকেটে আয়। তারপর অর্ণবদার সঙ্গেই প্র্যাক্টিস শুরু করি। আমার কোচ সতীন্দ্র নন্দী বাগচি স্যারের কাছেও প্র্যাক্টিস করতে শুরু করি তারপর।‘
তবে দুর্গেশের স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা হিসাবে হাজির হয় দারিদ্র্য। তাঁর বাবা ভদ্রেশ্বর জুটমিলে সামান্য কাজ করতেন। সংসার চালাতে নাজেহাল দশা। বাড়িতে তিন ভাই-বোন। অনেক কষ্টে দিদির বিয়ে দেওয়া গিয়েছে। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। অগত্যা ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে ইতি টেনে দিয়েছিলেন দুর্গেশ।
‘সংসারের হাল ধরতে খেলা ছেড়ে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ শুরু করি। বাড়ির ওয়্যারিংয়ের কাজে পাড়ার এক ইলেকট্রিশিয়ান দাদাকে সাহায্য করতাম। কাজ শিখতাম। প্রত্যেক দিন আড়াইশো-তিনশো টাকা রোজগার হতো। পাশাপাশি ইন্দিরা গাঁধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশোনাও চালাচ্ছিলাম। অর্ণবদা শুনে এগিয়ে আসে। আর্থিকভাবেও সাহায্য করে। তারপর ফের ক্রিকেট খেলা শুরু করি,’ বলছিলেন দুর্গেশ।
কলকাতা ময়দানে পাড়ি ২০১৬-১৭ মরসুমে। ইস্টবেঙ্গলের নেটবোলার হিসাবে গিয়েছিলেন। পরের মরসুমে ইস্টবেঙ্গলে সই করেন। কয়েকটি ম্যাচেও খেলেন। তার পরের মরসুমে ভবানীপুরের সঙ্গে চুক্তি। তবে বেশিরভাগ ম্যাচ রিজার্ভ বেঞ্চেই ছিলেন। সেই বছর ক্লাবের ফলাফলও খুব একটা ভাল হচ্ছিল না। তারপর আচমকা হাজির হয় সুযোগ।
‘ইডেনে টাউনের বিরুদ্ধে ভবানীপুরের কোচ আব্দুল মোনায়েম আমাকে খেলার সুযোগ দেন। সেই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট পাই। ভবানীপুরও ঘুরে দাঁড়াল লিগে। এরিয়ান্সের বিরুদ্ধে ৮ উইকেট নিই। প্রথম ইনিংসে ৬টি ও দ্বিতীয় ইনিংসে ২টি। সেমিফাইনালে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ৪ উইকেট নিলাম। সেই মরসুমে (২০১৮-১৯) আমরা সিএবি-র প্রথম ডিভিশন লিগে চ্যাম্পিয়ন হই। তারপরই বাংলার অনূর্ধ্ব ২৩ দলে ডাক পাই। সি কে নাইডু ট্রফিতে ২ ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়েছিলাম। তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে ৬ উইকেট ও দিল্লির বিরুদ্ধে ২ উইকেট। দুটি ম্যাচই হয়েছিল সল্ট লেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে,’ বলছিলেন দুর্গেশ।
কিন্তু লড়াইয়ের তখনও অনেক বাকি ছিল। এরপরই ক্লাব ক্রিকেট খেলতে গিয়ে গোড়ালি মচকে যায়। চোটের জন্য সেই মরসুমে আর খেলতে পারেননি দুর্গেশ। বাংলা দলও সিকে নাইডুর নক আউট পর্বে যেতে পারেনি সেবার। তারপরই করোনা এসে সব টালমাটাল করে দেয়। ফের থমকে যায় দুর্গেশের স্বপ্ন।
তবে হাল ছাড়ার পাত্র নন বাঁহাতি পেসার। এখন ভবানীপুরের হয়ে প্রথম ডিভিশন লিগ খেলছেন। বাংলার অনূর্ধ্ব ২৫ সম্ভাব্য দলে আছেন। ক্রিকেট মাঠেই নিজেকে নিংড়ে দিচ্ছেন।
নজির গড়ে ৮ উইকেট পাওয়ার পর সিএবি-র তরফে কোনও শুভেচ্ছাবার্তা পাননি। তবে অনূর্ধ্ব ২৫ দলের সাপোর্ট স্টাফদের দুজন অভিনন্দন জানিয়েছেন।
দুর্গেশের দাদা এক বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। গুরগাঁওয়ে থাকেন। দুবে পরিবারের বাস ভদ্রেশ্বরের পাইকপাড়ায় জুটমিলের ঘুপচি কোয়ার্টারে। কোয়ার্টার না বলে মাথা গোঁজার ঠাঁই বলাই হয়তো বেশি মানানসই। এক চিলতে একটাই ঘর। সেখানেই ঠাসাঠাসি করে চারজনের বাস। একই ঘরে শোওয়া, বাসনপত্র রাখা, খাওয়া-দাওয়া। সঙ্গে এক ফালি রান্নাঘর।
গতি ও স্যুইংয়ে বিপক্ষ ব্যাটারদের কাবু করে ফেললেও অভাবের হাতে বারবার মার খেতে হচ্ছে তরুণ পেসারকে। বলছিলেন, ‘বাংলার হয়ে খেলতে চাই। ভারতীয় দলে খেলার স্বপ্নও দেখি। তবে একটা চাকরিও ভীষণ দরকার। যাতে অন্নসংস্থান নিয়ে উদ্বেগে থাকতে না হয়। স্পোর্টস কোটায় চাকরির জন্য আবেদন করেছি কয়েক জায়গায়। দেখা যাক।’
নিজে বাঁহাতি। স্বাভাবিকভাবেই ট্রেন্ট বোল্ট ও মহম্মদ আমিরের ভক্ত। ভারতীয় বোলারদের মধ্যে প্রিয় জাহির খান। আপাতত বাইশ গজেই পড়ে থাকতে চান দুর্গেশ। হাঁড়ির টানে ফের ক্রিকেট ছাড়তে চান না ২৪ বছরের তরুণ।