Blog : সুপারপাওয়ারের পক্ষে লজ্জাজনক পরিসমাপ্তি : দৌড়াও, আমেরিকা, দৌড়াও
আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। তার পরেই আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে তালিবান। এনিয়ে বাইডেন-নীতির সমালোচনার মুখে। উঠছে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রশ্নও। বিনয় লালের ব্লগ থেকে বিশেষ প্রতিবেদন...
আফগানিস্তান তালিবানের হাতে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকানদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য হিমশিম খাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্ক টাইমসে এটাই এখন শিরোনাম। টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনের স্ক্রিনেও সেই ছবিই জ্বলজ্বল করছে। কীভাবে আমেরিকানরা তাঁদের পায়ের মাঝে লেজ গুটিয়ে দৌড়াচ্ছে ! মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন আমেরিকান বাহিনীকে হঠাৎ করে প্রত্যাহার বিষয়ক বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্তব্য করেন। তাঁর মুখ থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘোষণাটি অবশ্যই ছিল, 'এটা স্পষ্টতই সাইগন(হো চি মিন শহর বা সাইগন। ভিয়েতনামের সবথেকে বড় শহর) নয়।' ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী এই শহরটি দখল করে নেয়। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাইগনের দূতাবাস থেকে তাদের কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এর জেরে আমেরিকা যে অপমান সহ্য করেছিল তা স্মরণ করে ব্লিংকেন মানুষকে ভুল ধারণা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তখন এবং এখন, শেষ মুহূর্তের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবিটি হল, আমেরিকান হেলিকপ্টার যা মার্কিন কর্মী এবং 'সহযোগীদের' নিয়ে যাচ্ছে। তখন ছিল দুষ্ট কমিউনিস্টরা; আর এখন ভয়ঙ্কর ইসলামী জঙ্গি। কিন্তু আবারও সেই আমেরিকাই। যারা বিশৃঙ্খল পরিবেশ থেকে পালাচ্ছে, যে বিশৃঙ্খলা প্রথম থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।
আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি। আরেকটি হারের সম্মুখীন হয়েছে। এই পরাজয়ের বিশালতাকে ছোট করা যাবে না। অনেকেই এই আঘাতকে নরম করার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ এটাকে 'হতাশাজনক' বলে ব্যাখ্যা করছেন। একটা অংশ আমেরিকানদের 'মর্যাদা' হারানোর কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, কীভাবে মার্কিন সেনাবাহিনী ধরা পড়েছে। এটা আফগানিস্তানে মার্কিন যুগের সমাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিতে এটা বলা যথেষ্ট নয় যে, আমেরিকানরা প্রত্যাহারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বাইডেন ও তাঁর উপদেষ্টারা কেবল আফগান নিরাপত্তাবাহিনী তালিবানকে আটকাতে কতটা সক্ষম হবে তার ভুল হিসাব করেছেন। বর্তমান সময়ে এই 'অপমান'--কে কৌশলগত চিন্তাভাবনা এবং বাইডেনের পূর্বসূরি দ্বারা নির্ধারিত নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা পর্যন্ত নামানো যেতে পারে। যদিও অনেক আমেরিকান এটা ভাববে যে কেন 'ট্রিলিয়ন ডলার' নষ্ট করা হয়েছে । এটা সেই পরিমাণ যা ২০ বছর ধরে যুদ্ধের ব্যয় হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে। সামরিক কর্মকাণ্ড, আমেরিকানদের ব্যাপক উপস্থিতি বজায় রাখা এবং জাতিগঠনের চেষ্টা বাবদ এই খরচ। যেমনটা আমেরিকানরা স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে মুক্ত করা এবং উপজাতিদের 'সভ্যতা'-র কাছে নিয়ে আসা। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অতিরিক্ত যুদ্ধপ্রিয় সংস্কৃতি যা বর্বরতার আরেকটি রূপ, সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার কথা তুলে ধরে। আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতিতে এটা সহজাত এবং কথিত স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসার আমেরিকান চরিত্রও। এই বিষয়টির নিষ্ঠুর সত্যি এটাই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি এবং জাপানে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের সিদ্ধান্তমূলক জয়ের পর আমেরিকা সরাসরি আর কোনও যুদ্ধ জিততে পারেনি। অবশ্য আদৌও যদি তারা কোনও যুদ্ধ জিতে থাকে। কোরিয়ান যুদ্ধ (জুন ১৯৫০ - জুলাই ১৯৫৩) একটি অচলাবস্থার মধ্যে শেষ হয়েছিল, যা একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তির দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল এবং এর তিক্ততম দিকটি আজও অব্যাহত আছে। ভিয়েতনামে 'দায়িত্ব' গ্রহণ করেছিলেন আমেরিকানরা। যেমনটি তাঁরা দেখেছিলেন, ফরাসিরা আর ক্রমবর্ধমান কমিউনিস্ট হুমকিকে থামাতে সক্ষম ছিলেন না।
তার দুই দশক পর ঘটে আর একটি দীর্ঘায়িত জটিল অবস্থা। এবার ইরাকে। আমেরিকানরা প্রথমে ইরাকে বোমা মেরে সাদ্দাম হোসেনকে বশ্যতা স্বীকার করাতে চায়। তার কয়েক বছর পরে ইরাকি স্বৈরশাসককে কোণঠাসা করে এবং আক্ষরিকভাবে তাঁকে গর্ত থেকে টেনে বের করে ফাঁসির মঞ্চে পাঠিয়ে। এই প্রক্রিয়ায়, তাঁরা কেবল দেশটাকেই নষ্ট করে দেয়নি বরং গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রবর্তনের তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও নষ্ট করে দিয়েছে। অথচ তাঁদের নিজেদের দেশে করার মতো যথেষ্ট বিষয় ছিল। যেমন- সাদা আধিপত্যবাদী এবং জেনোফোবিক সামরিকবাদীদের উত্থান খুব স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা সমগ্র পশ্চিম এশিয়া জুড়ে সমগ্র সমাজকে উন্মোচনের প্রভাব (অথবা মধ্যপ্রাচ্য, যেমন আমেরিকানরা এটিকে বলে)। এর পর সিরিয়ায় পরাজয়। যেখানে পশ্চিমী শিক্ষায় শিক্ষিত বাশার আল-আসাদের নৃশংসতা ইরাককে হুসেনের অধীনে পরিণত করে। সেইসাথে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ। মার্কিনরা মুয়াম্মার গদ্দাফি সরকারের পতনের সংকল্প নেয়। যা মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ছাপ। এমনকী অন্যরা যেমন রাশিয়া ও সৌদি আরবের ভূমিকার কথা বলে সেই বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে যাতে আরব দুনিয়া এখন শঙ্কিত। এখন, কিছু দিনের মধ্যেই সশস্ত্র উপজাতির কাছে আমেরিকান সেনার বিশ বছরের উপস্থিতির পর আত্মসমর্পণ গল্পে পরিণত হবে। কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীতল যুদ্ধে জিতেছে। যদি তা করেও থাকে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের মৃত্যুর ত্রিশ বছর পরেও স্পষ্ট নয়, এটি কেবল একটি 'ঠান্ডা' জেতার প্রভাব কী হতে পারে তা জিজ্ঞাসা করা 'গরম' যুদ্ধের চেয়েও সার্থক। এখন যেটা পরিষ্কার হওয়া উচিত তা হল যে সামরিক শক্তির, প্রকৃতপক্ষে অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তির, সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটা প্রকৃতপক্ষে একটা দায়ও। অন্যান্য শক্তি, বিশেষ করে চিনের জন্য এর মধ্যে একটি শিক্ষা রয়েছে। যাকে ঐতিহাসিকরা কখনও সখনও ভালোবেসে বলেন, 'ইতিহাসের পাঠ'। সেটিকে ত্যাগ করার মানুষের প্রবণতাকে কখনই ছোট করা উচিত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তার সামরিক পরাজয়কে পুরোপুরি স্বীকার করেনি। জেনারেলরা কেবল এই শিক্ষাটিই নিয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁদের পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় যুদ্ধ করবেন না। আমেরিকা জঙ্গি-বিরোধী অভিযানগুলিতে এখন থেকে কীভাবে গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, যাকে বলা হয় নন-স্টেট অ্যাক্টর সেদিকে নজর দেবে। আল-কায়েদা, তালিবান, আইএসআইএস এবং অন্যান্য জিহাদি সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযানে অবশ্যই এই গল্পের উপাদান রয়েছে। যাইহোক, এর কোনওটিই এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না যে, অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তিতে একবারের জন্যও সুবিধা নেই। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক এবং আফগানিস্তানে আমেরিকার যুদ্ধের বিপরীতে জার্মানির উপর আমেরিকান বিজয়ের বিষয়ে খুব কমই উল্লেখ করা হয়েছে। এটি টর্চ বিয়ারার হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে 'পশ্চিমা সভ্যতার' সংস্কৃতি ভাগ করার উপাদান। এর অনেকগুলি প্রভাব ছিল : যেমন- মার্কিন বাহিনী বিদেশের বিষয়ে অনেক দূরে ছিল, ঠিক যেমন তালিবানরা। তালিবানের প্রত্যাবর্তন, যা নিয়ে আমি প্রবন্ধে ফিরে যাব, এই বিবেচনার জন্য অনেকটা ঋণী।