নয়াদিল্লি: সৃষ্টিতত্ত্বের নেপথ্যে কোনও ঈশ্বর নামক সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন চার্লস ডারউইন। কিন্তু শুধুমাত্র জীবজগতের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য নয়। গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের জন্যও বিবর্তনবাদের তত্ত্ব খাটে। পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্যের উদঘাটন করতে গিয়ে অন্তত তেমনই ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন বিজ্ঞানীরা। আর তার সঙ্গেই উঠে এসেছে আরও চমকপ্রদ তথ্য। বিজ্ঞানীদের মতে, সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহের আকার ধারণ করার আগে দুই মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে সংঘর্ষ বেধেছিল। এর মধ্যে দুর্বল বস্তুটি কয়েকটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, যার একটি টুকরো বর্তমানে রাতের আকাশে চাঁদ হয়ে ধরা দেয় এবং অন্য অংশটি পৃথিবীর অন্তঃস্থলে গেঁথে রয়েছে আজও। (Science News)


গত ১ নভেম্বর ‘নেচার’ জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতেই এমন দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা (Space News)। ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, আজ থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি। কিন্তু সেই সময় পৃথিবী একটি মহাজাগতিক বস্তু ছিল মাত্র, আজকের এই সম্পূর্ণ রূপ ধারণ করেনি। অর্থা পূর্ণাঙ্গ গ্রহের আকার ধারণ করার আগে সেই সময় অনুরূপ আর একটি মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা লাগে পৃথিবীর। পৃথিবীর সঙ্গে যে বস্তুটির ধাক্কা লাগে, সেটি আয়তনে ছিল মঙ্গলগ্রহের সমান পাথুরে একটি বস্তু। গ্রিক পুরাণে চাঁদের মায়ের নামানুসারে বিজ্ঞানীরা ওই মহাজাগতিক বস্তুটির নাম দিয়েছেন ‘থিয়া’ (Protoplanet Theia)। 


বিজ্ঞানীদের দাবি, সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীরও কিছু অংশ ছিটকে বেরিয়ে যায়। তুলনায় দুর্বল ‘থিয়া’ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের ওই টুকরো অংশগুলি সন্নিবিষ্ট হয়েই পরবর্তী কালে চাঁদের সৃষ্টি হয়। এর পর ‘থিয়া’র কী পরিণতি হয়, তা নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে এতদিন হিমশিম খেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু নয়া গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে, সংঘর্ষের ফলে ‘থিয়া’র বাকি ধ্বংসাবশেষ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে পৃথিবীরই অন্তঃস্থলে এসে গেঁথে যায়। আজও পৃথিবীর গর্ভেই ঘুমিয়ে রয়েছে ‘থিয়া’র ধ্বংসাবশেষ। ওই গবেষণাপত্রের মূল লেখক, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র জিওডায়নামিস্ট চিয়ান ইউয়ান বলেন, ‘‘ওই সংঘর্ষের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পৃথিবীর বিবর্তনের উপর পড়ে। অন্যান্য গ্রহের থেকে ভূতত্ত্বের নিরিখে পৃথিবী কেন আলদা, তার ব্যাখ্যা রয়েছে ওই ঘটনার মধ্যেই।’’


আরও পড়ুন: Delhi Tremors: নেপাল হোক বা আফগানিস্তান, পড়শি দেশে ভূমিকম্প হলে কেন কাঁপে দিল্লি? জানুন বিশদে


চিয়ান এবং তাঁর সহযোগীরা পৃথিবীর অন্তঃস্থলে, প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার গভীরে বিরাজমান মহাদেশের সমান আয়তনের দু’টি ঘন-তরল অর্ধগোলাকার অবয়বের উপর পরীক্ষা চালান। তাতে দেখা যায়, পৃথিবীর অভ্যন্তরে অন্যত্র ভূকম্পীয় তরঙ্গ তীব্র গতিতে ধাবমান হলেও, ওই দুই অবয়বের মধ্যে দিয়ে ধাবিত হওয়ার সময় তাদের গতি শ্লথ হয়ে যায়। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্তঃস্থলের বাকি অংশের চেয়ে ওই দুই অবয়বের ঘনত্ব বেশি। এর পর কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করে তার অনুকরণ করলে দেখা যায়, ‘থিয়া’র ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীর অন্তঃস্থলে গেঁথে থাকতে পারে। চাঁদ এবং মহাকাশের অন্যত্র থেকে সংগৃহীত ‘থিয়া’র পাথুরে উপাদান পরীক্ষা করে এর আগে পৃথিবীর চেয়ে তার ঘনত্ব ২ থেকে ৩.৫ শতাংশ বেশি বলে পাওয়া দিয়েছিল। পৃথিবীর অন্তঃস্থলে গেঁথে থাকা ওই দুই অবয়বের ঘনত্বও তেমনই। 


কম্পিউটার মডেলকে সামনে রেখে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর অন্তঃস্থলে গেঁথে থাকা ‘থিয়া’র ওই ধ্বংসাবশেষ মূলত গলিত পাথর। সময়ের সঙ্গে সেটি কঠিনতর হয়ে উঠেছে। প্রায় কয়েকশো মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। পৃথিবীর অন্তঃস্থলকে আচ্ছাদনের মতো করে ঢেকে রেখেছে ওই ধ্বংসাবশেষ। পৃথিবীর মোট ভরের সঙ্গে তুলনা করলে, তার ওজন ১/৪০ থেকে ১/৬০ হতে পারে। ভূগর্ভে থাকা অন্য শিলার তুলনায় ওই ধ্বংসাবশেষ অনেক গুণ বেশি আয়রনে সমৃদ্ধ। চাঁদের আগ্নেয় শিলার সঙ্গে তার মিল রয়েছে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। তাঁদের দাবি, টেকটোনিক পাতগুলি পরস্পরের থেকে সরে গেলে, নীচ থেকে যে গলিত শিলা, ছাই, লাভা উপরের দিকে উঠে আসে, তাতে ‘থিয়া’র ধ্বংসাবশেষও মিশে যায় অনেক সময়। আইসল্যান্ড এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এর নজির পাওয়া যায়।