ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সেই সংগ্রামের শিল্পকর্ম
এই বছর ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস। ধুমধাম করে ১৫ আগস্ট উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। এই সময়ে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের দিকেই মনোযোগ যায়, যাঁরা আমাদের এই স্বাধীনতার মূল কারিগর বলে পরিচিত। যাঁদের আন্দোলনের ফলে আমাদের এই স্বাধীনতা মিলেছে। 'জাতির জনক' মহাত্মা গাঁধীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি হিসেবে স্মরণ করা হয়। পাশাপাশি, আরও একাধিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাঁদের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বলে স্মরণ করা যায়। গাঁধীর প্রান্তিকীকরণ বেশ কিছুদিন ধরেই শুরু হয়েছে। এখন যাঁরা কেন্দ্রের সরকারে রয়েছেন, তাঁরা মসনদে আসার অনেক আগে থেকেই এটি শুরু হয়েছে। আর তার সঙ্গেই সম্প্রতি রিলিজ হওয়া সিনেমা আরআরআর (RRR)-আমাদের বর্তমান সময়ের সিনেমা সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেককিছু বলে দেয়। সিনেমায় দেখানো হয়েছে ভারতকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য কারা 'আসল যোদ্ধা' এবং তখনই চমকে যেতে হয় যখন দেখা যায় ওই যোদ্ধা বা মনীষীদের তালিকায় গাঁধী বা জওহরলাল নেহরু কেউই নেই। সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত দেখলে এটা মনে হয় যে সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিং, সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে আর কয়েকজনের ইতিহাসকেই বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া পোস্ট অনুযায়ী এই সিনেমার স্ক্রিপ্টরাইটার বিজয়েন্দ্র প্রসাদের (Vijayendra Prasad) একটি উক্তি জানা যাক। বছর পাঁচেক আগে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল গাঁধী এবং নেহরু এই দেশের জন্য কিছু করেছেন কিনা। তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি ছোটবেলায় স্কুলজীবন থেকে শেখানো গোঁড়া ঐতিহাসিক অ্যাখানকে প্রত্যাখান করা শুরু করেছেন। হোয়াটসঅ্যাপ ও টুইটার থেকে যখন কেউ ইতিহাস পড়েন, তখন তার ফল হিসেবে 'আরআরআর' (RRR) পাওয়া যায়। এই প্রশ্ন ছাড়াও আরও একটি প্রশ্ন রয়েছে। সেটা হল ভারতের আদিবাসী সংস্কৃতি বা তাঁদের বর্ণ এবং তার রাজনৈতিক ইতিহাসের ব্যাখ্যার বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারা কী বোঝেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে এবং এর ঠিক পরপরই কী কী ঘটেছিল তা বোঝার একটি উপায় হল সমকালীন শিল্পীরা সেই সময়ের ঘটনাগুলি দেখে তাঁদের কাজের মাধ্যমে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন।
ওই শিল্পগুলি খুঁটিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় যে, ওই শিল্পী এবং মুদ্রণ নির্মাতারা স্বাধীন হতে চাওয়া মানুষদের আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গাঁধীকে দেখেছিলেন। তাঁরা দ্বিধাহীনভাবে গাঁধীকে রাজনৈতিক আঙিনায় দেবতার আসন দিয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত পত্রিকা ও সংবাদপত্রগুলির অধিকাংশই গাঁধীর বিষয়ে লিখেছে। গাঁধীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নানা কর্মসূচির বিষয়ে লিখেছে। সেই তালিকায় রয়েছে চম্পারণ সত্যাগ্রহ, লবণ সত্যাগ্রহ, অসহযোগ আন্দোলন, বরদৌলি সত্যাগ্রহ। রয়েছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সেই সময়ের মুদ্রক এবং শিল্পীরা দ্বিধাহীন ভাবে তাঁকে এবং একমাত্র তাঁকেই সেই সময়ের বাকি সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু স্থানে বসিয়েছিলেন এবং ভারতীয় সভ্যতা এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার যোগ্য উত্তরাধিকারীর স্থানেও বসিয়েছিলেন। এখানেই উল্লেখ করা যায় পিএস রামচন্দ্র রাও (PS Ramachandra Rao)-এর তৈরি একটি পোস্টার যা ১৯৪৭-৪৮ সালে তৎকালীন মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল 'The Splendour That is India'। সেখানে বাল্মিকী, থিরুভাল্লুভার, বুদ্ধ, মহাবীর, শঙ্করাচার্য, রামানুজ, গুরু নানক, রামকৃষ্ণ, রামন মহর্ষির মতো ভারতীয় মনীষীদের সঙ্গেই স্থান পেয়েছিলেন মহাত্মা গাঁধী।
এবার দেখা যাক আরও কিছু ছবি যা কানপুরে শ্যাম সুন্দর লালের হাতে প্রতিষ্ঠিত একটি ওয়ার্কশপ থেকে প্রিন্ট হয়েছিল। এই শ্যাম সুন্দর লাল নিজেকে একজন 'ছবি ব্যবসায়ী' হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন, একটি ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। জাতীয়তাবাদী শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে কানপুর কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার বিশদ বিবরণে এই মুহূর্তে না গেলেও এটা মনে করিয়ে দেওয়া যাক যে ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় কানপুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাস্থল ছিল। ১৯ শতকের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের জন্য একটি প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে উঠে আসে কানপুর। পাশাপাশি শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম জায়গাও ছিল কানপুর। এটি এমনই একটি শহর যেখানে কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেসপন্থী উভয়েই ক্ষমতাশালী ছিল। এই ছবিগুলি কীভাবে প্রচারিত, বিলি হয়েছিল বা ব্যবহার করা হয়েছিল তা আমরা ঠিক জানি না। এগুলি কি হাতে হাতে বিলি হয়েছিল? কোনও এলাকার দেয়ালে সাঁটা হয়েছিল, নাকি ফ্রেমবন্দি হয়ে বাড়িতে জায়গা পেয়েছিল, তা আমরা জানি না। ছবিগুলির কত কপি মুদ্রিত হয়েছিল তাও জানা নেই। প্রায় ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে এই ওয়ার্কশপটি ব্যবসা করেছিল। যে ছবিগুলি টিকে আছে তা দেখে আন্দাজ করা যায় যে মুদ্রণ নির্মাতারা জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে কোন চোখে এবং কীভাবে দেখেছিলেন।
সুন্দর লালের ওয়ার্কশপের ছবি তৈরি করা শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন প্রভু দয়াল। তাঁর তিনটি শিল্পকর্মের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। 'সত্যগ্রহ যোগ-সাধনা' শিরোনামের একটি ছবি। গাঁধীকে মঞ্চের কেন্দ্রে দেখানো হয়েছে, যাঁর এক প্রান্তে মতিলাল এবং আর এক প্রান্তে তাঁর পুত্র জওহরলাল রয়েছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে গাঁধী একটি কাঁটার আসনে বসে ধ্যানমগ্ন। এই ছবি অনেকটা মহাভারতের তিরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের কথা মনে করায়। ভীষ্ম শরশয্যার শুয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তে ধর্ম ও রাজধর্মের শিক্ষা দিয়েছিলেন। কাঁটা ছাড়া যেমন গোলাপ হয় না। তেমনই সংযম এবং শৃঙ্খলা ছাড়া কোনও স্বাধীনতাও পাওয়া যায় না। সালটা ১৯২৯। সেই বছরের ডিসেম্বরে লাহোরে জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে কংগ্রেসের বার্ষিক সভা হয়। সেখানেই পূর্ণ স্বরাজের জন্য প্রস্তাব পাস হয়েছিল। এই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, পূর্ণ স্বরাজের রশ্মি ওই তিনজনের উপরেই এসে পড়ছে।
আরও একটি ছবি উল্লেখযোগ্য। সেটি ১৯৩০ সালের একটি ছবি। রামায়ণের রাম ও রাবণের যুদ্ধের আঙ্গিকে গাঁধী ও ব্রিটিশের লড়াইকে দেখানো হয়েছে। অহিংসা ও হিংসার মধ্যে যুদ্ধ, সত্য ও অসত্যের মধ্যে যুদ্ধ হিসেবে বর্ণিত করা হয়েছে ছবিটিতে।
এই ছবিটিতে দশানন রাবণ হিসেবে মৃত্যু ও অত্যাচারের প্রতীক ব্রিটিশ রাজকে দেখানো হয়েছে। এই যুদ্ধ যেন আমাদের সময়ের রামায়ণের যুদ্ধ। এই 'স্বাধীনতার যুদ্ধ'-এ গাঁধীর অন্যতম অস্ত্র হল চরকা এবং সুতোকাটার টাকু। রামায়ণে যেমন রামের সাহায্যের জন্য হনুমান ছিলেন, তেমনই গাঁধীর সহযোগী ছিলেন নেহরু। হনুমান সঞ্জীবনী ওষুধের খোঁজে গিয়েছিলেন। নেহরুকে বর্তমান সময়ের হনুমান হিসেবে দেখানোর মধ্যে কোনও ভুল ছিল না। ছবিটির এককোণায় অসহায় চেহারায় বসে থাকতে দেখা যায় ভারতমাতাকে। গাঁধীকে খালি গায়ে এবং ধুতি পরিহিত অবস্থায় দেখা যায় ছবিটিতে। আর উল্টোদিকে ব্রিটিশদের পায়ে জুতো, পুলিশের লাঠি, সেনা বিমানের মতো বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত। ছবিতে ক্ষমতালোভী ব্রিটিশদের একটি হাতে দেখা যায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা, যে আইনের মাধ্যমে যে কোনও জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায়। ওই আইন ঔপনিবেশিক শক্তির ব্যবহার করত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন রোখার জন্য। আর এই আইনই এখনও স্বাধীন ভারতেও প্রয়োগ করা হয়।
প্রভু দয়াল অবশ্য স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধিতে বিশ্বজনীন ছিলেন। সেই সময়ে একটি উপলব্ধি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। অনেকে মনে করছিলেন অহিংসা আন্দোলন কার্যকরী নয়। তাঁরা এই আন্দোলনকে উপহাস করছিলেন। তাঁরা মনে করছিলেন গাঁধী বিশ্বের সামনে ভারতের এমন একটি ছবি তুলে ধরছিলেন যাতে দেশের সম্মান থাকে না। দয়াল অবশ্য মনে করেননি যে সুভাষচন্দ্র বসু বা ভগৎ সিংহের সঙ্গে মহাত্মা গাঁধীর কোনওরকম দ্বন্দ্বের সম্পর্ক ছিল। তাঁর অনেক কাজেই দেখা গিয়েছে গাঁধী ও ভগৎ সিংহ- দুজনেরই একসঙ্গে গুণকীর্তন করতে। যেমন ধরা যাক 'স্বতন্ত্রতা কি বেদী পর বীরো কা বলিদান' বা (The Sacrifice of heroes at the Altar of Independence)
এই ছবিতে ভারতমাতার সামনে ভগৎ সিং, মতিলাল, জওহরলাল, গাঁধী এবং আরও অসংখ্য ভারতীয় সারি বেঁধে রয়েছেন। ছবিতে রয়েছে অসংখ্য শহিদের মস্তকও। তাঁদের কথা স্মরণ করা হয়েছে যাঁরা তার আগেই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, আসফাকউল্লা খান, রাজেন্দ্র লাহিড়ি, রামপ্রসাদ বিসমিল, লালা লাজপত রাই, যতীন্দ্রনাথ দাস। প্রভু দয়াল 'পঞ্জাব সিংহ' ভগৎ সিং এবং আরও অসংখ্য ভারতীয় যুবা যাঁরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন তাঁদের বলিদানকে তুচ্ছ বলেননি।
এই শিল্পকর্মের বেশিরভাগই সম্প্রতি ঐতিহাসিক এবং অন্য পণ্ডিতদের দ্বারা যাচাই হচ্ছে। এই ছবিগুলো শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের গল্পই বলে না, বরং একটা জাতির পরিচয় গড়ে তোলার কাজেও সাহায্য করে। ভারতের ইতিহাসের এই সঙ্কটময় সন্ধিক্ষণে কী ধরনের শিল্পকর্ম ফের এই কাজ করবে সেটাই এখন দেখার।
লেখক লস অ্যাঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। ২০২২ সালের অক্টোবরে রোলি বুকস দ্বারা প্রকাশিত তাঁর বই 'Insurgency and the Artist'-এ তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের শিল্পের অন্বেষণ করেছেন।
ডিসক্লেইমার: এই ওয়েবসাইটে বিভিন্ন লেখক এবং ফোরাম অংশগ্রহণকারীদের মতামত, বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিগত। তা এবিপি নিউজ নেটওয়ার্কের মতামত, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে না।