এক্সপ্লোর

Swami Vivekananda - Nivedita : নিজে পরিবেশন,শিষ্যার হাত ধুইয়ে দেওয়া, কেমন ছিল বিবেকানন্দ-নিবেদিতার শেষ দেখা

নিবেদিতা ভাবতে পারেননি শেষ সময় সমাগত। শেষের দিনগুলি আসার আগে স্বামীজী কিন্তু তাঁর কাছের মানুষদের বারবার সংকেত দিয়েছিলেন।

'আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি, এখন আমাকে যেতেই হবে।' তখন স্বামী বিবেকানন্দর বয়স ৩৯। তাহলে কি আর বেশি সময় নেই ? চমকে উঠলেন সামনের মানুষটি। ২৮ মার্চ, ১৯০২। বেলুড় মঠে সেদিন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে। ভগিনী নিবেদিতা পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন। ঘরে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন স্বামীজী ( Swami Vivekananda ) ।

আইরিশ দুহিতা মার্গারেট যে একদিন ভারতের মাটির কন্যা নিবেদিতা হয়ে উঠবেন তা জেনেই স্বামীজী তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।   অসীম তেজস্বীনি, প্রখর বুদ্ধিমতী নিবেদিতার দর্শনকে পথ দেখিয়েছিলেন ধ্রবতারার মতো । সেই শিষ্যা যে স্বামীজীর কতটা কাছের মানুষ, কতটা স্নেহভাজন, কতটা ভরসাস্থল ছিলেন তা বোঝা যায় বিবেকানন্দের মহাসমাধির আগের কয়েকটি দিনের কথায়।  

শেষের দিন সমাগত, বারবার সংকেত দিয়েছিলেন স্বামীজী

শেষের দিনগুলি আসার আগে স্বামীজী তাঁর কাছের মানুষদের বারবার সংকেত দিয়েছিলেন। নিবেদিতাকে তো তিনি স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন তাঁর চলে যাওয়ার সময় এসে গিয়েছে বলে। ধীরে ধীরে মহাপ্রস্থানের সময় এসেই গেল। ২৯ জুন নিবেদিতা অসুস্থ স্বামীজীকে দেখতে মঠে গিয়েছিলেন। তখনও তিনি ভাবেননি এত তাড়তাড়ি চলে যাবেন তাঁর গুরু ।

২৯ জুন ছিল রবিবার। সেদিনও তিনি তাঁর শিষ্যাকে বলেছিলেন, তাঁর মনে একটা মহা তপস্যার ভাব জাগছে, তিনি বুঝেছিলেন যে, তাঁর দিন ফুরিয়ে আসছে। তাই হয়ত সেদিন নিবেদিতা এসেছেন শুনে তড়িঘড়ি ঠাকুর ঘর থেকে নেমে এসেছিলেন। নাহলে হয়ত আরও অনেকক্ষণ ধ্যান করতেন।

 'আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি হচ্ছি'

স্বামীজীর মর্তলীলা সমাপ্তপ্রায় বুঝেছিলেন নিবেদিতা। সে সময়টা নিয়ে তিনি লিখেছেন, '' জুন মাস শেষ হইলে তিনি বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, তাঁহার অন্তিমকাল নিকটবর্তী হইয়াছে। দেহত্যাগের পূর্ব বুধবারে তিনি সমীপস্থ একজনকে বলিয়াছিলেন, 'আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি হচ্ছি। একটা মহা তপস্যা ও ধ্যানের ভাব আমার মধ্যে জেগেছে এবং আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।''

২৯ তারিখের পর ফের ২ তারিখ ফের মঠে গেলেন নিবেদিতা। মনটা ছটফট করছিল। সেদিন আসলে নিবেদিতা স্বামীজীর সঙ্গে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। জিগ্যেস করছিলেন বিজ্ঞানের কোনো একটি বিষয় তাঁর স্কুলে পড়াবেন কি না।  তিনি সেদিন বলেছিলেন, 'এসব ব্যাপার আমি আর আলোচনা করতে পারি না। আমি মৃত্যুর দিকে চলেছি।' জাগতিক ব্যাপার থেকে যেন তাঁর মন সরে গিয়েছে।

নিবেদিতার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ 

তবে স্বামীজীর মধ্যে ছিল না কোনও বিমর্ষ ভাব। ছিল না ভাবগম্ভীর মুখ। নিবেদিতার প্রশ্নের কোনও উত্তর সেদিন স্বামীজী দিলেন না, শুধু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁকে খাওয়ানোর জন্য। সেদিন ছিল একাদশী। স্বামীজীর উপোস। কিন্তু শিষ্যাকে তিনি খাওয়ালেন প্রাণভরে। নিজে পরিবেশন করলেন। কাঁঠালের বীজসিদ্ধ, আলুসিদ্ধ, সাদা ভাত এবং বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করা দুধ পরিবেশন করলেন। তারপর নিজের হাতে   জল ঢেলে দিলেন এবং তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে দিলেন। অবাক হয়ে শিষ্যা বললেন,'স্বামীজী, এসব আমারই আপনার জন্য করা উচিত।'স্বামীজী মনে করালেন, যীশুখ্রীষ্টের কথা। তিনিও  তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দেন মৃত্যুর আগে।' 

নিবেদিতা চমকে উঠেছিলেন, বলেও ফেলেছিলেন 'সে তো শেষ সময়ে।' কিন্তু তাও নিবেদিতা ভাবতে পারেননি শেষ সময় সমাগত। কারণ মৃত্যুচিন্তার কথা আগেও বলেছিলেন স্বামীজী। নিবেদিতার লেখায় পাওয়া যায় সেসব কথা।

ইচ্ছামৃত্যু বর লাভ করেছিলেন স্বামীজী 

তখন তাঁরা কাশ্মীর ভ্রমণে। ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি' গ্রন্থে নিবেদিতা লিখেছেন, তখন স্বামীজী বড় অসুখ থেকে সেরে উঠেছেন। তিনি বলেছিলেন, “যখনই মৃত্যু আমার কাছে আসে, আমার সব দুর্বলতা চলে যায়। তখন আমার ভয় বা সন্দেহ বা বাহ্যজগতের চিন্তা, এ-সব কিছুই থাকে না। আমি শুধু নিজেকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করতে থাকি। ''অমরনাথ থেকে ফিরে এসে স্বামীজী বলেছিলেন, তিনি ইচ্ছামৃত্যু বর লাভ করেছেন। তাই সবাই মনে করেছিলেন,মহাপ্রয়াণের আগে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তিনি দেবেন। নিবেদিতা তাঁর শেষ সাক্ষাতের বিষয়ে লিখেছেন, ‘বুধবার সকালে আমি আবার গিয়েছিলাম এবং তিন ঘণ্টা ছিলাম। এখন মনে হয়, তিনি জানতেন যে, আমি তাঁকে আর দেখতে পাব না। এত আশীর্বাদ! যদি কেবল আমি জানতে পারতাম! তাঁকে সুস্থ দেখাচ্ছিল।'

সেদিন ফিরে গেলেন নিবেদিতা। কিন্তু ওই কথাটা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। ৪ জুলাইও স্বামীজী নিবেদিতাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে তিনি বেশ সুস্থ বোধ করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন নিবেদিতা। কিন্তু সেদিন রাতেই স্বামীজীর আত্মা ত্যাগ করল তাঁর শরীর।  সন্ধ্যারতির ঘণ্টা বাজার পর নিজের ঘরেই চলে যান বিবেকানন্দ। ধ্যানে বসেন গঙ্গার দিকে মুখ করে। সঙ্গে ছিলেন এক ব্রহ্মচারী। তাঁকে তিনি বাইরে বসে ধ্যান করতে বললেন। ঘণ্টা খানেক পর তাঁকে ডেকে পাখার হাওয়া করতে বললেন।  বললেন জানলা খুলে দিতে। কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম। পাশ পরিবর্তন করে শুলেন। ব্রহ্মচারী চাঁর পা টিপে দিলেন। হঠাৎ যেন কেঁদে উঠলেন। নড়ে উঠল তাঁর ডান হাত। রাত নটার কিছু পরে গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। তার পর ছেড়ে চলে গেলেন জাগতিক শরীরটা।

সে-রাতে খবর পৌঁছায়নি বাগবাজার পর্যন্ত। কী আশ্চর্য, সেদিন রাতে নিবেদিতা স্বপ্নে দেখলেন,  শ্রীরামকৃষ্ণ  সেই রাতে পুনরায় দেহত্যাগ করেছেন। পরদিন সকালে মঠের চিঠি পৌঁছাল নিবেদিতার কাছে। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। পরক্ষণেই সম্বিত ফিরল। ছুটলেন বেলুড়ে।

শেষ দেখা

স্বামীজীর ঘরে গেলেন তিনি। যেন সমাধিস্থ মহাদেব। নিবেদিতা স্বামীজীর বিছানায় এসে বসলেন।  পাখার বাতাস করে গেলেন গুরুকে । দুপুর ২ টো পর্যন্ত। তারপর নতুন গেরুয়া বস্ত্রে ঢেকে গঙ্গার ধারে বেলগাছের কাছে অন্ত্যেষ্টির জন্য নিয়ে যাওয়া হল দেহ। স্বামীজী নিজেও চেয়েছিলেন এখানেই সম্পন্ন হোক তাঁর শেষকৃত্য।

নিবেদিতার অপ্রত্যাশিত ইচ্ছেপূরণ

সেদিন অন্ত্যেষ্টির সময় ঘটল এক অদ্ভূত ঘটনা। নিবেদিতা লক্ষ করলেন স্বামীজীর শয্যার উপর যে বস্ত্রটি রয়েছে, শেষবার তিনি তাঁকে ওইটি পরতে দেখেছিলেন। এটাও কি স্বামীজী দেহের সঙ্গেই অগ্নিতে সমর্পিত হবে, প্রশ্ন করেছিলেন তিনি।  মঠের আরেক সন্ন্যাসী তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি চাইলে ওই বস্ত্র তিনি  নিবেদিতাকে দিতে পারেন। কিন্তু ইতস্তত করে তিনি তা চাননি। পরে স্বামীজীর চিতা প্রজ্জ্বলিত হল। গনগনে আগুনের চারিপাশে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন নিবেদিতা। সকলে ভয় পেলেন । আগুনের ফুলকি যদি তাঁর গাউনে এসে লাগে ! তাঁকে শান্ত করে বসানো হল গঙ্গার কাছে। সে সময় হঠাৎ যেন কে তাঁর জামার হাতা ধরে টান দিল। তিনি দেখলেন তাঁর প্রার্থিত বস্ত্রখণ্ডের এক টুকরো সরাসরি চিতা থেকে উড়ে এসে পড়েছে তাঁর পদমূলে। এভাবেই সুযোগ্য শিষ্যার মনের শেষ ইচ্ছেটুকুও রেখেছিলেন গুরু।

 
গুরু। 'গু' যার অর্থ অন্ধকার বা অজ্ঞান , 'রু' শব্দের অর্থ অন্ধকারকে দূর করা। অর্থাৎ, 'গুরু' তিনিই, যিনি মনের অন্ধকার বা অজ্ঞানতা দূর করেন। নিবেদিতার মন ছিল আলোয় ভরা। সে আলোকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কাজটিই করেছিলেন তাঁর গুরু বিবেকানন্দ। স্বামীজীর মৃত্যুর শতাধিক বছর পরেও গুরু-শিষ্যার সম্পর্কের এমন উদাহরণ বোধ হয় ভারতভূমিতে তৈরি হয়নি।  

তথ্যসূত্র :

'নিবেদিতা লোকমাতা', শঙ্করীপ্রসাদ বসু
 'অচেনা অজানা বিবেকানন্দ', শংকর
'যুগনায়ক বিবেকানন্দ',  স্বামী গম্ভীরানন্দ
 'স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি', ভগিনী নিবেদিতা
'ভগিনী নিবেদিতা', প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা





 
আরও দেখুন
Advertisement
Advertisement
Advertisement

সেরা শিরোনাম

Weather Update: বৃষ্টিভেজা রথযাত্রা কলকাতায়, ভিজবে দক্ষিণবঙ্গও! উত্তরবঙ্গ নিয়ে কী পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতরের?
বৃষ্টিভেজা রথযাত্রা কলকাতায়, ভিজবে দক্ষিণবঙ্গও! উত্তরবঙ্গ নিয়ে কী পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতরের?
CMIE Unemployment Data: দেশে বেকারত্বের হার বাড়ল আবারও, পুরুষদের তুলনায় চাকরিতে পিছিয়ে মেয়েরা
দেশে বেকারত্বের হার বাড়ল আবারও, পুরুষদের তুলনায় চাকরিতে পিছিয়ে মেয়েরা
Bangladeshi Refugees: বাংলাদেশি শরণার্থীদের তাড়ানো সম্ভব নয়, মোদিকে জানাল মিজোরাম, প্রশ্ন BSF-এর ভূমিকায়
বাংলাদেশি শরণার্থীদের তাড়ানো সম্ভব নয়, মোদিকে জানাল মিজোরাম, প্রশ্ন BSF-এর ভূমিকায়
Rahul Gandhi: পরাজিত সুনককে চিঠি রাহুলের, কী বার্তা দেশের বিরোধী দলনেতার?
পরাজিত সুনককে চিঠি রাহুলের, কী বার্তা দেশের বিরোধী দলনেতার?
Advertisement
ABP Premium

ভিডিও

Sajal Ghosh: গণপিটুনিতে মৃত্যুর অভিযোগ, পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্ন বিজেপি নেতা সজল ঘোষের।Kolkata News: বালিগঞ্জের ময়দান সেনা ক্যাম্পে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, মৃত ১। ABP Ananda LiveBolpur News: ভাসুরের পরিবারকে পুড়িয়ে খুন! গ্রেফতার বাড়ির সেজ বউ। ABP Ananda LiveBJP News: কোচবিহারের তুফানগঞ্জে দলবদল ঘিরে বিতর্ক। ABP Ananda Live

ফটো গ্যালারি

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
Weather Update: বৃষ্টিভেজা রথযাত্রা কলকাতায়, ভিজবে দক্ষিণবঙ্গও! উত্তরবঙ্গ নিয়ে কী পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতরের?
বৃষ্টিভেজা রথযাত্রা কলকাতায়, ভিজবে দক্ষিণবঙ্গও! উত্তরবঙ্গ নিয়ে কী পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতরের?
CMIE Unemployment Data: দেশে বেকারত্বের হার বাড়ল আবারও, পুরুষদের তুলনায় চাকরিতে পিছিয়ে মেয়েরা
দেশে বেকারত্বের হার বাড়ল আবারও, পুরুষদের তুলনায় চাকরিতে পিছিয়ে মেয়েরা
Bangladeshi Refugees: বাংলাদেশি শরণার্থীদের তাড়ানো সম্ভব নয়, মোদিকে জানাল মিজোরাম, প্রশ্ন BSF-এর ভূমিকায়
বাংলাদেশি শরণার্থীদের তাড়ানো সম্ভব নয়, মোদিকে জানাল মিজোরাম, প্রশ্ন BSF-এর ভূমিকায়
Rahul Gandhi: পরাজিত সুনককে চিঠি রাহুলের, কী বার্তা দেশের বিরোধী দলনেতার?
পরাজিত সুনককে চিঠি রাহুলের, কী বার্তা দেশের বিরোধী দলনেতার?
Jalpaiguri News: টানা বৃষ্টিতে জল থইথই জলপাইগুড়ি, সেতুর ওপরে বসে চলছে বেচাকেনা
টানা বৃষ্টিতে জল থইথই জলপাইগুড়ি, সেতুর ওপরে বসে চলছে বেচাকেনা
Laxmi Narayan Yog: লক্ষ্মী-নারায়ণ যোগে ৫ রাশিতে অর্থপ্রাপ্তি, রাজকীয় সৌভাগ্যের ছোঁয়া
লক্ষ্মী-নারায়ণ যোগে ৫ রাশিতে অর্থপ্রাপ্তি, রাজকীয় সৌভাগ্যের ছোঁয়া
Birbhum News: উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যেই পুকুর ভরাট করে অবৈধ নির্মাণ, তুমুল হইচই এলাকায়
উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যেই পুকুর ভরাট করে অবৈধ নির্মাণ, তুমুল হইচই এলাকায়
Salary Hike: ডিএ বাড়ার পরে ফের সুখবর সরকারি কর্মীদের, আরও বাড়বে বেতন ?
ডিএ বাড়ার পরে ফের সুখবর সরকারি কর্মীদের, আরও বাড়বে বেতন ?
Embed widget