National Nutrition Week:স্বাদে, স্বাস্থ্যে বাঙালির হেঁশেলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পোস্ত-র
Posto In Traditional Bengali Cuisine: বাঙালির হেঁশেল আর পোস্ত থাকবে না, তাও কি হয়? জিভে জল আনা এই খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত ইতিহাস।
পায়েল মজুমদার, কলকাতা: তেল-নুন-লঙ্কা, বাঙালি হেঁশেল মানে এটুকু থাকবেই। গুটি গুটি পায়ে 'সেকেন্ড হেল্পিং'-এ এগোতে পারলে চোখ বন্ধ করে যা পাওয়া যাবে, তার মধ্যে অবশ্যই অন্যতম পোস্ত (posto) । এর প্রেমে কাঁটাতারের এপার-ওপার মিলেমিশে একাকার। (Health ) যদিও ভোজনরসিকদের বড় অংশের বক্তব্য, রাঢ়বঙ্গের পোস্ত 'একমেবাদ্বিতীয়ম'। কিন্তু প্রশ্ন হল,'ন্যাশনাল নিউট্রিশন উইক'-এ হঠাৎ পোস্ত-চর্চা কেন? উত্তর খুঁজতে একটু পিছনে হাঁটতে হবে। (National Nutrition Week)
পোস্ত, ইতিহাস ও চিন...
'বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে'...। ১৭৫৭ সাল। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হারিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন জাঁকিয়ে বসেছে। হঠাৎই তাদের নজরে পড়ে, চিনে বেআইনি আফিমের বিরাট বাজার রয়েছে। ব্যস। আর দেরি নয়। উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে শুরু হয় আফিম চাষ। গায়ের জোরে, কৃষকদের আফিম চাষে বাধ্য করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই আফিম থেকে তৈরি নেশার বস্তু কাঠের বাক্সে ভরে চালান হতে থাকে চিনে। ইতিহাসবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, তখনকার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বিরাট কৃষিজমি এই আফিম-ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। মুনাফা কুড়োতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এদিকে কৃষকের ঘরে 'সোনার ফসল'নেই, খাবার নেই। বদলে দিনভর আফিমের ঘোরে বুঁদ হয়ে থাকার টান বাড়ছে। কৃষকের পরিবার কি না খেতে পেয়ে মারা যাবে?
সে দিন স্রেফ প্রাণ বাঁচাতে বিকল্প খাবারের খোঁজ শুরু করেছিলেন তাঁদের স্ত্রী-পরিবার। বন-জঙ্গল, যেখান থেকে যা সম্ভব, খাবারের খোঁজ শুরু হয়। এর মাঝে হঠাতই এক সময় নজর পড়ে শুকিয়ে থাকা পোস্ত বীজগুলোর দিকে। এই পোস্তর বীজ নিংড়েই নেশার বস্তু, আফিম বের করে নিয়েছেন 'মালিকরা'। ওগুলো তাই তাঁদের আর কোনও কাজের নয়। ফেলে দেওয়া শুকনো পোস্তবীজ গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছিলেন ফসলের অভাবে ধুঁকতে থাকা কৃষকের পরিজনেরা। ভাগ্যিস করেছিলেন। না হলে, জানাই যেত না যে এই বীজ থেঁতো করে এমন সুন্দর বাদামের গন্ধওয়ালা 'পেস্ট' তৈরি হতে পারে?যাতে সামান্য তেল এবং পান্তাভাত মিশিয়ে দিনের পর দিন খাওয়া যায়। আর আলু মেশালে তো কথাই নেই। বিশেষত, যে সব এলাকায় অসম্ভব গরম, সেখানে এই পোস্ত শরীর ঠান্ডা রাখতে কাজে দেয়, মনে করেন অনেকেই। তবে আজ যে পোস্ত নিয়ে এত রসনাবিলাস,তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঔপনেবেশিক ভারতে কৃষিজীবীদের দুর্গতি, অদম্য মানসিকতা ও বেঁচে থাকার এক দুরন্ত ইতিহাস।
পুষ্টিগুণ...
নারায়াণা সুপার স্পেশ্যাল হাসপাতালের কনসালটেন্ট নিউট্রিশনিস্ট, রাখী চট্টোপাধ্যায় বললেন 'হালের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, পোস্তয় প্রচুর পরিমাণ ফাইবার রয়েছে। তা ছাড়া, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামের মতো মাইক্রো-মিনারেলের ভাঁড়ার এটি।' তাতে লাভ? রাখী জানালেন, ম্যাঙ্গানিজে ভরপুর পোস্ত 'অ্যান্টি ব্লাড-ক্লটিং' ফ্যাক্টর হিসেবে দারুণ কাজ করে। তা ছাড়া শরীর অ্যামাইনো অ্যাসিড বা ফ্যাটি অ্যাসিড কতটা ব্যবহার করতে পারবে, তাও অনেকটা ঠিক করে দেয় এটি। পাশাপাশি অত্যন্ত ভাল পরিমাণে ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স থাকে পোস্তর বীজে। এতেই শেষ নয়। রাখীর কথায়, 'যন্ত্রণা কমাতে যে তেল তৈরি করা হয়, তাও পোস্ত বীজ থেকে আসে। ত্বক বা চুলের পরিচর্যার জন্যও খুব ভাল এটি।' বাঙালির অন্যতম প্রিয় পদ মহিলাদের গর্ভধারণ ক্ষমতা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। তবে একটি বিষয় সাবধান করে দিচ্ছেন তিনি। পোস্তর পুষ্টি ও ঔষধিগুণ থাকার অর্থ এই নয় যে প্রত্যেক দিনই এটি খাবারের মেনুতে রাখতে হবে। বিশেষত, কিডনির রোগীদের জন্য এই খাবার থেকে দূরে থাকারই পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। বাকিদের ক্ষেত্রে, নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত পোস্ত-প্রেমই স্বাদ-স্বাস্থ্য়ের ভারসাম্য রাখতে পারে।
নানা রকম ভাবে...
সাধারণত, কাঁচা পোস্ত ঘণ্টাখানেক জলে ভিজিয়ে রেখে শিলনোড়ায় বেটে নেওয়ার সঙ্গে পরিচিত বাঙালি। এর ফলে যে মাখো-মাখো, দানাদার 'পেস্ট' তৈরি হয় সেটিই 'পোস্ট বাটা' বলে পরিচিত। এর সঙ্গে কাঁচা তেল, লঙ্কা কুচি সঙ্গে স্বাদমতো নুন মিশিয়ে খেতে পারেন। বেশ কিছু পদের সঙ্গে চাটনি বা 'ডিপ' হিসেবে জিভে জল এনে দেবে। আর আলু এবং কালো জিরের সঙ্গ মিশিয়ে দিলে তো অমৃত আলু পোস্ত রয়েছেই। তবে এপার-ওপার নির্বিশেষে আলু-পোস্তের স্বাদ আলাদা হতে পারে। রান্নার পদ্ধতিও পাল্টে যায়। শুধু আলু কেন? ঝিঙে-পোস্ত, পটল-পোস্ত ইত্যাদির মতো পদও বাঙালির হেঁশেলে দুরন্ত জনপ্রিয়। এছাড়া বড়ার কথা ভুলে গেলেন বুঝি? বিউলি না সোনামুগের ডাল দিয়ে নারকেল-পোস্তর বড়া আজও জামাই-আদরের অন্যতম 'প্রমাণ'।
শেষের দু'এক কথা...
এমন খাবারের কথা যে পলাশীর যুদ্ধের আগে ভারতবাসী জানতেন না, তা নয়। তবে মূলত ঔষধি হিসেবেই এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। মুঘল আমলে নেশার বস্তু হিসেবে এর খানিক পরিচয় ঘটলেও পোস্ত যে সাধারণ, প্রত্যেক দিনের খাবার থেকে শুরু করে রসনাতৃপ্তির উপাদান হয়ে উঠতে পারে, তা সম্ভবত জানা যায় ১৭৫৭ সালের পর। বাকিটা ইতিহাস, ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন:গরম দুধে একটুখানি হলুদ, এই হেলথ ড্রিঙ্কের জুড়ি মেলা ভার