সন্তানের কল্যাণে শরণাপন্ন হয়েছিলেন মহাদেবের, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মায়ের শিবঠাকুর
Ghure Asi Kamarpukur : শ্রাবণ মাস মানেই মহাদেবের মাস। এর পিছনে আছে নানা কাহিনি।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব (Sri Ramkrishna Paramhangso Deb) তখন দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মায়ের মন্দিরের পুরোহিত। রানি রাসমণির প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরে তিনি তাঁর লীলাভাবপ্রকাশ ও দিব্য আনন্দে মগ্ন। দক্ষিণেশ্বরের এহেন “পাগলা” ঠাকুরের কথা ইতিমধ্যে রটে গেছে রাজ্যময়। সত্যির থেকে গুজবই বেশি। সে সব গুজব ফুলে ফেঁপে পৌঁছয় কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মস্থানে। রামকৃষ্ণের মা চন্দ্রামণি দেবীর কানে আসে ছেলে গদাধরের নানা কথা। তিনি রটনা শোনেন যে, তাঁর গদাধর পাগল হয়ে গেছে। বুক কেঁপে ওঠে মায়ের। সন্তানের কল্যাণে শরণাপন্ন হন মহাদেবের। পুত্রের “উন্মাদনা” নিরাময়ের জন্য হত্যে দিয়েছিলেন গোপেশ্বর শিব মন্দিরে। তিন দিন তিন রাত। শোনা যায়, তারপর তিনি পান দৈব্য অভয়বাণী। গদাধর পাগল নয়, মা ভবতারিণীর (Maa Bhabotarini) দর্শনের জন্য আকুল। সেটাই তাঁর দিব্যভাব। নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন চন্দ্রামণি দেবী।
কামারপুকুরে (Kamarpukur) শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্মৃতি বিজড়িত শিব মন্দির এখনও রয়েছে। শ্রাবণ মাসে সেখানে ভক্তদের ঢল নামে শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য। কামারপুকুরে ঘুরে দেখার জন্য ভাড়া করা টোটোর চালক কাম গাইড জানায় গোপেশ্বর শিব মন্দিরের কথা। মন্দিরের গায়ে লাগানো বোর্ডেও অবশ্য লেখা রয়েছে সে কাহিনি। মন্দিরটি লাহাবাবুর দুর্গা মন্দিরের সামনে অবস্থিত। মন্দিরটি শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের বাড়ির পূর্ব দিকে অবস্থিত। রামকৃষ্ণ দেবের বাবাকে কামারপুকুরে বসতি স্থাপনে সাহায্য করেছিলেন সুখলাল গোস্বামী। তিনি একটি বৃহৎ শিবলিঙ্গ দিয়ে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরের ঠিক পিছনেই একটি পুকুর রয়েছে যেখান থেকে এই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে কামারপুকুর।
শ্রাবণ মাস মানেই মহাদেবের মাস। এর পিছনে আছে নানা কাহিনি। এক পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, শ্রাবণ মাসেই সমুদ্র মন্থনের ঘটনা ঘটেছিল। সমুদ্র উত্থিত হলাহল বিষ থেকে গোটা ধরিত্রীকে রক্ষা করার জন্য স্বয়ং মহাদেব তা নিজ কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। বিষের প্রভাবে মহাদেবের কন্ঠ নীল হয়ে ওঠে। এই কারণেই মহাদেবের অপর নাম নীলকণ্ঠ। বিষের তীব্রতা হ্রাস করার জন্য স্বর্গের দেবতারা শিবের মাথায় গঙ্গাজল ঢালতে থাকেন। সেই কারণেই শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় গঙ্গাজল প্রদান করা হয়। আর তাতেই আদিদেবের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন ভক্তরা।
আরেকটি কাহিনিতে উল্লেখ রয়েছে, সতীর দেহত্যাগের পর দেবী পার্বতী রূপে ফের একবার জন্ম নেন। শিবকে আবার স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করতে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে সাধনা করে শিবকে সন্তুষ্ট করলে পার্বতীকে বিবাহ করতে রাজি হন মহাদেব। আর সেই শুভমুহূর্ত ঘটে শ্রাবণ মাসেই। শিবরাত্রির দিনেই শিব-পার্বতীর পুনর্মিলন ঘটেছিল। এই কারণেই শ্রাবণ মাসকে শিবের মাস বলা হয়।
কিন্তু গোপেশ্বর শিব কে ? এহেন নামের কারণ কী ? সে কথা জানতে হলে পুরাণের পাতা ওল্টাতে হবে। একবার শিবঠাকুর গোপীদের সাথে রাসলীলায় অংশগ্রহণ করতে চাইলেন। কিন্তু রাসলীলা কৃষ্ণের অন্তরঙ্গ লীলা, যেখানে কেবল শুদ্ধভক্ত গোপীগণই অংশ নিতে পারেন। তাই যোগমায়ার কৃপায় শিব ঠাকুর একজন সুন্দরী গোপীর রূপ গ্রহণ করে রাসলীলায় প্রবেশ করেন। ভগবান শিব যখন এক সুন্দরী কুমারী রূপে গিয়েছিলেন, তখন তিনি গোপেশ্বর নামটি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁর নারী রূপ চিনতে পেরে শিবের নাম রাখেন গোপেশ্বর মহাদেব। তখন থেকে তিনি 'গোপেশ্বর শিব' নামে পরিচিত হন।
গোপেশ্বর মহাদেবের আদি মূর্তির বৃন্দাবনে অবস্থান এবং ব্রজধামের রক্ষাকর্তা হিসেবে পূজিত হন। বলা হয়, বৃন্দাবনে প্রবেশের আগে সকলকে গোপেশ্বর মহাদেবের কৃপা প্রার্থনা করা উচিত, কারণ তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ শুদ্ধভাবে ব্রজধামে প্রবেশ করতে পারেন না।
কামারপুকুরে অন্য আরেক শিব মন্দির হল প্রসন্নময়ীর শিব মন্দির। এই মন্দির ধর্মদাস লাহার কন্যা প্রসন্নময়ী প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মহাদেব পার্বতীনাথ নামে পূজিত হন। কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠে রয়েছে ঠাকুরের নিজস্ব বাসগৃহ ও যুগী শিব মন্দির। সে মন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে এক অলৌকিক কাহিনি। ঠাকুরের ঘরের উত্তর দিকে যুগী শিব মন্দির। একবার এই মন্দিরের সামনে ঠাকুরের মা চন্দ্রামণি দেবী ধাত্রী মা ধনী ঠাকুরাণীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, এমন সময় হঠাৎ শিবের মূর্তি থেকে একটি আলো আর্বিভূত হয় সেই আলোকে গোটা মন্দিরটি আলোকিত হয়ে ওঠে এবং আলোটি দ্রুত তাঁর শরীরে প্রবেশ করে। আশ্চর্যে, ভয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন, যখন তাঁর জ্ঞান আসে তখন তিনি অনুভব করেন সেই আলোটি তাঁর গর্ভে তখনও রয়েছে এবং তিনি গর্ভ ধারণ করেছেন। ফলস্বরূপ গদাধরের জন্ম।
কোথায় ঘুরবেন: কামারপুকুরে প্রথমে দেখে নিন কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠ। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের জন্মস্থানটিই এখন মূল মন্দির। সেখানে রয়েছে ঠাকুরের নিজের হাতে লাগানো আমগাছ, ঠাকুরের নিজস্ব বাসগৃহ, যুগী শিব মন্দির । রামকৃষ্ণ মঠ ছাড়াও বাইরে রয়েছে চিনু শাঁখারির বাড়ি, লাহাবাবুদের দুর্গা মন্দির, গদাধরের পাঠশালা, গোপেশ্বর শিব মন্দির, যুগীশিব মন্দির, হালদার পুকুর, বিষ্ণু মন্দির, কামারপুকুর, ধনী মাতার মন্দির, সীতানাথ পাইনের বাড়ি, লক্ষণ পাইনের বাড়ি। এগুলো সবই রামকৃষ্ণ মঠ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে। পায়ে হেঁটে বা টোটো ভাড়া করে এক ঘন্টার মধ্যে দেখে নেওয়া যায় সবগুলি।
খেয়াল থাকুক : মন্দিরের সকালের সময়সীমা মোটামুটি ৬:৩০- ১১:৩০। আবার বিকাল ৩:৩০ থেকে রাত ৮:৩০। মাস ভেদে সময় হেরফের হয়। এখানে ভোগ খাবার ব্যবস্থা আছে। সকাল ৯টা থেকে ১০:৩০ পর্যন্ত বিনামূল্যে ভোগের কুপন বিতরণ করা হয়। এর জন্য আলাদা কোনও টাকা লাগে না। তবে কেউ চাইলে আশ্রমে কিছু দান করতে পারেন। ভক্তদের ভোগ খাওয়ানো হয় ১২টা- ৩টে পর্যন্ত। কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠের ভিতর সর্বত্র ছবি তোলা, রিল বানানো, ইউটিউব ভিডিও করা বারণ আছে। বাইরে সেসব বাধা-নিষেধ নেই।
কোথায় থাকবেন : কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্ত আসেন। সীমিত সংখ্যক অতিথিশালা এবং ডরমিটরির ব্যবস্থা রয়েছে। ভক্তরা guesthouse@kamarpukurmath.org ইমেলের মাধ্যমে বুক করতে পারেন। এছাড়া কামারপুকুরে থাকতে গেলে মঠের কাছে রয়েছে অনেক ছোট বড় লজ এবং যাত্রীনিবাস।
কীভাবে যাবেন : ট্রেনে করে যেতে হলে কামারপুকুর ঘুরতে যাওয়ার সবথেকে কম খরচে আর সহজ উপায়- হাওড়া থেকে গোঘাট লোকাল ধরে গোঘাটে নামুন। টোটো, ভ্যান, অটো ধরলে সরাসরি কামারপুকুর মঠে পৌঁছে দেবে। গোঘাট পর্যন্ত ট্রেনের সংখ্যা কম তাই হাওড়া থেকে আরামবাগ লোকালে করে আরামবাগ স্টেশনে নেমে সেখান থেকে কামারপুকুরের অনেক বাস পাওয়া যায়।
বাসে করে যেতে চাইলে-কলকাতার ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন বেসরকারি এবং সরকারি (সি.এস.টি.সি / এস.বি.এস.টি.সি) বাস আছে কামারপুকুর যাওয়ার জন্য। এছাড়া আরামবাগ পৌঁছে সেখানে কামারপুকুরের অনেক বাস পাওয়া যায়। সড়ক পথে-কলকাতা থেকে কামারপুকুরের দূরত্ব ১০৫ কি.মি। প্রাইভেট বা ভাড়া গাড়িতে কামারপুকুর যেতে গেলে ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে।
ছবি-লেখক






















