Subrata Mukherjee: সুব্রত মুখোপাধ্যায় - এক বর্ণময় রাজনৈতিক জীবন
Subrata Mukherjee: শেষ হল জীবনের সঙ্গে লড়াই। সকলকে চির বিদায় জানালেন বঙ্গ রাজনীতির চিরসবুজ ব্যক্তিত্ব সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
কলকাতা: বঙ্গ রাজনীতিতে নক্ষত্র পতন। চলে গেলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় (Subrata Mukherjee)। ৭৫ বছর বয়সে এসএসকেএম মেডিক্যাল (SSKM) কলেজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi)প্রিয়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির স্নেহধন্য, সোমেন মিত্রর (Somen Mitra) সতীর্থ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) দলের বর্ষীয়ান নেতার মৃত্যুতে শোকের ছায়া রাজনৈতিক মহলে।
সুব্রত মুখোপাধ্যায় আদতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের সারেঙ্গাবাদের ছেলে। ৬-এর দশকে পড়তে এসেছিলেন কলকাতায়। অ্যানথ্রোপলজিতে Bsc নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বঙ্গবাসী কলেজে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিওলজি-তে মাস্টার্স। এরপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা মিউসিওলজি বা মিউজিয়াম স্টাডিজে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের কেউ কোনওদিন রাজনীতির ধারেকাছে ছিলেন না৷ বাবা ছিলেন শিক্ষক৷ বঙ্গবাসী কলেজে পড়তে এসে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে আলাপ৷ তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা গাঢ় হয়৷ সুব্রত মুখোপাধ্যায় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন, তখন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষের পথে৷
আরও পড়ুন, 'সুব্রতদার দেহ আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়', শোকবিহ্বল মমতা
সেই রাজ্যে নকশাল আন্দোলন শুরু হয়েছে৷ রাজনীতির উল্টো মেরুতে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ধীরে ধীরে তাঁরই ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে খাওয়া৷ সুব্রতর জীবনের মোড় ঘোরানো সময় এল ১৯৭১-এর বিধানসভা নির্বাচনে। বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে ওয়ার্কার্স পার্টির ২ বারের বিধায়ক জ্যোতিভূষণ ভট্টাচার্য হেরে গেলেন কংগ্রেসের নবাগত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। জীবনের প্রথম ভোট-যুদ্ধে বাজিমাৎ। পরের বছর আবার ভোট। আবারও জিতে বিধায়ক হলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বয়স তখন সবে পঁচিশ! সুব্রত মুখোপাধ্যায় হলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর মন্ত্রিসভার তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের প্রতিমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী। ততদিনে ইন্দিরা গান্ধীরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। জরুরি অবস্থার পরে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি দল ছাড়লেও৷ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গ ছাড়েননি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৭-এর নির্বাচনে দেশজুড়ে কংগ্রেস বিরোধিতার হাওয়ায় বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে হেরে গিয়েছিলেন সুব্রত। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন অর্থাৎ ১৯৮২ সালে বালিগঞ্জের বদলে জোড়াবাগান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন তিনি।
১৯৯৬ সাল অবধি জোড়াবাগান কেন্দ্রেরই বিধায়ক ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। প্রদেশ কংগ্রেস দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ২ বছর আগে ১৯৯৬-এর নির্বাচনে সুব্রত লড়লেন চৌরঙ্গি থেকে। আবার জয়।সালটা ছিল ১৯৯৯। ততদিনে কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেবছরই সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বা ILO-র মনোনয়ন দিতে চায়নি কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন INTUC। সেই দ্বন্দ্বের জেরে কংগ্রেস ছাড়েন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। যোগ দেন তৃণমূলে।
২০০০ সালে কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে বামেদের হারিয়ে দিল তৃণমূল। সুব্রত মুখোপাধ্যায় হলেন কলকাতার মেয়র। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথমবার তৃণমূলের টিকিটে চৌরঙ্গি কেন্দ্র থেকে জয়ী হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ২০০৪ সালে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রে সিপিএমের হেভিওয়েট সুধাংশু শীলের বিরুদ্ধে সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করল তৃণমূল। ওই কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ফল যা হওয়ার তাই হল, কংগ্রেস আর তৃণমূলের দুই হেভিওয়েটের ভোট কাটাকাটির লাভ পেলেন সিপিএম প্রার্থী। দেখতে দেখতে ২০০৫-এর কলকাতা পুরসভার নির্বাচন চলে এল। ঠিক সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতান্তরের জেরে তৃণমূল ছেড়ে শরদ পওয়ারের দল ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন সুব্রত।
আরও পড়ুন, সহকর্মী হিসেবে ওঁকে হারানো অপূরণীয় ক্ষতি, খুব ভেঙে পড়েছেন মমতাদি: ফিরহাদ হাকিম
তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস-সব বেশ কিছু ছোট দলকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল নতুন মঞ্চ। পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়ন মঞ্চ। যদিও নির্বাচনী ময়দানে সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি সেই মঞ্চ। ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে চৌরঙ্গী থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ফল হয় শোচনীয়। এরপর বাংলার রাজনীতি অন্য খাতে বইয়ে দেয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব। দেখতে দেখতে ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন। কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে বাঁকুড়া কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়ান সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু পোড় খাওয়া সিপিএম নেতা বাসুদেব আচারিয়ার কাছে তাঁকে হারতে হয়েছিল। ২০০৯-এর পরে আবার ২০১৯-এও বাঁকুড়া কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হন সুব্রত। কিন্তু, বাঁকুড়া এবারও তাঁকে খালি হাতেই ফেরায়।
২০১০-এ কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে ফিরেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পরের বছর বালিগঞ্জ কেন্দ্র থেকে জোড়াফুলের টিকিটে জয়ী হন তিনি। সেই থেকে আমৃত্যু বালিগঞ্জের বিধায়ক ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ২০১১-তে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে জনস্বাস্থ্য ও পঞ্চায়েত দফতরের মন্ত্রী হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সাফল্যের সঙ্গে সেই দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। সদাহাস্য এই রাজনীতিবিদের কেরিয়ার যতটা উজ্জ্বল, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিতর্কও। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রকাশ্যে আসে নারদ স্টিংকাণ্ড। তাতে নাম জড়ায় সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল বিপুল জয়ের পরে, গত ১৭ মে সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সহ তৃণমূলের ৩ হেভিওয়েটকে গ্রেফতার করে সিবিআই। পরে জামিন পান সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সহ অন্যরা।
এরপরও রাজনীতিতে সমান সক্রিয় ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। দুর্গাপুজোয় একডালিয়া এভারগ্রিনের দুর্গাপুজোর দায়িত্বও সামলেছেন সমান উৎসাহ নিয়ে। কিন্তু দীপাবলির আগের সপ্তাহেই হঠাৎ শরীর খারাপ। গত ররিবার এসএসকেএমে চেক আপ করাতে গিয়ে আরও অসুস্থ বোধ করেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁকে ভর্তি করা হয় এসএসকেএমে। একসপ্তাহ ধরে ICCU-তে কাটানোর পরে শেষ হল জীবনের সঙ্গে লড়াই। সকলকে চির বিদায় জানালেন বঙ্গ রাজনীতির চিরসবুজ ব্যক্তিত্ব সুব্রত মুখোপাধ্যায়।