উমপুন-পরবর্তী কলকাতায় স্রেফ সবুজায়নই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা, নকশার
কীভাবে বাঁচবে সিটি অব জয়?
কলকাতা: নগরায়নের খেসারতই দিতে হচ্ছে কলকাতাকে। উঁচু উঁচু ইমারত আর আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ের ভার বইতে বইতে জব চার্নক ‘আবিষ্কৃত’ কলকাতা আজ ক্লান্ত। বেড়েছে বাড়ি, গাড়ি। মানুষ তার প্রয়োজনে শাখাপ্রশাখার মতো বাড়িয়েছে জনপথ। তবে দুশো বর্গ কিলোমিটার এই শহর থেকে গিয়েছে একই। যদিও মহানগরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে উপনগরী তবে কলকাতার ওপর থেকে চাপ বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই চাপ আরও বেড়েছে। যার ‘শাস্তি’ই হয়ত পেল তিন শতাধিক প্রাচীন এই শহর।
গত ২০মে ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার ঘূর্ণিঝড় উমপুন কলকাতাকে তছনছ করে দিয়ে চলে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বলেছিলেন, “সর্বনাশ করে দিয়ে চলে গেল।” কলকাতার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম অন্তত সাড়ে ৫ হাজার গাছের ধ্বংস হওয়ার কথা জানিয়েছেন। প্রাথমিক কারণ হিসেবে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি, তার আঘাত করার ক্ষমতাকে দায়ী করা হলেও মহানগরের ওপর এই ক্ষত তৈরির নেপথ্যে রয়েছে আরও গভীর কারণ।
উমপুনের তাণ্ডবের পর কলকাতার ছবি। (ট্যুইটার)পাতাল রেল। জলের পাইপ। গুচ্ছ গুচ্ছ তার। সব মিলিয়ে কলকাতার ভূগর্ভে গাছের শিকড় ক্রমশ জোর হারিয়েছে। সে কারণেই ঝড়ের প্রাবল্যে বেসামাল হয়েছে রাধাডূড়া, কৃষ্ণডূড়া, শিমুল, পলাশ, বট, অশ্বত্থ। নারকেল, তালের মতো লম্বা গাছ দাঁড়িয়ে থাকলেও একাধিক জায়গায় লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে আম, জাম, কাঠালের মতো শক্তপোক্ত গুঁড়িওয়ালা গাছও। আশঙ্কা, আগামীতে আরও এমন ঝড়ঝাপটা শহরটার ওপর দিয়ে বইবে। এখন প্রশ্ন এক উমপুনেই তো কলকাতা ‘রক্তাক্ত’, এরপর কী হবে? কীভাবে বাঁচবে সিটি অব জয়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার সময় এসেছে বিচার করে দেখার, কলকাতা কি আর ভার বইতে পারবে? এত গাছ ধ্বংস হওয়ায় অক্সিজেনের পরিমাণ কমবে। শহরে বাড়বে কার্বন ডাই অক্সাইড। এতে আবহাওয়ারও পরিবর্তন হবে। উষ্ণতা বাড়বে শহরের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ প্রযুক্তি বিভাগের (কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রধান ডঃ পার্থপ্রতিম বিশ্বাসের পরামর্শ, “সবার প্রথম প্রয়োজন বৃক্ষরোপন। বড় রাস্তায় এক ধরনের গাছ, এবং তুলনামূলক সরু ও ছোট রাস্তায় অন্য রকমের গাছ লাগাতে হবে। পার্কের ক্ষেত্রে রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো যেতে পারে।” শুধু গাছ লাগালেই হবে না, গাছের পরিচর্যা এবং হিসেবনিকেশও রাখতে হবে। দরকারে ব্যবহার করতে হবে স্যাটেলাইট ইমেজ। কোন রাস্তায় কী কী গাছ, কত পরিমাণে রয়েছে এবং তার ঘনত্ব কত, একেবারে অঙ্কের মতে ছকে নেওয়ার কথাই বলেছেন অধ্যাপক বিশ্বাস।
উমপুনের তাণ্ডবের পর কলকাতা বিমানবন্দরের ছবি। (ট্যুইটার)দ্বিতীয় কলকাতার বিপজ্জনক বাড়িগুলোর পুনঃসংস্কার করা এবং নতুন করে বাড়ি কিংবা আকাশছোঁয়া ইমারত নির্মাণের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অধ্যাপক বিশ্বাসের কথায়, “আমাদের শহর আর ভার বইতে পারবে কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে।” শহরের পরিধি বাড়িয়ে রাজারহাটের মতো উপনগরী তৈরির কথাও বলেছেন তিনি।
প্ল্যানারদের তাঁর পরামর্শ, আগামীতে বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে নকশায় যেন সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। বহুতলের কাঠামোর সঙ্গে স্থায়িত্বের জন্য পোক্ত বন্দোবস্তের প্রতিই বেশি জোর দিয়েছেন তিনি। ঝড়ের গতি যত বাড়ে, অভিঘাত বাড়ে স্কোয়্যার অনুযায়ী। সুতরাং, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা, নকশা তৈরির ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দিলে আগামীতে এমন ধাক্কা থেকে কলকাতা খানিকটা বাঁচতে পারে বলেই মত অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাসের।