Vaibhav Suryavanshi: বিশ্বরেকর্ড ভাঙবে, কথা দিয়েছিল কোচকে, IPL- এ ইতিহাসগড়া বৈভবের ধ্যান-জ্ঞান ব্যাটিং আর চিকেন!
IPL Auction 2025: নিলামে বৈভব সূর্যবংশীর হয়ে দিল্লি ক্যাপিটালস প্রথম দর হাঁকালেও, তাকে শেষমেশ দলে নেয় রাজস্থান রয়্যালস। ঘটনাক্রমে আইপিএলের আগে এই দুই দলের ট্রায়ালেই নজর কাড়ে তরুণ ব্যাটার।
কলকাতা: বিহারের বাঁ-হাতি ব্যাটার, বেস প্রাইস ৩০ লক্ষ, নাম বৈভব সূর্যবংশী (Vaibhav Suryavanshi)। নিলামে নাম ওঠা মাত্রই দর হাঁকাহাঁকি শুরু। শুরুটা করল দিল্লি ক্যাপিটালস। তবে শেষমেশ এক কোটি ১০ লক্ষ টাকায় তাকে দলে নিল রাজস্থান রয়্যালস (Rajasthan Royals)। আইপিএল নিলামে (IPL Auction 2025) এমনিতেই কোটি কোটি টাকার দর উঠে। সেই অর্থে এক কোটি ১০ লক্ষ, কী এমন দাম? তাহলে কেন এই খেলোয়াড়কে কেনা নিয়ে এত হইচই? কারণ লুকিয়ে তার বয়সে। মাত্র ১৩ বছরের একটি ছেলে। এখনও স্কুলের গণ্ডিও পেরোয়নি। সেই বৈভবই কি না কোটি টাকার দর পেল! মেগা টুর্নামেন্টের মঞ্চে মিচেল স্টার্কের ঝাঁঝালো বাউন্সার, যশপ্রীত বুমরার বুলেট ইয়র্কারের মোকাবিলা করবে সে!
'যত্র প্রতিভা অভসরা প্রাপন্তিহি', অর্থাৎ যেখানে প্রতিভা নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পায়। আইপিএল-এর ট্রফির গায়ে এই শব্দবন্ধই লেখা থাকে। বৈভব প্রকৃত অর্থেই একজন প্রতিভাবান। মাত্র ১৩ বছরে বয়সে ক্রিকেটের দুনিয়ায় শোরগোল ফেলে দিয়েছে। তবে এই হিরের টুকরোকে ঘষামাজা করে যাঁরা সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন, তাঁরা হলেন বৈভবের দুই কোচ সৌরভ কুমার ও মণীশ ওঝা। সৌরভ যেখানে বৈভবকে মানসিকভাবে ভাবে শক্তি জুগিয়েছেন, বিভিন্ন ম্যাচ পরিস্থিতি কেমন খেলতে হবে- সেই নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তেমনই মণীশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাঁ-হাতি ব্যাটারের স্টান্স ঠিক করা, তার টেকনিকে ছোটখাটো রদবদল করা নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এবিপি লাইভের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় সৌরভ জানালেন, প্রতিভাবান কিশোর থেকে আইপিএল-এর সর্বকালের কনিষ্ঠ ক্রিকেটার হয়ে ওঠা বৈভবের ব্য়াটিংয়ের প্রতি ভালবাসার গল্প।
'ওয়ান্ডারবয়'-র রেকর্ডের ঝুলি
চলতি বছরের শুরুতেই বিহারের হয়ে মাত্র ১২ বছর ২৮৪ দিন বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে বৈভবের। এর পরে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার অনূ্র্ধ্ব ১৯ ইয়ুথ টেস্ট সিরিজ় থেকে নামডাক আরও বাড়ে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আয়োজিত ওই সিরিজ়ের প্রথম টেস্টে মাত্র ৫৮ বলে সেঞ্চুরি হাঁকান বৈভব, ভারতের হয়ে ইয়ুথ টেস্টে দ্রুততম শতরান ছিল সেটি। তার ইনিংস সাজানো ছিল ১৪টি চার ও চারটি ছক্কায়। পেশাদার ক্রিকেটে তিনিই কনিষ্ঠতম সেঞ্চুরিয়ন। এক্ষেত্রে নাজমুল হোসেন শান্তর রেকর্ড ভাঙেন বৈভব।
এই ধরনের প্রতিভাদের জন্য ইংরেজি অভিধানে একটি শব্দ রয়েছে 'ওয়ান্ডারবয়'। বৈভব এবং ওই উপমা এখন পরস্পরের সমার্থক। এ ধরনের প্রতিভা সচরাচর দেখা যায় না। তবে বৈভব এই অল্প বয়সে ইতিহাস গড়লেও, তাঁর কোচ সৌরভ কুমার জানান, শিষ্যের পছন্দ, খাওয়া দাওয়া কিন্তু তার বয়সি আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতোই। না বাড়তি শরীরচর্চা, না বিশেষ ধরনের কোনও ডায়েট মানে বৈভব। সৌরভ বলেন, 'বৈভব আলাদা কিছু করে না। এখনও তো একদমই ছোট ও। খেতে ভালবাসে, ভাত-মাংস খুব পছন্দের। আর পছন্দ ব্যাটিং। ব্যস এইটুকু ওর জীবন।'
সৌরভের এখনও স্পষ্ট মনে আছে বৈভবের শুরুর দিনগুলি। ছোট্ট বৈভব কেরিয়ারের একেবারে শুরুর দিক থেকেই বয়স বড় বোলারদের বিরুদ্ধে ব্যাটিং করত। তবে বিশেষ দু'টি ঘটনার কথা সৌরভ তুলে ধরেন। জানান, ওই ঘটনা দু'টি চাক্ষুষ করার পরেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন সামনে এক বিশেষ প্রতিভা দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'বৈভব যখন এসছিল তখন কত বয়স হবে ওর, ন'বছর হয়ত। ছ'নম্বর ব্য়াট ব্যবহার করত। স্টাম্পের উচ্চতার থেকে হয়তো সামান্য একটু লম্বা ছিল ও। সেই সময় আমাদের নেটে আদর্শ সিংহ নামে একজন বোলার ছিল। বিহারের অনূর্ধ্ব ১৬ খেলে ফেলেছিল এবং বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে নীতীশ রেড্ডিকেও (২০১৭-১৮ সালে বিসিসিআইয়ের সেরা অনূর্ধ্ব ১৬ ক্রিকেটার) আউট করেছিল আদর্শ। মিস্ট্রি স্পিনার হিসাবে বেশ নামডাকও ছিল। বৈভব ওকে একেবারে অনায়াসেই খেলছিল। কোনও রকম সমস্যা হয়নি ওর বল পিক করতে। আমি তো অবাক হয়ে যাই।'
ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তায় যায় চেনা
সৌরভ আরও বলেন, 'আরও একটা ঘটনা আমার এখনও মনে আছে। একদিন আমাদের অ্যাকাডেমিতে অনুশীলনে মিডল পিচে ব্য়াটিং অনুশীলন হচ্ছিল। রাজ্যস্তরে খেলা অনেকেই অনুশীলনে এসেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে বৈভব ব্যাটিং করতে নেমেছিল। ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে মিডল স্টাম্প গার্ড নেয় ও। আমি তখন আম্পায়ারের জায়গা দাঁড়িয়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করি, মিডল স্টাম্প গার্ড কেন? ও বলেছিল, 'আমি তো ছোট, আমার উচ্চতা কম। মিডল স্টাম্প গার্ড না নিলে বল অবধি পৌঁছতে পারব না'। মাত্র ১০ বছরের একটা বাচ্চার মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে এই বিচক্ষণতা কিন্তু দেখা যায় না। এই ঘটনাগুলি ওকে বাকিদের থেকে পৃথক করে। আর বিশ্বাস করুন ওর টাইমিংটা অসামান্য। আমি তিলক বর্মা, নীতীশ রেড্ডিদের ছোটবেলায় খেলতে দেখেছি। কিন্তু বৈভবের টাইমিং, ওর ব্যাটিং স্যুইংটা একেবারে ভিন্ন স্তরের।'
কিন্তু ইতিহাস গড়া বৈভবকে নিয়ে বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক জায়গায় বিভিন্ন মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। এই বিষয়টা শুনেই সৌরভ অত্যন্ত শান্ত গলায় জবাব দিলেন, 'হ্যাঁ, সেসব তো অভিযোগ উঠেছেই। কিন্তু এই নিয়ে তো কোনও সমস্যার কিছু নেই! ওর বাবা তো সকলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, যার সন্দেহ রয়েছে সে আসুক, আমরা তো পরীক্ষা করাতে তৈরিই রয়েছি। ও তো এর আগে পরীক্ষা দিয়েছেও। আর বিসিসিআই তো বয়স নির্ধারণ করতে সর্বোচ্চ মানের TW3 পরীক্ষা করে থাকে। সেখানে বৈভবের বয়স নিয়ে কোনও সমস্যা ধরা পড়েনি। প্রয়োজনে আবারও পরীক্ষা দেবে ও, কী আছে।'
ব্যাটিংই ধ্যান-জ্ঞান
তবে এত কম বয়সে এত টাকা, আইপিএল-এর জাঁকজমক। তরুণ বিরাট কোহলিকেও এইসব বিষয়গুলি কিছু সময়ের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট করেছিল। বৈভবের ক্ষেত্রে বয়সটা আরও কম। তাই উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। যদিও সেই নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ দেখছেন না সৌরভ। তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব, 'বৈভব অত্যন্ত সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছে। এখনও পর্যন্ত সবটা তো ওর বাবাই দেখেন। বিশ্বাস করুন, একটু খেতে পছন্দ করে ছেলেটা। চিকেন আর ভাত ওর প্রিয়, ব্যাটিং ওর ধ্যানজ্ঞান। বাকি কিছুর প্রতি কোনও আগ্রহই নেই। না সোশ্যাল মিডিয়ায় আছে, না অন্য কিছু পছন্দ। আইপিএল-এ ইতিহাস তৈরির পরেও বৈভব নিজে কিন্তু একটাও সাক্ষাৎকার দেয়নি। জাঁকজমকের আড়ালেই থাকতে পছন্দ করে ও। আর রাজস্থানে তো কুমার সাঙ্গাকারা, রাহুল দ্রাবিড়ের মতো কিংবদন্তিরা রয়েছেন। বৈভবের উন্নতির জন্য, ওকে পথ দেখানোর জন্য ওঁদের থেকে ভাল রোলমডেল, মেন্টর হতেই পারে না।'
পেশাদার ক্রিকেটে কনিষ্ঠতম শতরান, রঞ্জি অভিষেক, আইপিএলে ঐতিহাসিক চুক্তি পাওয়া, সবটাই হয়েছে। সামনে বৈভবের লক্ষ্যটা ঠিক কী? সচিন তেন্ডুলকরের ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকের রেকর্ড ভেঙেছেন। এবার কি লক্ষ্য তবে 'মাস্টার ব্লাস্টার'-এর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের রেকর্ড ভাঙা? বৈভবের কোচ বলেন, 'পেশাদার ক্রিকেটে কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসাবে সেঞ্চুরিটা হয়ে গিয়েছে। এই বিষয়ে আমি যখন ওকে বলেছিলাম, ওর বয়স ছিল ওই ১০ বছর মতো। তখন আমায় বলেছিল, তিন বছরের মধ্যে সেঞ্চুরি করবে ও। দু'বছরেই সেই কাজ সম্পূর্ণ করেছে। আমার সঙ্গে রঞ্জি অভিষেকের পরেও ওর কথা হয়েছে। আমি ওকে বারংবার মনে করাই যে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কিন্তু ওর সেঞ্চুরি করা হয়নি। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে চলতে হবে। মন দিয়ে খেলতে হবে। আর ব্যাটিং করাটা বরাবরই ওর পছন্দের। সেই পছন্দের কাজটাই করে যেতে হবে।'
বৈভবের এই উন্নতি বিহার ক্রিকেটের উন্নতিতেও সাহায্য করবে বলে আশাবাদী সৌরভ। তাঁর আশা, ছাত্রের হাত ধরেই বিহারের ক্রিকেট ভারতবর্ষের মানচিত্রে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। সংস্থার সভাপতিও যে এই বিষয়ে সবসময়ই বৈভবের পাশে থাকছেন, তাঁকে অনুপ্রাণিত করছেন, সেই কথাও জানান সৌরভ। এবার অপেক্ষা আইপিএল শুরুর। কিশোর বৈভব আইপিএল-এ ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে কি না, সেটা সময়ই বলবে। তবে সে যে নিজের স্বপ্নপূরণের দিকে অনেকটাই এগিে গিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন: জনপ্রিয়তা বাড়াতে অপরিহার্য শাহরুখ খান, IPL-র সঙ্গে 'কিং খান'-কে জুড়তে মরিয়া ছিলেন মোদি!