Tokyo Paralympic 2020: হাত নেই বলে লোকে হাসাহাসি করত, দেশকে গর্বিত করার শপথ নতুন কোহলির
বয়স আঠেরো। সুন্দর, ছিমছাম চেহারা। মুখে অমলিন হাসি। ব্যাডমিন্টন কোর্টে রীতিমতো দাপট দেখান।
কলকাতা: বয়স আঠেরো। সুন্দর, ছিমছাম চেহারা। মুখে অমলিন হাসি। ব্যাডমিন্টন কোর্টে রীতিমতো দাপট দেখান।
তবে চমকটা অন্য জায়গায়। তরুণীর বাঁহাত কনুইয়ের নীচ থেকে নেই। জন্মের সময়ই যে শারীরিক ত্রুটি সঙ্গী হয়েছিল। বিশেষভাবে সক্ষম ক্রীড়াবিদ আচমকাই প্রচারের আলোয়। ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছেন।
কে এই তরুণী? কেনই বা তাঁর সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা? আসুন আলাপ করিয়ে দেওয়া যাক। নাম, পলক কোহলি। বিরাট কোহলি যখন তাঁর ব্যাটের শাসনে ক্রিকেটবিশ্বে একের পর এক কোহিনূর জিতে চলেছেন, তখন ভারতীয় খেলাধুলোর জগতে খ্যাতির শিখর বেয়ে ওপরের দিকে আসছে আর এক কোহলির নাম। তিনি, পলক কোহলি। জলন্ধরের কন্যা প্যারালিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। প্যারাব্যাডমিন্টনে সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে প্যারালিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করে ইতিহাস লিখে ফেলেছেন অষ্টাদশী। পাশাপাশি ভারতের প্রথম ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার হিসাবে প্যারালিম্পিক্সের যোগ্যতা পেয়েছেন।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে ব্যাডমিন্টন কোর্টে প্রবেশ কীভাবে? এবিপি লাইভকে পলক বললেন, 'আমি কখনওই ব্য়াডমিন্টন বা অন্যান্য কোনও খেলাকে পেশা হিসাবে বেছে নেব বা নিজের পরিচিতি তৈরি করব, ভাবিনি। ব্যাডমিন্টনে আসার নেপথ্যে রয়েছে একটি ছোট্ট ঘটনা। যে ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। একদিন পরিবারের সঙ্গে একটি শপিং মলে গিয়েছিলাম। সেখানে এক ভদ্রলোক আমাকে দেখে এগিয়ে আসেন। জানতে চান, আমার হাতের এই অবস্থা কী করে হল। রাস্তাঘাটে এই ধরনের প্রশ্নের সঙ্গে ততদিনে আমি বেশ পরিচিত। জানালাম যে, এটা আমার জন্মগত ত্রুটি। উনি জানতে চাইলেন প্যারা-গেমসের কথা আমরা কেউ শুনেছি কি না। আমরা কেউই শব্দটা শুনিনি। ওই ভদ্রলোক তখন বলেছিলেন যে, আমার প্যারা ব্যাডমিন্টন খেলার অন্তত একবার চেষ্টা করা উচিত। ওই ভদ্রলোক নিজের ফোন নম্বর দিয়ে চলে যান।'
তারপর? পলক যোগ করলেন, 'আমরা বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। কারণ আমার হাতের অবস্থা দেখে অনেকেই প্রশ্ন করত। অভ্যস্ত ছিলাম। এরপর একদিন স্কুলে হ্যান্ডবলের ট্রায়াল ছিল। কিন্তু আমার শিক্ষকেরা বলেছিলেন, খেলাধুলো না করে পড়াশোনায় মন দিতে এবং বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য যে সংরক্ষিত আসন থাকে, সেটা কাজে লাগিয়ে চাকরির চেষ্টা করতে। সেদিনের আগে পর্যন্ত কখনও হীনমন্যতা আমাকে গ্রাস করেনি। আর ঠিক তখনই ওই আগন্তুকের কথা মনে পড়ে। প্যারা ব্যাডমিন্টন খেলব বলে মনঃস্থির করি।'
এরপরও অবশ্য বাড়িতে লড়াই করতে হয়েছিল পলককে। অভিভাবকদের বুঝিয়ে রাজি করাতে। 'বাবা-মা আমার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য অনেক বোঝানোর পর আমার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। ততদিনে ওই ভদ্রলোকের ফোন নম্বর হারিয়ে ফেলেছিলাম। ইন্টারনেট ঘেঁটে ওঁর নম্বর জোগাড় করি। জানতে পারি, উনি জাতীয় প্যারালিম্পিক্স ব্যাডমিন্টন দলের কোচ গৌরব খন্না। ওঁর সঙ্গে কথা বলে লখনউ যাই। সেখানেই প্যারা ব্যাডমিন্টনের জাতীয় শিবির চলছিল। মাত্র দু বছরের মধ্যে খেলাটাকে রপ্ত করে নিই। প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েই সেরা হই,' বলছিলেন পলক।
পলক যোগ করলেন, 'যখন লখনউ যাচ্ছিলাম, মনে তোলপাড় হয়েছিল। ব্যাডমিন্টনের কিছুই জানতাম না। নিজের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। কারণ, ছোট থেকে যেখানেই যেতাম, বলা হতো খেলাধুলো আমার জন্য নয়। কিছু খেলতে গেলেই শুনতে হতো যে, আমার খেলাধুলো করা উচিত নয় এবং নিজেকে নিয়ে সতর্ক থাকা উচিত। মনে হতো আমি সত্যিই হয়তো সযত্নে রাখার মতোই। তবে লখনউ যাওয়ার পথে ইতিবাচক চিন্তাভাবনাও করেছিলাম। ভেবেছিলাম, একবার চেষ্টা করে তো দেখি।'
লখনউ পৌঁছে অবশ্য নিজের মতো আরও ক্রীড়াবিদদের দেখে আত্মবিশ্বাস বাড়ে পলকের। তাঁর কথায়. 'ওখানে গিয়ে দেখলাম, আমারই মতো শারীরিক ত্রুটি থাকলেও অর্চনা, প্রমোদ, মনোজ, পারুল-রা কোর্টে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, দেশকে সম্মান এনে দিচ্ছে। তারপর থেকে আত্মবিশ্বাস বাড়তে শুরু করে।'
লোকের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হজম করতে হয়েছে। পলক বলছেন, 'একটা সময় লোকে আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত। অনেকেই সহানুভূতি দেখাত। শারীরিক অক্ষমতার জন্য অনেকে আমাকে এড়িয়ে যেত বা কিছু ক্ষেত্রে আমাকে বয়কট করত। সবাই ধরেই নিত যে, আমি কিছু পারব না। তাই কিছু করার সুযোগও দিত না। বিশেষভাবে সক্ষম সকলকেই এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। শারীরিক অক্ষমতার জন্য শৈশবে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে।'
শুরুতে সকলের গঞ্জনা সহ্য করতে হতো। পরে অবশ্য ছবিটি বদলে যায়। পলক বলছেন, 'প্রথম প্রথম সকলে যখন বলত খেলাধুলো আমার জন্য নয়, আমার আত্মবিশ্বাস ধাক্কা খেত বৈকি! পরে অবশ্য নিজের ওপর বিশ্বাস পোক্ত হয়। গৌরব স্যার আমাকে নতুন পথ দেখিয়েছেন। আজ আমি যা, সবই ওঁর জন্য। আমি খুশি, উত্তেজিত আর গর্বিত নিজের শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে। বিশেষভাবে সক্ষম হওয়ার জন্যই আমি আজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছি। আমার অনেক কিছু প্রমাণ করার ছিল। বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি কী পারি। বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।'
সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে টোকিও প্যারালিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করে উচ্ছ্বসিত পলক। বলছেন, 'অলিম্পিক্স বা প্য়ারালিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা যে কোনও ক্রীড়াবিদের স্বপ্ন থাকে। প্যারালিম্পিক্সে এই প্রথম ব্যাডমিন্টন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর প্রথমবারই খেলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। প্যারালিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করে তিনটি নজির তৈরি করেছি। কী যে আনন্দ হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না। দেশকে গর্ব করার মতো মুহূর্ত উপহার দিতে চাই। তার জন্য নিজের সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপাব।'
নিজেকে মানসিকভাবে তরতাজা রাখার জন্য সিনেমা দেখেন, গান শোনেন পলক। কী ধরনের সিনেমা? পলক বলছেন, 'আত্মজীবনীর ওপর নির্মিত সিনেমা দেখি। বিখ্যাত অ্য়াথলিটদের তৈরি করা দৃষ্টান্তগুলি দেখি, জানি। এর থেকে অনুপ্রেরণা পাই। কোচের সঙ্গে কথা বলে নিজের দুর্বলতাগুলি জেনে নিয়েছি এবং সেগুলি দূর করার জন্য পরিশ্রম করছি।' সম্প্রতি তাঁর পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারের দায়িত্ব নিয়েছে মাইপ্রোটিন নামক একটি সংস্থা।
শুধু অলিম্পিক্স নয়, প্যারালিম্পিক্সেও টোকিও থেকে সোনার পদকের আশায় ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা।