ফুটবলে আসলে আমার একজন নয়, দু’জন মহাপ্রতিদ্বন্দ্বী। যখন খেলতাম সেই সময় চুনী গোস্বামী। আর তিন দশকের কোচিং জীবনে অমল দত্ত। বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের বড়। সে জন্য বরাবর ‘অমলদা’ ডাকতাম। অনেকেই হয়তো জানেন না, উনিশশো চুয়ান্নয় আমরা দু’জন একসঙ্গে এরিয়ানে খেলেছি। লেফট হাফ পজিশনে ইংলিশ ফুটবল স্টাইলে খেলতেন। কিন্তু গতি খুব কম ছিল। সে জন্য হয়তো একবারের বেশি (সেই সময়কার রেঙ্গুনে কোয়াড্রাঙ্গুলার  টুর্নামেন্ট) ভারতীয় দলে সুযোগ পাননি। ময়দানে ওঁর প্রভাবের প্রায় পুরোটাই কোচ হিসেবে। যথেষ্ট উঁচু মানের কোচ। ফুটবলবিদগ্ধ মানুষ বলতে যা বোঝায় একেবারে তাই-ই। আজ লিখিত ভাবে বলছি, অমলদার কোচিংকে আমি বরাবর শ্রদ্ধার চোখে দেখে এসেছি। তাই আনন্দবাজারের সাংবাদিকের থেকে যখন প্রথম দুঃসংবাদটা পেলাম, এক মুহূর্তের জন্য কেমন যেন আমার হাঁটাচলার শক্তি চলে গিয়েছিল! মনে পড়ছে অসুস্থ অমলদাকে যে দিন বাড়িতে দেখতে গেলাম, আমার হাত ধরে শুধু হেসেছিলেন। কোনও কথা বলতে পারেননি। ভাবতেই পারছিলাম না, এই মানুষটাই কিনা আমার কোচিং জীবনে তিন দশকেরও বেশি ছিলেন সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। আমাদের দু’জনের কোচিং-যুদ্ধ সবই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে। কখনও আমি মোহনবাগানে, অমলদা ইস্টবেঙ্গলে। কখনও আবার ঠিক উল্টো। কিন্তু যত দূর মনে হয়, আমিই নব্বই ভাগ ম্যাচ জিতেছি। আমার টিমের বিরুদ্ধে অমলদার দলের তেমন বড় জয় সাতাত্তরে লিগ ম্যাচ ছাড়া আর বিশেষ তো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সেই ম্যাচেও যদি হাবিব অমন সিটার নষ্ট না করে বসত, তা হলে শেষমেশ কী স্কোরলাইন দাঁড়াত তা নিয়ে আমার এত বছর পরেও সন্দেহ আছে। সাতানব্বইয়ে অমলদার ডায়মন্ড সিস্টেমে মোহনবাগানকে খেলানোর মরসুমে তাঁর টিমের প্রথম বার আমার ইস্টবেঙ্গলের সামনে পড়া ফেড কাপ সেমিফাইনালে। ভাইচুংয়ের হ্যাটট্রিকে আমার দল ৪-১ হারিয়েছিল অমলদার দলকে। ময়দানের মোরিনহো আমাকে কিন্তু বেশি হারাতে পারেননি আসলে সত্তর দশক থেকে ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে ‘পিকে বনাম অমল’ অন্য সব কোচেদের মধ্যে লড়াইয়ের তুলনায় অন্য মাত্রা পেয়েছিল। শুধু ব়ড় ক্লাবের দায়িত্ব বদলাবদলি হয়ে যেত। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের একটায় আমি আর অন্যটায় অমলদা কোচ, এ রকম ছয়-আট বার ঘটেছে। আসলে আমি মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল কোচ হলে অন্য দলটা ভাবত, আমার দলকে আটকাতে পারেন একমাত্র অমল দত্ত। আবার অমলদা একটা বড় ক্লাবের দায়িত্ব নিলে অন্য বড় ক্লাবটা ভাবত, ওঁর টিমকে একমাত্র আমিই হারাতে পারি। সেই ডায়মন্ড ম্যাচের যা প্রচণ্ড হাইপ উঠেছিল, একমাত্র তুলনা আসতে পারে ছিয়াত্তরের লিগে বড় ম্যাচ। সে বারই আমি ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানের দায়িত্ব নেওয়ায় অমলদাকে কোচ করেছিল ওরা। ডায়মন্ড ম্যাচ দেখতে সল্টলেক স্টেডিয়ামে এক লাখ তিরিশ হাজার দর্শক এসেছিলেন। যেটা সেই সময় এশিয়ান রেকর্ড। আমাদের কোচিং-লড়াই এতটাই ছিল যে, একবার বড় ম্যাচে তাঁর টিমের তারকা ফুটবলার আমার দলের বেঞ্চের সামনে ট্যাকলের ধাক্কায় পড়ে চোট পেয়ে কাতরাচ্ছে দেখে আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই প্লেয়ারকে সাহায্য করতে গেলে অমলদা ছুটে এসে আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। ডায়মন্ডের বছরে আমার টিমের ভাইচুংকে ‘চুং-চুং’, সোসোকে ‘শশা’, ওমোলোকে ‘অমলেট’ বলে বাজার গরম করে তুলেছিলেন অমলদা। তখন খারাপ লাগলেও আজ মনে হচ্ছে, এ জন্যই উনি অমল দত্ত। ভারতীয় ক্লাব ফুটবলের যেন মোরিনহো! নিজের কোচিং প্রতিভা আর প্রতিদ্বন্দ্বী কোচকে অপমান করার অদ্ভুত সহাবস্থান যাঁর ভেতর।