এক্সপ্লোর

বিনয়-বাদলের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে, ইংরেজ শাসককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন মায়ের ‘প্রিয় নসু’

Dinesh Gupta : মৃত্যুকে তাঁর দৃঢ় চরিত্রের জোরে হেলায় হারিয়েছিলেন দীনেশ।

কলকাতা : “...নসু, বলি দেখে কেঁদে ভাসিয়ে দিত।” ভাইয়ের ছোটবেলা নিয়ে লিখেছিলেন ছোটদিদি কমলা। সেই ভাই, বড় হয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন ইংরেজ শাসককে। সেই ভাই, পরাধীন ভারতে স্বাধীন সূর্যের স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন হাজার-হাজার চোখে। স্বাধীন ভারত যখন আরেক স্বাধীনতা উদযাপনে উচ্ছ্বসিত, তখন ভারত-মায়ের আরেক দামাল ছেলে দীনেশের বীরত্বের ঝলক, আত্ম বলিদান  ফিরে দেখা আরেকবার। দীনেশ গুপ্ত। তিনিই মায়ের প্রিয় নসু।

বয়স কতই বা হবে তখন। বারো কি তেরো। স্কুলে পড়ার সময়ই বিপ্লবী-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন দীনেশ গুপ্ত। গোটা দেশে চলছে দমনপীড়ন। অবিভক্ত বাংলার ঢাকাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। চলছে ইংরেজ শাসকের অত্যাচার। বিপ্লবীরাও সিদ্ধান্ত নিলেন…”তোমরা অত্যাচার চালাও, আমরা জবাব দেব”। 

দেশের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ‘মন্ত্রগুপ্তির’ দৃপ্ততায় সায় দিয়েছিলেন বিপ্লবীরা। বিশেষ করে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের (B.V) সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন যাঁরা। মন্ত্রগুপ্তি - কোনও কথা নয়, নিঃশব্দে লক্ষ্যের দিকে এগোনো আর কার্যসিদ্ধি। ক্লাস সেভেনে তখন পড়েন দীনেশ। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা নিচু ক্লাসের ছাত্রদের মেপেজুকে বিপ্লব-দলে নিতেন। অসীম সাহসী দীনেশ যে ক্লাসেই চোখে পড়বেন, তা আর নতুন করে বলার কি ছিল। স্কুলে হোক বা পাড়ায়, ছোট থেকেই নেতৃত্বের ব্যাপারে দীনেশের দক্ষতা ছিল সহজাত। কোনও সমস্যার সমাধানেও তাঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার। স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটকে অভিনয়েও তিনি ছিলেন অগ্রণী। Growing Up With Dinesh নিবন্ধে দীনেশ গুপ্তের সহপাঠী ডঃ ভবতোষ দত্তের উল্লেখ - “...যখন আমাদের এইরূপ জীবন চলছিল, তখনই আমরা উপলব্ধি করতাম যে, তলেতলে কিছু একটা ঘটছে। কিছু পরিবর্তন অনুভব করা যেত। … এসবের পিছনে একটা আন্দোলন, অথবা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে পুরাতন আন্দোলনের একটা নতুন রূপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। দীনেশ ছিল এই আন্দোলনের প্রথম দলভুক্তদের মধ্যে একজন…। ”

১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে যোগ। ১৯২৮ সালে পড়তে সোজা মেদিনীপুরের কলেজ। তা কি শুধু পড়ার উদ্দেশ্যে ? এই প্রশ্নের উত্তর মিলেছিল পরবর্তী কার্যকলাপেই। ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় তৈরি হয় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স কর্মীদল। তার আগে অবশ্য মেদিনীপুরে বিপ্লবী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটদের উপর নেমে এসেছে ভারতীয় যুবকদের প্রাণঘাতী প্রহার। দীনেশের সহপাঠীরা বুঝতে পারছিলেন, ক্রমশ দীনেশ গুপ্ত গুরুতর কোনও কিছুতে গভীরভাবে লিপ্ত হয়েছেন। 

দীনেশের বাবা হয়তো আগেই আশঙ্কা করেছিলেন কিছু একটা। তাঁর ভয় ছিল, ছেলে যদি বিপ্লবী হয়ে পড়ে তাহলে তাঁর চাকরি চলে যাবে। দাদার সম্পর্কে বোন জ্যোতিঃকণা লিখেছেন “...ছোড়দা খুব জেদি ছিল। রাগ হলে মুখ দিয়ে ফেনা বেরোত। চুল ছিড়ত। ১২ বছর বয়স থেকে স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল। বাবার আদেশ ছিল রাস্তায় আলো জ্বললেই বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু, মাঝে মাঝেই বাড়ি ফিরতে দেরি হত। বাবার সরকারি চাকরি। পোস্ট অফিসের কোয়ার্টারে থাকতেন। তাঁর ভয় ছিল, ছেলে বিপ্লবী হলে তাঁর চাকরি যাবে। কিন্তু সেই দৃষ্টি অতিক্রম করে ছোড়দা তার কাজ করে যেত। রাত করে ফিরলে বাবা কৈফিয়ৎ চাইতেন। ছোড়দা দৃঢ়কণ্ঠে বলত, যে সে বলবে না। খুব প্রহার চলত। আমরা কেঁদে বলতাম, বাবা, আর মারবেন না। ছেড়ে দিন। যেমন ছেলের জেদ তেমন বাপের। ছোড়দা বলত, আমি বললে আমাকে মিথ্যে কথা বলতে হবে। বাবা বলতেন, না বলতেই হবে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত বাবাই হার মানতেন। মারের জন্য ছোড়দার চোখ দিয়ে কখনও জল পড়ত না। আমাদের বলত, আমার হাতে পিন ফুটা, চিমটি কাট, আমাকে খুব করে ঘুষি মার। রোজ সকাল চারটার সময় শয্যাত্যাগ করত। আখড়ায় গিয়ে ডন, বৈঠক, কুস্তি করত। ৬টার সময় বাড়িতে এসে পড়তে বসত…। ”

ঢাকা থেকে বিশেষ দায়িত্বে দীনেশ গুপ্ত তখন মেদিনীপুরে। কাজ করছেন BV-র হয়ে। হঠাৎ একদিন শীর্ষ-বিপ্লবীদের থেকে ডাক পেলেন ঢাকা থেকে। জুনিয়রদের উপর কাজের ভার দিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে গেলেন ঢাকা। চলতে লাগল বিপ্লবী কার্যকলাপ। 

১৯৩০ সাল। আলিপুর জেলে বন্দি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, কিরণশঙ্কর রায়, নৃপেন ব্যানার্জি, সত্য গুপ্ত, সত্যরঞ্জন বক্সি প্রমুখ। জেল সুপার সোমদত্ত। আই জি কর্নেল সিম্পসন। একদিন জেলে সুভাষচন্দ্রকে অন্য কয়েদিদের দিয়ে মার খাওয়ানোর খবর পৌঁছয় বাইরে বিপ্লবীদের কাছে। মারের জেরে সুভাষচন্দ্র বসু অজ্ঞান হয়ে যান। সহবন্দি যাঁরা ছিলেন, মার খেয়েছিলেন তাঁরাও। এর জেরে প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত নিল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। দুজন তরুণকে দায়িত্ব দেওয়া হল। তবে একমাসের চেষ্টার পরে টার্গেট সোমদত্তকে সেভাবে পাওয়া যায়নি যে প্রত্যাঘাত করা যাবে। এরপর নিজেদের পরিকল্পনা ও কার্যপদ্ধতি বদলের সিদ্ধান্ত নেয় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। ইতিমধ্যেই সোমদত্তের জায়গায় জেল সুপার করা হয় মেজর এস এল পাটনিকে। তবে বন্দিদের প্রতি তার ব্যবহার খুব একটা রূঢ় ছিল না বলে জানা যায়। অত্যাচারী সিম্পসনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় দেড় মাস আগে। তৈরি করা হয় হামলার পরিকল্পনার জন্য অ্যাকশন স্কোয়াড। দলে ছিলেন হরিপদ দত্ত, রসময় শূর, প্রফুল্ল দত্ত, সুপতি রায়, নিকুঞ্জ সেন। তাঁরা স্থির করে ফেলনে হামলা কীভাবে হবে। কে কীভাবে এই কাজ করবেন। 

অলিন্দ যুদ্ধের আগে

সিদ্ধান্ত হল কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে হবে হামলা। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই রাইটার্স বিল্ডিং। এর মর্যাদায় আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের অ্যাকশন স্কোয়াডের সদস্যরা। ব্রিটিশদের অহঙ্কারে আঘাত হানতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে দেশের মানুষের আত্মবিশ্বাস - এই মন্ত্র নিয়ে চূড়ান্ত করে ফেলা হল দিনক্ষণ। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন বিনয় বসু। সিদ্ধান্ত নিল অ্যাকশন স্কোয়াড। তাঁর সহযোদ্ধা হবেন দীনেশ গুপ্ত। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এও। তবে দুজনকেই চেনে পুলিশ। তাই অপরিচিত বাদল গুপ্তকেও নেওয়া হল সঙ্গে।

সিম্পসন বসে কোথায় ? ইংরেজ পুলিশের নিরাপত্তা  ? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কোথায় কোন ঘর, অন্যান্য খুঁটিনাটি রেকি করে, কদিন ধরে বুঝে নিলেন বিনয়-বাদল-দীনেশ। শহীদ দীনেশ গ্রন্থে  পৃথ্বীশ গুপ্ত লিখেছেন…”সেই সময় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অবাধ প্রবেশ ছিল। ঘর দেখে আসার পর দীনেশকে জিজ্ঞাসা করা হল, ঠিক চিনতে পারবে তো ? দীনেশ বলল, বাদলকে জিজ্ঞাসা করুন। বাদল এই ঘর ঠিক রাখতে পারবে। আমাকে বিনয়দা যখন বলবেন, আমি দমাদম গুলি চালাব।’ বাদল ছিল শান্ত, ধীর ও স্থির। ৭ ডিসেম্বর দীনেশ ও বাদলকে জানানো হল, যে আগামীকালই অ্যাকশন।…” 

অ্যাকশনের আগের রাতে খাবার মেনু নাকি ঠিক করে দিয়েছিলেন দীনেশ গুপ্ত। বলেছিলেন বাদলের সঙ্গে তাঁর খাওয়ার প্রতিযোগিতা হবে। মাছ-মাংস-দই সব রকমের খাবারের আবদার করেছিলেন। খাওয়াদাওয়া সেরে খুব ঘুমিয়েছিলেন বাদল ও দীনেশ। খাওয়াদাওয়ার সময় খুনসুটিও করেছিলেন দুজনে। নিশ্চিন্ত ঘুম। যেন কিছুই হচ্ছে না।  

অ্যাকশন ডে 

৮ ডিসেম্বর। ১৯৩০। সোমবার। রসময় শূর মেটিয়াবুরুজে রাজেন গুহর বাড়ি থেকে একদম ধোপদুরস্ত অবস্থায় সাহেবি পোশাকে মেজর বিনয় বসুকে নিয়ে ট্যাক্সি চাপলেন। নামলেন খিদিরপুর ও পাইপ রোডের সংযোগস্থলে। অন্য একটি ট্যাক্সিতে নিকুঞ্জ সেনের সঙ্গে এসে পৌঁছলেন ক্যাপ্টেন দীনেশ গুপ্ত ও লেফটেন্যান্ট বাদল গুপ্ত। একইভাবে সুসজ্জিত দুজনে। সাহেবি পোশাকে। লক্ষ্যস্থির তিনজনেরই।  “…গাড়ি ছুটে চলেছে ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে। দূরত্ব কমে আসছে ক্রমশঃ। ভেতরে স্থির অচঞ্চল হয়ে বসে আছেন তিন মুক্তি-সৈনিক। বুকে তাঁদের দুর্বার সাহস। চোখ দিগন্তসীমার মত উন্মুক্ত, স্বচ্ছ দৃষ্টি। আঘাত হানতে হবে। চরম আঘাত হানতে হবে আজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে।”

ট্যাক্সি থেকে নেমেই কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে যান তিনজন। তারপর সোজা দ্বিতলে। কোনও দিকে না তাকিয়ে কর্নেল সিম্পসনের ঘরে। কাজ করছিল সিম্পসন। তিন বিপ্লবী ঘরে ঢুকেই জায়গা নিয়ে নেন। কোনও কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে গর্জে ওঠেন বিনয়। FIRE … । পরপর ছটা গুলি বুক ছিন্নভিন্ন করে দেয় সিম্পসনের। লুটিয়ে পড়ে সে। 

দিনেদুপুরে রাইটার্সের মত সরকারি অফিসে এভাবে বিপ্লবীরা হামলা চালাবেন, ভাবতে পারেনি ইংরেজ। তখন ত্রাহি অবস্থা রাইটার্সের ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি।   

তিন বীরের দাপাদাপির খবর ততক্ষণে পৌঁছে গেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। এসেছে পুলিশবাহিনী। ঘিরে ফেলেছে ডালহৌসি স্কোয়ার। রাইটার্স বিল্ডিংসে চলে এসেছে অত্য়াচারী পুলিশ কমিশনার টেগার্ট। ডেপুটি কমিশনার গর্ডন। 

তখন বিনয়-বাদল-দীনেশরা পাসপোর্ট অফিস আক্রমণ করেছেন। পুলিশ-বাহিনী মুহূর্তে তাদের সামনে চলে আসে। তৈরি তিন বীরও। শুরু হয় গুলির যুদ্ধ। স্বাধীনতার ইতিহাসের বিখ্যাত সেই অলিন্দ-যুদ্ধ। একদিকে ইংরেজ বাহিনী, অন্যদিকে স্বল্প গুলি সম্বলিত রিভলভার। তবুও বীরের লড়াই লড়ছিলেন বিনয়-বাদল-দীনেশ। একসময় দীনেশ গুপ্তর পিঠের বাঁ দিকে লাগে গুলি। 

যুদ্ধ করতে করতে ক্রমে তাদের তিনজনেরই রিভলভারের গুলি ফুরিয়ে এল। আর বেশিক্ষণ পারবেন না বুঝে, তিন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন পরিকল্পনা মাফিক। মুখে তখন “বন্দেমাতরম্”। আদেশ দিলেন বিনয়। তিনজনেই মুখে পুরলেন পটাসিয়াম সায়ানাইড। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারালেন বাদল। মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে নিজেদের শেষ গুলি নিজেদের জন্যই ব্যবহার করলেন দীনেশ ও বিনয়। পড়লেন লুটিয়ে। 



বিনয়-বাদলের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে, ইংরেজ শাসককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন মায়ের ‘প্রিয় নসু’

তবে না, মৃত্যু তাঁদের দুজনের হয়নি। নাড়ি চলছিল তখনও। সেই সুযোগ নিল ইংরেজ পুলিশ। দুজনকে নিয়ে যাওয়া হল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। না সারিয়ে তুলে ফাঁসি দেওয়ার সুযোগ ইংরেজকে দেননি বিনয় বসু।  অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থাতেই সবার অলক্ষ্যে ব্যান্ডেজের ভিতর দিয়ে আঙুল গলিয়ে মাথার ক্ষতকে আরও ভয়ানক করে তোলেন। সেপটিক্ হয়। ১৩ ডিসেম্বর। শেষ রাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ভারতমায়ের এই বীর সন্তান। 

রইলেন দীনেশ। ১২ ডিসেম্বর। নিজের ছোড়া গুলিটি বাঁ কানের পিছনে মাথায় আটকে ছিল তখনও। ডাক্তাররা অপারেশন করলেন। গুলি বের করা হল। তারপর সুস্থ করার চেষ্টা। পিঠে তখনও লুকিয়ে পুলিশের একটি গুলি। ২৩ ডিসেম্বর ফের আরেক অপারেশনে বের করা হল সেটাও। ইতিমধ্যেই দাদা যতীশ হাসপাতালে এসে দেখা করে গিয়েছেন দীনেশের সঙ্গে। ২৬ ডিসেম্বর আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয় দীনেশকে।   

ঘটনার পরে নানা বিতর্ক, নানা সমালোচনা শুরু হয় ইংরেজ মহলে। ইংরেজদের আত্ম-অহমিকায় আঘাত আনে এই হামলা। অন্যদিকে দেশবাসীর সমর্থন আদায় করে নেয় বিপ্লবীদের এই বীর কর্মকাণ্ড। 

আলিপুর সেন্ট্রাল  জেলের কনডেমড সেলে রাখা হয়েছিল দীনেশ গুপ্তকে। পাশের সেলেই ছিলেন আরেক বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। কনডেমড সেলে থাকাকালীন নিজের জীবনকাহিনী লিখেছিলেন দীনেশ গুপ্ত। লিখেছিলেন চিঠিও। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দাদা যতীশের চেষ্টায় দীনেশ গুপ্তের শেষ ছবি পাওয়া গেলেও আত্মজীবনী পাওয়া যায়নি। পৃথ্বীশ গুপ্ত লিখেছেন, “...কারাগারে গীতা, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ দীনেশের নিত্য পাঠ্য ছিল। তাঁকে দেখে মনে হত, সে যেন পরম প্রশান্তিতে আছে। সে যেন স্থিতপ্রজ্ঞের স্তরে উঠে গেছে। তার যেন কোনও কামনা, ভয়, ক্রোধ, দুশ্চিন্তা বা দুঃখ নাই। সর্বদাই সুখী ও তৃপ্ত। সে যেন পরম আনন্দে আছে। সে কীরকম মানসিক শান্তি লাভ করেছিল, সাড়ে ছয়মাসে ১৫ পাউন্ড ওজন বাড়াই তার নিদর্শন।… ছোট ঘর, জানালা নেই, দুঃসহ গরম - বিজলী পাখার আবেদন অগ্রাহ্য হয়েছিল - তবু তাকে কেউ এক মুহূর্তের জন্য ম্নান দেখেনি। এই ভাব তার ফাঁসির সময় পর্যন্ত ছিল। ”  

আপিল করতে নিষেধ করেছিলেন বাবাকে। প্রত্যয়ী দীনেশ চেয়েছিলেন - আপিলে দ্বীপান্তরের থেকে ফাঁসির আদেশই শ্রেয়। বাবা আর কীই বা বলতেন ! সুভাষচন্দ্র বসু তখন জেলে। জেলের সরস্বতীপুজো উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া হয়। পরিবেশন করেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। সেসময় তিনি দীনেশকে জিজ্ঞাসা করেন, “কী হবে মনে হয় ? অকুতোভয় দীনেশের উত্তর ছিল, “কী আর হবে, ফাঁসি হবে।” ১৯৩১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। বিকেলে হল রায়। ফাঁসি হবে দীনেশ গুপ্তের। ১৯৩১ সাল। ৭ জুলাই। ভোরে।


বিনয়-বাদলের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে, ইংরেজ শাসককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন মায়ের ‘প্রিয় নসু’

কলকাতা পুলিশের সরকারি কর্মচারী শান্তিপদ চক্রবর্তী দীনেশ গুপ্তর ফাঁসির সময় হাজির ছিলেন। তাঁর কাছে আদেশ এসেছিল, শবদাহ সৎকারের জন্য় যাবতীয় কিছু ব্যবস্থা সহ হাজির থাকতে। সেসময়কার অভিজ্ঞতা লিখে রেখেছিলেন ডায়েরিতে। 

শেষ সময় উপস্থিত। ম্যাজিস্ট্রেট মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা পড়ে শোনাতেই - দৃপ্ত তরুণের আওয়াজ হয়েছিল আরও দৃপ্ত। বলেছিলেন- “I am not going to die, I shall live forever.”

শান্তিপদ চক্রবর্তীর সে অভিজ্ঞতা উদ্ধৃত করে পৃথ্বীশ গুপ্ত শহীদ দীনেশ বইয়ে লিখেছেন … “দরজা দিয়ে বেরিয়েই তিনি নির্ভীক সবল কণ্ঠে ডেকে উঠলেন, বন্দে মাতরম। …একটানা বন্দেমাতরম ধ্বনি করতে করতে দীনেশ গুপ্ত আমাদের পাহারায় এগিয়ে চললেন। ওই অবিচলিত পদক্ষেপ দেখে যে সকলেই স্থম্ভিত হল, তা আমি দেখতে পেলাম। …নিস্তব্ধ সুরক্ষিত জেল প্রাঙ্গণের ভেতর থেকে ব্রাহ্ম মুহূর্তে এই তুমুল বন্দেমাতরম ধ্বনি আমাকে অতি গভীরভাবে জানিয়ে দিল যে এই মন্ত্র জাগ্রত। আমি উর্দি পরা পুলিস। চোখের জল কোনওরকমে চেপেছিলাম বোধহয়। ”


বিনয়-বাদলের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে, ইংরেজ শাসককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন মায়ের ‘প্রিয় নসু’

অবিরাম 'বন্দেমাতরম' ধ্বনির মধ্যেই গলায় ফাঁসির দড়ি নিয়ে পাটাতনের নিচে কুয়োর অন্ধকারে মিশে গেলেন দীনেশ। 

আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের বাইরে বসানো হয়েছিল কড়া পাহারা। জেলের অন্যান্য সেল থেকে যেমন বন্দেমাতরমে মুখরিত হয়েছিলেন কয়েদিরা, তেমনই জেলের বাইরেও বন্দেমাতরম ধ্বনিত হচ্ছিল মুহুর্মূহ। পরে গড়ের মাঠে করা হয়েছিল বিশাল সভা ও অধিবেশন। হল মিছিল। দীনেশ গুপ্ত জিন্দাবাদ স্লোগানে।


বিনয়-বাদলের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে, ইংরেজ শাসককে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন মায়ের ‘প্রিয় নসু’

কনডেমড সেলে বসে আত্মজীবনীর পাশাপাশি অনেক চিঠি লিখেছিলেন দীনেশ গুপ্ত। আত্মজীবনীটির মতই, অনেক চিঠি হারিয়ে গিয়েছে। গোটা দশেক চিঠির হদিশ এখনও মেলে। মাকে লিখেছিলেন দুটি, মণিদিকে দুটি, বৌদিকে তিনটি। ভাইকে দুটি এবং খুকুদিকে লেখা একটি চিঠি।    

মৃত্যুকে তাঁর দৃঢ় চরিত্রের জোরে হেলায় হারিয়েছিলেন দীনেশ। ৩০ জুন, ১৯৩১ সালে মাকে লেখা তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন…

মা,

… “মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে। এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজু বুড়ীর ভয়। যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য ? 

যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কি আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিব? ভুল, ভুল। মৃত্যু ‘মিত্র’ রূপেই আমার কাছে দেখা দিয়াছে। আমার ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে।

- তোমার নসু

...

 

তথ্যঋণ

শহীদ দীনেশ : পৃথ্বীশ গুপ্ত
বিপ্লব-তীর্থে : ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়
বিনয়-বাদল-দীনেশ : শৈলেশ দে
অগ্নিযুগের চিঠি - শুভেন্দু মজুমদার

আরও পড়ুন
Sponsored Links by Taboola

লাইভ টিভি

ABP Live TV
ABP আনন্দ
ABP અસ્મિતા
ABP ਸਾਂਝਾ
ABP न्यूज़
ABP माझा
POWERED BY
sponsor

সেরা শিরোনাম

WB News Live : বিশ্ব হিন্দু রক্ষা পরিষদের উদ্যোগে তৈরি করা হল 'বাবরি' হটাও মঞ্চ
বিশ্ব হিন্দু রক্ষা পরিষদের উদ্যোগে তৈরি করা হল 'বাবরি' হটাও মঞ্চ
BCCI: হরমনপ্রীতদের বিশ্বজয়ের পরেই বড় সিদ্ধান্ত, দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ছে মহিলাদের ক্রিকেটারদের বেতন?
হরমনপ্রীতদের বিশ্বজয়ের পরেই বড় সিদ্ধান্ত, দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ছে মহিলাদের ক্রিকেটারদের বেতন?
Bangladesh Violence: 'ষড়যন্ত্র করে মারা হয়েছে', দীপু দাসের মৃত্যুতে আর কী অভিযোগ তাঁর ভাই ঋত্বিকের?
'ষড়যন্ত্র করে মারা হয়েছে', দীপু দাসের মৃত্যুতে আর কী অভিযোগ তাঁর ভাই ঋত্বিকের?
Shubman Gill: বিজয় হাজারেতে তো খেলবেনই, বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ে এবার রঞ্জিতেও মাঠে নামবেন শুভমন গিল?
বিজয় হাজারেতে তো খেলবেনই, বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ে এবার রঞ্জিতেও মাঠে নামবেন শুভমন গিল?

ভিডিও

Jukti Takko: 'মৌলবাদ দেশকে খেয়ে ফেলে, সভ্যতায় বহুত্ববাদকে জায়গা দিতে হবে,' বললেন অভিজিৎ চৌধুরী
Jukti Takko: 'ধর্ম যে যার, উৎসব সবার, এই শিক্ষা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের', বললেন অরূপ চক্রবর্তী
Jukti Takko: 'সজল ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারীদের হাতে হিন্দুরা নিরাপদ নয়', আক্রমণ অরূপ চক্রবর্তীর
Jukti Takko: 'আজ সমাজটাই চালিত হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম দিয়ে', বললেন অভিজিৎ চৌধুরী | ABP Ananda Live
Kolkata News: কসবায় জমজমাট ক্রিসমাস ইভ, তৃণমূল কাউন্সিলরের উদ্যোগে কচিকাচাদের খেলনা ও কেক বিলি

ফটো গ্যালারি

ABP Premium

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
WB News Live : বিশ্ব হিন্দু রক্ষা পরিষদের উদ্যোগে তৈরি করা হল 'বাবরি' হটাও মঞ্চ
বিশ্ব হিন্দু রক্ষা পরিষদের উদ্যোগে তৈরি করা হল 'বাবরি' হটাও মঞ্চ
BCCI: হরমনপ্রীতদের বিশ্বজয়ের পরেই বড় সিদ্ধান্ত, দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ছে মহিলাদের ক্রিকেটারদের বেতন?
হরমনপ্রীতদের বিশ্বজয়ের পরেই বড় সিদ্ধান্ত, দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ছে মহিলাদের ক্রিকেটারদের বেতন?
Bangladesh Violence: 'ষড়যন্ত্র করে মারা হয়েছে', দীপু দাসের মৃত্যুতে আর কী অভিযোগ তাঁর ভাই ঋত্বিকের?
'ষড়যন্ত্র করে মারা হয়েছে', দীপু দাসের মৃত্যুতে আর কী অভিযোগ তাঁর ভাই ঋত্বিকের?
Shubman Gill: বিজয় হাজারেতে তো খেলবেনই, বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ে এবার রঞ্জিতেও মাঠে নামবেন শুভমন গিল?
বিজয় হাজারেতে তো খেলবেনই, বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ে এবার রঞ্জিতেও মাঠে নামবেন শুভমন গিল?
Car Loan Tips : গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করছেন ? এই ব্যাঙ্কগুলিতে গাড়ির ঋণে সর্বনিম্ন সুদ
গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করছেন ? এই ব্যাঙ্কগুলিতে গাড়ির ঋণে সর্বনিম্ন সুদ
Aadhaar Card : আধার কার্ড হারিয়ে গেছে ? চিন্তার কিছু নেই, এই কাজগুলি করলেই ফিরে পাবেন 
আধার কার্ড হারিয়ে গেছে ? চিন্তার কিছু নেই, এই কাজগুলি করলেই ফিরে পাবেন 
News Live Updates : আজ নতুন দল ঘোষণা হুমায়ুনের, কোন দিকে বঙ্গ রাজনীতি ?
আজ নতুন দল ঘোষণা হুমায়ুনের, কোন দিকে বঙ্গ রাজনীতি ?
Delhi Capitals: বদলে গেল নেতা, দিল্লি ক্যাপিটালসের নতুন অধিনায়ক হলেন জেমাইমা, বদল হতে পারে পুরুষদের দলেও?
বদলে গেল নেতা, দিল্লি ক্যাপিটালসের নতুন অধিনায়ক হলেন জেমাইমা, বদল হতে পারে পুরুষদের দলেও?
Embed widget