এক্সপ্লোর

Independence Day 2022: স্বাধীনতা আন্দোলনে পথ দেখিয়েছিল বাংলা, ইতিহাস তৈরি তমলুকে

Indian Freedom Struggle: ১৯৪২ সাল, বাংলার বুকেই তৈরি হয়েছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার।

কলকাতা: তমলুক শহর থেকে একটু দূরে, সোজা চলে গিয়েছে হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর  জাতীয় সড়ক। ওই জাতীয় সড়কের উপরেই পড়ে নিমতৌড়ি নামের একটি জায়গা। নিমতৌড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে, সেখানে গেলে তিনটি পূর্ণাঙ্গ মূর্তি দেখতে পাওয়া যাবে। নামফলকে দেখা যাবে তিনটি নাম, সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায় এবং সুশীলকুমার ধাড়া। তমলুকের প্রায় সব বাসিন্দাই তাঁদের চেনেন। যাঁরা বাংলার রাজনীতি জগতের খোঁজখবর রাখেন তাঁদের কাছেও এই তিনটি নাম খুব অপরিচিত নয়।

স্বাধীন ভারতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। সতীশচন্দ্র সামন্ত এবং সুশীলকুমার ধাড়া- এই দুজনও স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে বাংলার সংসদীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত নাম। কিন্তু, এই তিনজনের কী এটুকুই পরিচয়? নাহ, একেবারেই নয়। এই তিন ব্যক্তির পরিচয় পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে অন্তত ৮০ বছর পিছনে।

পরাধীন ভারতে 'স্বাধীন' সরকার:
দেশ তখন ব্রিটিশদের দখলে। স্বাধীনতার জন্য চলছে চরম লড়াই। সেই সময়েই অবিভক্ত মেদিনীপুরের তমলুকে একটি নিদর্শন তৈরি হয়েছিল। ব্রিটিশদের নাকের ডগায় বসে অস্বীকার করা হয়েছিল ব্রিটিশদের শাসন। শুধু তাই নয়, পরাধীন ভারতের বুকে তৈরি হয়েছিল সমান্তরাল স্বাধীন সরকার। নাম- তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। সেই সরকারের পুরোধা ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত এবং তাঁর দুই বিশ্বস্ত সহযোগী অজয় মুখোপাধ্যায় এবং সুশীলকুমার ধাড়া। আর তাঁদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন অসংখ্য নারী-পুরুষ।

৪২'-এর আগস্ট:
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। পাশাপাশি ভারতে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা পুঞ্জীভূত হচ্ছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন ভারতের বাইরে। সেখান থেকে চালাচ্ছেন তাঁর সংগ্রাম। দেশে রয়েছেন মহাত্মা গাঁধী। তাঁকে ঘিরেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন তামাম ভারতবাসী। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন মহাত্মা গাঁধী। আর তাঁর একডাকে ভারতজুড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পথে নামলেন ভারতবাসী। ওই ঘটনায় প্রমাদ গুনল ব্রিটিশ শাসকরা। আন্দোলনের শুরুতেই একাধিক কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ। গ্রেফতার করা হয়েছিল মহাত্মা গাঁধীকেও। নেতৃত্বের একটা বড় অংশ জেলে চলে যাওয়ার ফলে প্রভাব পড়েছিল আন্দোলনেও। সেই সময়ে পুরো আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিল জনগণ। কয়েকদিনের মধ্য়েই দেশের বড় শহরগুলির সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট শহর, গ্রাম-জনপদেও আন্দোলন ছড়িয়ে যায়।  ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক হিসেবে থানা থেকে আদালত, ডাকঅফিস সবকিছুর উপরই হামলা হতে শুরু করে। বেশ কিছু এলাকায় হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়। অনেক জায়গায় স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচে থাকে আন্দোলন। ঠিক এই সময়েরই আশেপাশে দেশের বেশ কিছু এলাকায় তৈরি হয়েছিল জাতীয় সরকার। সেগুলিরই মধ্যে একটি হল বাংলার বুকে তৈরি হওয়া তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। যাঁদের হাতে এই সরকার তৈরি হয়েছিল তাঁরা হলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীলকুমার ধাড়া। তাঁরা তিনজনই মেদিনীপুরের কংগ্রেস নেতা ছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হওয়ার পরপরই দমনমূলক নীতি নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। সারা দেশের মতোই মেদিনীপুর জেলাতেও গ্রেফতার করা হয়েছিল জেলার একাধিক কংগ্রেস নেতাকে। সেই সময়েই গা ঢাকা দেন তাঁরা। শুরু করেন গ্রাম থেকে আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ।

একদিনের একটি ঘটনা:
১৯৪২-এর সেপ্টেম্বর মাস। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরুর পর একমাস কেটেছে। সেই সময়েই তৎকালীন মহিষাদল থানা এলাকায় থাকা দানিপুর গ্রামে একটি ঘটনা ঘটে। ওই এলাকায় একটি গুদাম থেকে ব্রিটিশদের জন্য পাঠানো হচ্ছিল ধান ও চাল। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সেখানে ভিড় করেন বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসী। মিলের মালিককে বলা হয় এভাবে বাইরে খাদ্যশস্য না পাঠাতে, তাহলে এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা দেবে। এই ঝামেলার কথা শুনে সেখানে আসে ব্রিটিশ পুলিশ। নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর গুলি চালিয়েছিল তারা। ওই ঘটনায় প্রাণ দিয়েছিলেন তিনজন গ্রামবাসী। তাঁদের মৃত্যু বৃথা যায়নি। ওই ঘটনার পরেই যেন বিদ্রোহের বীজ নিহিত হয়ে গিয়েছিলে গোটা তমলুকের বাসিন্দাদের মনে।

এরপর ধীরে ধীরে ওই এলাকায় আন্দোলনের রাশ হাতে তুলে নিয়েছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত। ওই বছরেই সেপ্টেম্বরের শেষদিকে শুরু হয়েছিল তমলুকে ব্রিটিশ-রাজকে ধাক্কা দেওয়ার কাজ। তমলুকের সঙ্গে বহির্বিশ্বে যোগাযোগ করার যাবতীয় ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তমলুকে যোগাযোগ করার প্রায় সব রাস্তা কেটে ফেলা হয়েছিল। উপড়ে দেওয়া হয়েছিল টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের পোস্ট। একাধিক জায়গায় ভেঙে ফেলা হয়েছিল কালভার্ট। তমলুক সাব ডিভিশনের সঙ্গে যাতে বাইরের বিশ্বের কোনওরকম যোগাযোগ না থাকে, সেই কারণেই হয়েছিল এই কাজ। শোনা যায়, মাত্র কয়েকঘণ্টাতেই নাকি সেরে ফেলা হয়েছিল গোটা এই কর্মকাণ্ড। এক একটা কাজের দায়িত্বে ছিলেন নির্দিষ্ট গ্রামের বাসিন্দারা। গোটা বিষয়টা এতটাই গোপনীয়তার সঙ্গে হয়েছিল যে ব্রিটিশ শাসক ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। পরেরদিন অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর বিষয়টি টের পেয়ে কাজে নামে ব্রিটিশ সরকার। কিছুটা রাস্তা মেরামত করা হয়। এলাকায় আসে ব্রিটিশ সেনার দল।

বলিদান দিলেন অকুতোভয় এক বৃদ্ধা:
এই দিনেই আরও একটি কর্মসূচি ছিল। তমলুকের সাব ডিভিশন অফিস ও থানা দখল করার জন্য বিশাল মিছিল করেছিলেন গ্রামবাসীরা। তমলুক শহরের দিকে যাওয়ার আগে তাঁদের রাস্তা আটকায় পুলিশ ও সেনা। নির্বিচারে গুলি করা হয় শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর। মারা যান বেশ কয়েকজন। তাঁদের মধ্যেই রয়েছেন ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া মাতঙ্গিনী হাজরা। ওই ঘটনার সময় তাঁর বয়স সত্তর বছরেরও বেশি। পতাকা হাতে নিয়ে ব্রিটিশদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। চোখে চোখ রেখে দাবি তুলেছিলেন স্বাধীনতার। উত্তরে ব্রিটিশরা দিয়েছিল তিনটি বুলেট। মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী, তখনও সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রেখেছিলেন প্রাণের চেয়েও প্রিয় জাতীয় পতাকাকে। মহিষাদল থানা দখলেও অভিযান চলে। তবে স্থানীয় জমিদারদের অস্ত্র ও লোকবলের সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশরা তা রুখতে পেরেছিল। ওই ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষের মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল ব্রিটিশ। অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুশীল কুমার ধাড়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থানা দখল করা সম্ভব হয়নি। একমাত্র সুতাহাটা থানা বিনা রক্তপাতে দখল হয়। বলা হয়, সেই থানার স্টেশন অফিসার এবং বাকি পুলিশকর্মীরা নাকি নিজেরাই অস্ত্র জমা দিয়ে জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করেছিলেন। পরদিন, ৩০ সেপ্টেম্বর নন্দীগ্রাম থানায় অভিযান চালানো হয়েছিল, কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হয়। 

জাতীয় সরকারের সূচনা:
ধীরে ধীরে তমলুকে যখন আন্দোলন দানা বাঁধছে। সাধারণ মানুষ প্রাণের ভয় উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন আন্দোলনে। তখন ১৬ অক্টোবরে এক ভয়াবহ সাইক্লোন আছড়ে পড়ে মেদিনীপুরে। প্রবল ক্ষয়ক্ষতি হয় তমলুক এলাকায়। প্রাণহানিও হয়েছিল বহু। কিন্তু, ব্রিটিশ সরকার জোর করে এর খবর প্রকাশ করতে বাধা দিয়েছিল। ত্রাণ সাহায্যও নাকি করা হচ্ছিল না। তার উপর স্বাধীনতা আন্দোলনের কোমর ভাঙতে আরও একটি জঘন্য প্রয়াস নিয়েছিল তদানীন্তন শাসক। ওই ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে রাতের অন্ধকারে পুলিশ ও সেনা পাঠিয়ে লুঠ করা হতো গ্রামের পর গ্রাম। জ্বালিয়ে দেওয়া হতো বাড়িঘর। নানা অত্যাচার করা হতো বাসিন্দাদের উপর। এই অরাজক অবস্থা দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তমলুক সাব ডিভিশনে শান্তি ফেরাতে হলে, বন্যা-ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সাহায্য করতে হলে দেশবাসীকেই চালাতে হবে প্রশাসন। সেই মতোই কংগ্রেস নেতা সতীশচন্দ্র সামন্তর নেতৃত্বে তৈরি হয় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। দিনটা ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২। পরে ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি এই বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্র বেরোয় 'বিপ্লবী'-পত্রিকায়। সেখানে বলা হয়েছিল, মহকুমা কংগ্রেস তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের প্রতিষ্ঠা করেছে। ভারত যখন স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, তখন সেখানে এই জাতীয় সরকার যোগ দেবে। কিন্তু, আপাতত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এই জাতীয় সরকারের জন্য এক সর্বাধিনায়কের পদ তৈরি করা হয়েছে। ওই সর্বাধিনায়কের পদেই সর্বসম্মতিক্রমে বসেছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত। তিনি তৈরি করেছিলেন জাতীয় সরকারের মন্ত্রিসভাও।

সংগঠিত এবং নিয়মানুবর্তিতা:
হঠাৎ করে একদিনে তৈরি হয়নি এই জাতীয় সরকার। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, চেষ্টা, শ্রম, আত্মত্যাগের ফসল ছিল এটি। সরকার ঠিকমতো পরিচালনার জন্য আধুনিক কালের মতো একাধিক পদক্ষেপও করা হয়েছিল। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অধীনে তৈরি করা হয়েছিল চারটি থানা জাতীয় সরকার। সেগুলি হল মহিষাদল, সুতাহাটা, তমলুক এবং নন্দীগ্রাম। প্রতিটির জন্য একজন 'অধিনায়ক' নিয়োগ করা হয়েছিল। মহিষাদল থানার অধিনায়ক পদে ছিলেন নীলমনি হাজরা, তমলুক থানার অধিনায়ক পদে গুণধর ভৌমিক, নন্দীগ্রাম থানার অধিনায়ক কুঞ্জবিহারী ভক্তদাস এবং সুতাহাটা থানার অধিনায়ক হন জনার্দন হাজরা।

নিজস্ব সেনাদল: 
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার তৈরি হওয়ার বহু আগে থেকেই ওই এলাকা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সঙ্গে যুক্ত ছিল বিদ্যুৎ বাহিনী। ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনার সঙ্গে টক্কর নিয়েছেন এই বাহিনীর সদস্যরা। জেলায় বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছে বিদ্যুৎবাহিনী। যার নেতা ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত, সুশীল কুমার ধারা। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পরে এটিকেই জাতীয় বাহিনী ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি, ছিল মহিলাদের নিয়ে তৈরি ভগিনী সেনাও। সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্ত নিজের হাতে রেখেছিলেন বিদেশনীতি এবং যুদ্ধ দফতর। স্বরাষ্ট্র এবং অর্থের দায়িত্বে ছিলেন অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়। বিদ্যুৎ বাহিনী ও ভগিনী সেনার প্রধান সুশীল কুমার ধারা ছিলেন প্রতিরক্ষা দফতরের দায়িত্বে, পাশাপাশি জাতীয় বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া বিদ্যুৎ বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফের দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও, আইন, খাদ্য-সহ একাধিক দফতরের দায়িত্বও বণ্টন করা হয়েছিল।

নেতাজির আশায়:
ভারত ছাড়ো আন্দোলন, তমলুকের বেশ কিছু ঘটনা, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-এগুলি যদি জাতীয় সরকার তৈরির জ্বালানি হয়ে থাকে। তাহলে সেই সরকার তৈরির একটি লক্ষ্যও ছিল। তা হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে সাহায্য করা। নেতাজি ততদিনে জার্মানি পৌঁছেছেন। দেশবাসীর প্রতি পাঠানো তাঁর বার্তা শোনা হচ্ছে গোপনে। পূর্বদিকে জাপানি সেনা ইংরেজদের হারিয়ে এগোচ্ছে। আজাদ হিন্দ বাহিনী তৈরির কথাও ভেসে আসছে। এই টালমাটাল সময়েই জন্ম হয়েছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের। মেদিনীপুরের উপকূল এলাকার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব দেখে কোনও কারণে মনে করা হয়েছিল যে ব্রিটিশ সরকার ভাবছে সমুদ্রপথে মেদিনীপুর উপকূল দিয়ে ভারতে পা রাখবেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ফলে আশা করা হয়েছিল যে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের স্বাধীন এলাকাতেই পা রাখতে পারবেন নেতাজি।

আইন-শৃঙ্খলা থেকে প্রশাসন- প্রায় সবক্ষেত্রেই অসাধারণ সাফল্যের চিহ্ন রেখেছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। যদিও লড়াই কম ছিল না। ব্রিটিশরা টানা খোঁজ করে যাচ্ছিল সতীশ সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীল ধাড়াদের। কিন্তু খোঁজ পাচ্ছিল না। কারণ, স্থানীয়রাই অপার মমতা ও শ্রদ্ধার আড়াল করে রাখতেন, সাহায্য করতেন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের নেতা এবং কর্মীদের। যাঁরা এই সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তঁরা সকলেই মনেপ্রাণে ছিলেন গাঁধীর শিষ্য। অহিংসায় বিশ্বাসী, কিন্তু পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন সময় এই আন্দোলনে হিংসার আশ্রয় নিতে হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে, পুলিশের কাছে খবর পাঠায় এমন বিশ্বাসঘাতক ধরা পড়ার পরে কড়া সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এই কারণে নাকি, বেশ কয়েকজনের তরফে কংগ্রেসের উপরমহলে নালিশ করা হয়েছিল যে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, বিশেষ করে সতীশ চন্দ্র সামন্ত গাঁধীর অহিংসার পথ থেকে সরে আসছেন। এরই মধ্যে কলকাতায় এসে গ্রেফতার হন সতীশ চন্দ্র সামন্ত, দিনটা ছিল  ১৯৪৩ সালের ২৬ মে। তিন বছরের কারাদন্ড হয় তাঁর। তখন জাতীয় সরকারের দায়িত্ব নেন অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়। তিনিও গ্রেফতার হন ১৯৪৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। সেই সময়ে বাংলায় চলছে তেতাল্লিশের মন্বন্তর। সেই কঠিন সময়েও অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, চালিয়েছে ত্রাণের কাজও। অজয় মুখোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের পরে নন্দীগ্রাম এলাকার কংগ্রেস নেতা সতীশ চন্দ্র সর্বাধিনায়ক পদে বসেন। ব্রিটিশ সেনাদের জন্য খাদ্য়দ্রব্য দেওয়ার প্রতিবাদে সত্যাগ্রহ চালাতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন। তারপর ওই পদে বসেন বরদাকান্ত কুইটি। তিনিই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের শেষ সর্বাধিনায়ক।

গাঁধীর আদেশ শিরোধার্য:
১৯৪৪ সালে মে মাসে আগা খান প্রাসাদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান মহাত্মা গাঁধী। অসুস্থ ছিলেন তিনি। কিছুদিন বিশ্রামের পর সুস্থ হন গাঁধী। তারপর ভারত ছাড়ো আন্দোলন তুলে নেওয়ার ডাক দেন। দেশজুড়ে কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে আসার ডাকও দেন তিনি। তারপরেই সেই বছরের ৮ আগস্ট তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের কাজ বন্ধের কথা ঘোষণা করেন বরদাকান্ত কুইটি। তমলুক শহরে সত্যাগ্রহ করার সময় গ্রেফতারি বরণ করেন। এরপর ২৭ আগস্ট সুশীল কুমার ধাড়া একটি বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করে জানান যে এখন থেকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার তার সব কাজ বন্ধ করছে। ওই জাতীয় সরকারের কোনও দফতর আর কার্যকর থাকছে না। বিদ্যুৎ বাহিনী ও ভগিনী সেনার সদস্যরা এখন থেকে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেই কাজ করবে বলেও জানান তিনি। এমনকী জাতীয় সরকারের মুখপত্র 'বিপ্লবী'র প্রকাশনাও বন্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়। এভাবেই প্রায় দু'বছর চলার পরে শেষ হয়েছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মতো এক সফল 'বিপ্লব'। ব্রিটিশরা যাবতীয় শক্তি প্রয়োগ করেও যাকে হারাতে পারেনি।

সেদিনের পর থেকে প্রায় আট দশক কেটে গিয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫বছর পূর্তি ঘিরে প্রবল উন্মাদনা চলছে ভারত জুড়ে। স্বাধীন ভারতের এই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে রয়েছে বহু নাম না জানা পূর্বপুরুষদের অশ্রু-ঘাম-রক্ত। নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন বাদে সেই আদর্শ-আত্মত্যাগের প্রতি কি আদৌ কোনও শ্রদ্ধা রয়েছে? তাঁদের জীবনদর্শন থেকেও কি আর কোনও শিক্ষা নেয় আধুনিক প্রজন্ম? স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে হয়তো কড়া নাড়ে এই প্রশ্নও।    

তথ্যসূত্র:
১. Freedom Struggle in Tamluk (Volume One) সর্বাধিনায়ক, তাম্রলিপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাস কমিটি 
২. www.midnapore.in
৩. amritmahotsav.nic.in

আরও দেখুন
Advertisement
Advertisement
Advertisement

সেরা শিরোনাম

Team India Flight: ঘরে ফেরার সময়েও নজির! বিশেষ রেকর্ড গড়ল রোহিত-বিরাটদের বিমানও
ঘরে ফেরার সময়েও নজির! বিশেষ রেকর্ড গড়ল রোহিত-বিরাটদের বিমানও
Hemant Soren: ফের ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত, শপথ নিয়েই ভোটবার্তা, চম্পাই-অস্ত্রে শান বিজেপি-র
ফের ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত, শপথ নিয়েই ভোটবার্তা, চম্পাই-অস্ত্রে শান বিজেপি-র
Narendra Modi in Space: মহাকাশ অভিযানে যাবেন মোদি! আশাবাদী ISRO প্রধান, কংগ্রেস বলল...
মহাকাশ অভিযানে যাবেন মোদি! আশাবাদী ISRO প্রধান, কংগ্রেস বলল...
Mamata Banerjee: এককালীন অবসরভাতা বেড়ে ৫ লক্ষ, প্যারা টিচার, আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সুখবর মমতার
এককালীন অবসরভাতা বেড়ে ৫ লক্ষ, প্যারা টিচার, আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সুখবর মমতার
Advertisement
ABP Premium

ভিডিও

Dengue In Bengal: বর্ষা আসতেই রাজ্য়ে ফিরেছে ডেঙ্গির ভয়! ABP Ananda LivePetrol Density: গাড়িতে তেল ভরার সময় কোন কোন বিষয়ে নজর রাখা দরকার? না রাখলে কী ক্ষতি হতে পারে?Bhupatinagar Incident: ভূপতিনগর বিস্ফোরণকাণ্ডে প্রথম চার্জশিটেই বিস্ফোরক দাবি NIA-র! ABP Ananda LiveAssembly Oath Contro: শপথগ্রহণের দায়িত্ব নিতে নারাজ আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। ABP Ananda Live

ফটো গ্যালারি

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
Team India Flight: ঘরে ফেরার সময়েও নজির! বিশেষ রেকর্ড গড়ল রোহিত-বিরাটদের বিমানও
ঘরে ফেরার সময়েও নজির! বিশেষ রেকর্ড গড়ল রোহিত-বিরাটদের বিমানও
Hemant Soren: ফের ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত, শপথ নিয়েই ভোটবার্তা, চম্পাই-অস্ত্রে শান বিজেপি-র
ফের ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত, শপথ নিয়েই ভোটবার্তা, চম্পাই-অস্ত্রে শান বিজেপি-র
Narendra Modi in Space: মহাকাশ অভিযানে যাবেন মোদি! আশাবাদী ISRO প্রধান, কংগ্রেস বলল...
মহাকাশ অভিযানে যাবেন মোদি! আশাবাদী ISRO প্রধান, কংগ্রেস বলল...
Mamata Banerjee: এককালীন অবসরভাতা বেড়ে ৫ লক্ষ, প্যারা টিচার, আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সুখবর মমতার
এককালীন অবসরভাতা বেড়ে ৫ লক্ষ, প্যারা টিচার, আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সুখবর মমতার
West Bengal Assembly: আমাদের দুর্বল ভাবা ভুল', রাজ্যপালকে নিশানা বিমানের, শপথ জটিলতার মধ্যে কাল বিশেষ অধিবেশন
আমাদের দুর্বল ভাবা ভুল', রাজ্যপালকে নিশানা বিমানের, শপথ জটিলতার মধ্যে কাল বিশেষ অধিবেশন
Bihar Bridge Collapse: ধসে নেমে গেল মাঝের অংশ, নদীতে বসে গেল থাম, বিহারে ফের ভাঙল সেতু, ১৭ দিনে ১২টি
ধসে নেমে গেল মাঝের অংশ, নদীতে বসে গেল থাম, বিহারে ফের ভাঙল সেতু, ১৭ দিনে ১২টি
Brain Eating Amoeba: মস্তিষ্ক খেকো অ্যামিবার সংক্রমণ, পুকুরে স্নান করে চরম পরিণতি কিশোরের
মস্তিষ্ক খেকো অ্যামিবার সংক্রমণ, পুকুরে স্নান করে চরম পরিণতি কিশোরের
Team India Victory Parade Live: বৃষ্টি ও ট্রাফিকের জন্যই পিছিয়ে যাচ্ছে প্যারেডের সময়, এখনও বিমানবন্দরেই রোহিতরা
বৃষ্টি ও ট্রাফিকের জন্যই পিছিয়ে যাচ্ছে প্যারেডের সময়, এখনও বিমানবন্দরেই রোহিতরা
Embed widget