TET: 'শিক্ষা ও শিক্ষকজাতির অপমান' চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে খোলা চিঠি বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিশী-কন্যার
চিকিত্সক ও সমাজকর্মী বিনায়ক সেন, পরিচালক-অভিনেত্রী অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, বিভাস চক্রবর্তীর মতো বিদ্বজ্জনরা বিবৃতি জারি করেছেন। তবে অনেকে এখনও এনিয়ে নীরব।
কৃষ্ণেন্দু অধিকারী, কলকাতা: আন্দোলনকারী SSC ও TET চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে, এবার খোলা চিঠি লিখলেন, বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ প্রমথনাথ বিশীর মেয়ে চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী। অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপিকা লিখেছেন, শিক্ষা ও শিক্ষকজাতির প্রতি যে অপমান চলেছে দীর্ঘদিন ধরে, অবিলম্বে তার অবসান চাই। এদের যথার্থ স্থান হোক ক্লাসরুমে, ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে।
এদেরও কালীপুজোয়, আলো দিয়ে বাড়ি সাজাতে ইচ্ছে করে। ওদেরও ভাইকে ফোঁটা দিয়ে, রেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, ইচ্ছে থাকলেও উপায় কই! একটার পর একটা বছর, এদের কেটে যাচ্ছে রাস্তাতেই। বাড়ি থেকে, পরিবার থেকে, অনেক দূরে। যে চোখ একসময়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, তা আজ ভিজছে জলে। উৎসবের আলোর ছটা, ওদের জীবনের আঁধার দূর করতে পারছে না । দাঁতে দাঁত চেপে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, এই চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন বিদ্বজ্জনদের অনেকে। এবার তাঁদের পাশে দাঁড়ালেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ প্রমথনাথ বিশীর মেয়ে চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী। যিনি নিজে একজন প্রাক্তন শিক্ষক।
দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজে ৩০ বছর অধ্যাপনা করে আসা, চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী এক খোলা চিঠিতে লিখেছেন, এরা আমার কেউ রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় নয়, এরা আমার আত্মার অঙ্গ। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার এখন সে ক্ষমতা নেই। তাই লিখিতভাবে জানাই, যে এই শিক্ষা ও শিক্ষকজাতির প্রতি যে অপমান চলেছে দীর্ঘদিন ধরে, অবিলম্বে তার অবসান চাই। কেবল মুখের কথায় নয় কাজে করে দেখানো হোক। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রমথনাথ বিশী।
কবিগুরু যখন নোবেল পান, তখনও তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে প্রমথনাথ বিশীর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।
তিনি বিধানসভা এবং রাজ্যসভার সদস্যও ছিলেন। তাঁর মেয়ে চিরশ্রী এখন আশি পেরিয়েছেন। কিন্তু, বঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ, একঝাঁক তরুণ-তরুণীর রাস্তায় বসে থাকার ছবি, তাঁকে নাড়া দিয়ে গেছে। খোলা চিঠিতে তিনি লিখেছেন,
আমার বাবা সম্ভবত এই বয়সেই শিক্ষাজগতের এক মারাত্মক অনৈতিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, তাঁর সহযোদ্ধা ডঃ সুকুমার সেন-সহ বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশে অনশনে বসেছিলেন। আমার যদি শারীরিক ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমাকেও আপনারা কলকাতার ধূলিলুন্ঠিত রাস্তায়, এই সমস্ত অত্যাচারিত, অবিচারগ্রস্ত, মা সরস্বতীর প্রতিনিধি ছাত্রবর্গের সঙ্গে দেখতে পেতেন।
আমার শিক্ষাভূমির কাছে দাবি, যে এই বিচারের আশায় ভূলুন্ঠিত ছাত্রদের পদস্পর্শ করে ক্ষমা চাওয়া এবং তাদের শিক্ষাজগতে ফিরিয়ে আনা। এদের যথার্থ স্থান হোক ক্লাসরুমে, ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে। আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, করেনি। এবারেও করবে না। তার প্রাচীনতর উদাহরণ আমাদের মহাভারত। সল্টলেকে চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীদের, পুলিশ যেভাবে মাঝরাতে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে দিয়েছিল, তার প্রতিবাদে মুখ খুলেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্ব।
চিকিত্সক ও সমাজকর্মী বিনায়ক সেন, পরিচালক-অভিনেত্রী অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, বিভাস চক্রবর্তীর মতো বিদ্বজ্জনরা বিবৃতি জারি করেছেন।
তবে অনেকে এখনও এনিয়ে নীরব। প্রমথনাথ বিশীর মেয়ে, চিরশ্রী খোলা চিঠিতে লিখেছেন, এ কি আমাদের চেনা সেই কলকাতা? যাকে নিয়ে চিরকাল আমরা স্বদেশে, বিদেশে গর্ব করে এসেছি? এখনকার এই মুণ্ডহীন, রসনা সর্বস্ব কবন্ধ জনতাকে আমি চিনি না। এ কি সেই পাণ্ডবদের রাজসভা? যেখানে ভীষ্ম, কৃপ, দ্রোণাচার্য--- মহা মহা হৃদয়বান, শক্তিমান পণ্ডিতরা নিজেদের বিচারবুদ্ধিকে এক গোপন ও মিথ্যা প্রতিজ্ঞার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক একজন বিচারহীন দর্শক বনে বসে আছেন? কিন্তু কেন? কেন? কেন?
চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তীর পড়াশোনা কলকাতাতেই। আজ কলকাতার বুকে, শিক্ষক হতে চাওয়া এই তরুণ-তরুণীদের করুণ পরিস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন তিনি।