India at 2047: খাদের কিনারা থেকে দেশকে তুলে আনতে পারবেন রনিল! কোন পথে শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ
India at 2047: অশনি সঙ্কেত মিলতে শুরু করেছিল মার্চ মাসের গোড়া থেকেই। মুদ্রাস্ফীতির প্রকোপ সরাসরি গিয়ে পড়ে খাদ্য়দ্রব্যের উপর।
সুমিত পান্ডে: ছাইছাপা অবস্থা থেকে আগুন যে কোনও মুহূর্তে ছড়িয়ে পারতে বলে আঁচ করা গিয়েছিল আগেই। কিন্তু সেই আগুন যে ছবির মতো সাজানো দেশটিকে ছারখার করে দেবে, তা কল্পনা করা যায়নি। অর্থনৈতিক সঙ্কট যে ভাবে গলায় চেপে বসেছিল, তাতে পড়শি দেশ শ্রীলঙ্কায় (Sri Lanka Crisis) কার্যতই বিস্ফোরণ ঘটে এপ্রিল মাসে। দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার চালের দাম জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে ওঠেন মানুষ। তাতে জনরোষ আছড়ে পড়ে সরকারে উপর। সেই থেকে দ্বীপরাষ্ট্রের উপর নজর আটকে সকলের। বিশেষ করে পড়শি দেশ হিসেবে ভারত সেখানকার পরিস্থিতির দিকে বিশেষ নজর রাখছে।
অশনি সঙ্কেত যদিও মিলতে শুরু করেছিল মার্চ মাসের গোড়া থেকেই। মুদ্রাস্ফীতির প্রকোপ সরাসরি গিয়ে পড়ে খাদ্য়দ্রব্যের উপর। তার জেরে পেটের জোগান দেওয়াই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিস্থিতি আচমকাই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ মানুষ। রাজধানী কলম্বোর বুকে আছড়ে পড়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে সপ্তাহভরের কার্ফু ঘোষণা করতে হয় দেশের সরকারকে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরিবর্তে সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করতে শুরু করেন সাধারণ মানুষ।
বিশেষত পেট্রোল পাম্পগুলিতে তার প্রভাব লক্ষ্য় করা যায়। এর পর ছোট-বড় দলে বিভক্ত হয়ে পেট্রোল পাম্পগুলিতে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। বিক্ষোভের আঁচ এসে পড়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনেও। সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে প্রেসিডেন্ট ভবনকেই বেছে নেন বিক্ষোভকারীরা। যাবতীয় সমস্যার উৎপত্তি সেখান থেকেই বলে দৃঢ় ধারণা জন্মায় সকলের। ফলে ২০০৫ সাল থেকে এ যাবৎ শ্রীলঙ্কার উপর রাজাপক্ষ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ যে শিথিল হতে চলেছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
পাঁচ বছরের বিরতির পর ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে শ্রীলঙ্কার মসনদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠে আসেন মহিন্দা রাজাপক্ষ। ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষ প্রেসিডেন্ট হন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও সরকারের বিভিন্ন দফতের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন। শ্রীলঙ্কা লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলাম (LTTE)-এর প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য এ যাবৎ রাজাপক্ষ পরিবারকেই কৃতিত্ব দেওয়া হতো। তাদের বজ্রমুষ্ঠির নিয়ন্ত্রণেইছিল শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসে সেই রাজাপক্ষ পরিবারের পতন ঘটল।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং তার কার্যকারণ
২০১৯ সালে ইস্টার সান্ডে-তে কলম্বোর হোটেল, গির্জা-সহ একাধিক জায়গা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই রাজাপক্ষ পরিবারের আধিপত্য এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। ওই সন্ত্রাস হামলায় মৃত এবং আহতের সংখ্যা ছিল শতাধিক। যে পর্যটন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ভিত্তিপ্রস্ত ছিল, এই সন্ত্রাস হামলা তাকে নড়বড়ে করে দেয়। রাজকোষে সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারে টান পড়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই হামলা। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় নোভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে উদ্ভুত অতিমারি। বিদেশি মুদ্রায় যেমন টান পড়ে, তেমনই বেকারত্ব সমস্যা আকাশ ছুঁতে শুরু করে। তাতে শেষ পেরেক পুঁতে দেয় রাজাপক্ষদের ভুল নীতি।
খাদ্যদ্রব্যকে রাসায়নিকমুক্ত করার দোহাই দিয়ে সবরকমের কীটনাশক, রাসায়নিকের আমদানি নিষিদ্ধ করে রাজাপক্ষ সরকার। রাতারাতি এমন সিদ্ধান্তে বিপদে পড়েন কৃষকরা। মাত্র ছ’মাসেই দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে একধাক্কায় ৪৩ শতাংশ ঘাটতি দেখা দেয়। চা-সহ যে সমস্ত ফসল রফতানি করে বিদেশি মুদ্রা উপার্জন হত, তার উৎপাদনেও ১৫ শতাংশ ঘাটতি দেখা দেয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
ফসল উৎপাতনে ঘাটতি, পর্যটন শিল্পের মুখ থুবড়ে পড়া এবং সর্বোপরি কোভিড, তিন হাতুড়ির ঘায়ে রাজকোষে সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রা তলানিতে এসে ঠেকে। জ্বালানি থেকে চালের মতো জীবণধারণের প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা যে দেশ আমদানি করেই মেটাত এত কাল, সেই বাবদ টাকা মেটানোর ক্ষমতাই চলে যায় তাদের। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ভারতের তুলনায় শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP) যেখানে ভারতের চেয়ে বেশি ছিল, তা দ্রুতগতিতে নীচে নামতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বিদ্যুতের অভাবে দেশের তাবড় হাসপাতালে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয়।
এই পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষদেরই সরাসরি দায়ী করেন সাধারণ মানুষ। ফলে ছুটো বিক্ষোভ গণআন্দোলন এবং সরকার বিরোধী বিদ্রোহের আকার ধারণ করে। ক্ষোভ সামাল দিতে পদত্যাগ করেন মহিন্দা। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। বরং শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের পিটিয়ে মারার ঘটনা সামনে আসতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুন ধরানো হয় অন্য নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতেও। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নৌজাহাজে চেপে বিদেশ পালিয়ে যান গোতাবায়া। তাঁর একদা প্রতিপক্ষ রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের (Ranil Wickremesinghe) হাতেই এর পর যাবতীয় দায়িত্ব ওঠে।
কিন্তু তাতেও ক্ষোভ মেটেনি মানুষের। বরং ষড় করেই গোতাবায়াকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন তাঁরা। সাধারণ মানুষের সমনস্যা সমাধানের চেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতেই নেতারা বেশি আগ্রহ বলে দাবি করেন। তাই আজীবন রাজাপক্ষদের বিরোধিতা করলেও, রনিলের বাড়িতেও আছডে় পড়ে জনরোষ।
রাজাপক্ষ জমানা শেষ, নতুন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে শ্রীলঙ্কা, ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে!
দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে বরাবরই দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলেন রনিল। কিন্তু এমন চরম সঙ্কটের সময় ক্ষমতা সেই স্বপ্নপূরণ হবে, তা বোধহয় কল্পনা করেননি তিনি। বিশেষ করে যেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট হলেও, সংসদ ভর্তি রাজাপক্ষ অনুগামীতেই। এই মুহূর্তে ব্যয় সঙ্কোচনই রনিলের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এমনিতেই অন্য দেশ থেকে নেওয়া ঋণ মেটাতে নিজেদের অসমর্থ ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। তারা দেউলিয়া ঘোষণা করেছে নিজেদের। গত দু’দশকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই প্রথম কোনও দেশ এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ল।
এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে বার করে আনতে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (IMF)-এর কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার চুক্তিতে পৌঁছনো অত্যন্ত প্রয়োজন শ্রীলঙ্কার। বিগত কয়েক মাস ধরে তাতে লাগাতার বিলম্ব ঘটে চলেছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য পৌঁছচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। যত দিন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসছে, জ্বালানি থেকে খাদ্যসামগ্রী বণ্টনের ঘোষণা হয়েছে। মানুষের ক্ষোভ সামাল দেওয়ার পাশাপাশি, দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ রয়েছে রনিলের সামনে। যে কোনও মুহূর্তে কিছু ঘটে যেতে পারে আঁচ করেই তাই দেশের সেনা বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কত শীঘ্র তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন, তার উপর তাঁর মসনদে টিকে থাকা নির্ভর করছে। কয়েক দশক আগে পশ্চিম এশিয়ায় খবরের শিরোনামে থাকা আরব বসন্তের সঙ্গে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার তুলনা টানা হচ্ছে, দুই ক্ষেত্রেই খাদ্যসামগ্রী এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি মানুষকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। তবে এই সমস্যা যে একদিনে মেটার নয়, তার ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছেন রনিল। ফলে কৌশলী পদক্ষেপেই তিনি এগোবেন বলে মনে করা হচ্ছে।