Leptospirosis : ভিলেন ইঁদুরের প্রস্রাব, বিকল কিডনি-লিভার-ফুসফুস ! কোন 'মিরাকলে' বাঁচল কলকাতার কিশোর?
Leptospirosis Weil's disease : লেপ্টোস্পাইরোসিসের প্রথম টার্গেটই হল আক্রান্তের লিভার ও কিডনি। লিভারের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়।

কলকাতা : ইঁদুরের প্রস্রাবে থাকা ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে। রাতারাতি খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিল কলকাতার কিশোরকে। লিভার, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত, ফেটে গেছিল ফুসফুসও। 'বেঁচে ফেরা মিরাকল'। কীভাবে হল সম্ভব?
ছোট্ট জয়দীপ ( নাম পরিবর্তিত ) । বয়স ১৩-১৪। বড়দিনের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিল ডুয়ার্স। পড়াশোনার চাপ থেকে একটু মুক্তি। কী আনন্দই না করেছিল বেড়াতে গিয়ে। ফিরে এসে খুশি মনে শুরু করে দিয়েছিল পড়াশোনা। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি যে তার জন্য অপেক্ষা করছে ভাবেনি জয়দীপ, ভাবনার অতীত ছিল তার মা-বাবারও। কোথা থেকে এমন এক ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়ল সে, যা সাধারণত আসে ইঁদুরের প্রস্রাব থেকে।
ত্রাসের নাম লেপ্টোস্পাইরোসিস
জানুয়ারি মাসে জ্বর আসে হঠাৎ। হাই টেম্পারেচার সঙ্গে গা-হাত-পায় অসহ্য যন্ত্রণা। বিশেষত পেশীতে অসহ্য যন্ত্রণা। হাঁটতে পর্যন্ত পারছিল না ছেলেটা, জানালেন জয়দীপের মা। ভেবেছিলেন, খেলাধুলো করে বোধ হয় পেশি বা লিগামেন্টে চোট পেয়েছে ছেলে। দেখিয়েছিলেন অর্থোপেডিক সার্জেনও। কিন্তু সুরাহা হয়নি। বাড়তে থাকে জ্বর। সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গ। প্যারাসিটামল দিয়েও কোনও লাভ হয়নি। নামছিলই না তাপমাত্রা। ভর্তি করা হয় স্থানীয় হাসপাতালে। দেখা যায়,রক্তে প্লেটলেট কম। তবে জ্বরের কারণ তখনও বোঝা যায়নি। তারই মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয় ৫ ইউনিট প্লেটলেট। তারপরই দ্রুত শরীর অসুস্থ হতে শুরুকরে। প্রায় নেতিয়ে পড়ে ছেলেটা। জানালেন আক্রান্তের মা। আর তারপর হাসপাতাল পরামর্শ দেয় ভেন্টিলেশনে দিয়ে দেওয়ার। একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় হাসপাতাল বলে, অন্যত্র নিয়ে যেতে। 'ছেলেটাকে ক্রমেই নেতিয়ে পড়তে দেখছিলাম। শ্বাসকষ্ট বাড়ছিল। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, বুঝতে বাকি রইল না। অন্য বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল ছেলেকে, জানালেন অভিভাবক।
কীভাবে ছড়ায় লেপ্টোস্পাইরোসিস
কলকাতার অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ধরা পড়ে লেপ্টোস্পাইরোসিস পৌঁছেছে গুরুতর পর্যায়ে ! বেশির ভাগ মানুষের কাছেই একেবারেই অচেনা নাম। আরও অদ্ভুত এই অসুখের উৎস। স্পাইরোকেট লেপ্টোস্পাইরা নামে এক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে হয় হয় এই অসুখ। আর এই ব্যাকটেরিয়া থাকে ইঁদুরের প্রস্রাবে। তার নোংরা জল মারফত শরীরে ঢুকে এই ভয়ঙ্কর অসুখ ডেকে আনতে পারে। এটি মানুষ এবং প্রাণী উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে। বলা হয়, হারিকেন বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর যখন জল দূষিত হয়ে যায়, মাটিতে মেশে দূষিত পদার্থ, তখন লেপ্টোস্পাইরোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিন্তু জয়দীপ কীভাবে আক্রান্ত হল ? সে উত্তর এখনও জানা নেই কারও।
একে একে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছিল সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
লেপ্টোস্পাইরোসিসের প্রথম টার্গেটই হল আক্রান্তের লিভার ও কিডনি। লিভারের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। কিডনি বিকল করে দেয়। তার ফলে ক্রিয়েটিনিন বাড়তে থাকে দ্রুত। লেপ্টোস্পাইরোসিস খারাপ দিকে গেলে এক এক করে সব অর্গান বিকল করে দেয়। ঠিক যেমনটা হল জয়দীপের । ১৩ বছরের ছেলেটার লিভারের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে, বিলিরুবিন বেড়ে ৩১ এ পৌঁছে যায়। কিডনি প্রায় বিকল। কিন্তু ওষুধ কাজ করবে কীভাবে। এদিকে ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে যায় ভয়ানক ভাবে। শুরু হয়ে গিয়েছিল তীব্র শ্বাসকষ্ট। হাসপাতালের হার্ট ও একমো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অর্পণ চক্রবর্তী জানালেন, লেপ্টোস্পাইরোসিসে ফুসফুসে প্রভাব পড়ার ঘটনা কম হয়। আর জয়দীপের ক্ষেত্রে (নাম পরিবর্তিত) ফুসফুসটা ফেটেই গিয়েছিস। বেরিয়ে আসছিল হাওয়া। শরীরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গ থেকে শুরু হয় হ্যামারেজ বা রক্তক্ষরণ। এই অবস্থায় একমাত্র উপায়ই ছিল একমো সাপোর্টে রাখা। কারণ ফুসফুসের এই অবস্থায় ভেন্টিলেশন সাপোর্টও কাজ করে না।
কীভাবে চিকিৎসা
একমো হল এমন একটা সাপোর্ট সিস্টেম, যেখানে ফুসফুসকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিয়ে, তার কাজটা প্রযুক্তি দিয়ে করা হয়। ফুসফুস সেরে ওঠার অবকাশ পায়। জয়দীপের ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতিটিই বেছে নেওয়া হয়েছিল। তারই মধ্যে বিলিরুবিন বাগে আনতে প্লাজমাফেরেসিস করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্লাজমা বদল করা হয়, তাতে এবং শরীর থেকে ক্ষতিকারক অ্যান্টিবডি বা অন্য কোনও ক্ষতিকর উপাদান বের করা হয়ে থাকে। এছাড়া লেপ্টোস্পাইরা ব্যাকটেরিয়া পজিটিভ থাকলে যা যা ওষুধ দেওয়া হয়, তা দেওয়া হতে থাকে। একমো সাপোর্টে ১১ দিনে বেশ কিছুটা উন্নতি হয় ফুসফুসের । ফেটে যাওয়া জায়গাগুলিও মেরামতি হয়। পঁচিশের চিকিৎসায় প্রায় খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসে জয়দীপ। 'এ যেন এক নতুন জীবন'বললেন জয়দীপের মা।
চিকিৎসক অর্পণ চক্রবর্তী জানালেন, লেপ্টোস্পাইরোসিসে একমো খুব একটা ব্যবহার হয় না। এক্ষেত্রে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেলে বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। পূর্ব ভারতে সম্ভবত এই প্রথম লেপ্টোস্পাইরোসিসে একমো ব্যবহার হল।
লেপ্টোস্পাইরোসিস কী সব সময় এতটাই ভয়ানক?
জয়দীপের চিকিৎসক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কৌস্তভ চৌধুরী ( পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বিশেষজ্ঞ) জানালেন, সবসময় লেপ্টোস্পাইরোসিস ভয়ানক নয়। প্রতিটি সংক্রমণের মতো এরও নানারকম স্তর থাকে। তবে পিডিয়াট্রিশিয়ানরা যদি লক্ষণ দেখে শুরুতেই নির্ণন করতে পারেন অসুখটা, তাহলে চিকিৎসা তাড়াতাড়ি শুরু করা সম্ভব। ৭ দিনের মধ্যে চিকিৎসা শুরু হলে অ্যান্টিবায়োটিক সহজে কাজ করে। তবে যত দেরি হবে, তত কঠিন হয় অসুখ। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা কীভাবে চিনবেন এই অসুখ? এই রোগে বাড়াবাড়ি রকমের জন্ডিস দেখা যায়। চোখের রঙ হলুদ হয়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় Leptospira ictero-haemorrhagica বলা হয়। Severe Leptospirosis -এর ক্ষেত্রে রোগীর মাল্টিঅর্গান ফেলইয়র হতে পারে। যেমনটা হয়েছিল জয়দীপের ক্ষেত্রে। ফুসফুসেও সংক্রমণ জাঁকিয়ে বসে। সেইসঙ্গে ছিল ভয়ানক কিডনি ইনজুরি ( Acute Kidney Injury -AKI)। তবে এক্ষেত্রে প্রস্রাব বন্ধ হয় না বা কমে যায় না। এছাড়া বিলিরুবিনের মাত্রাও হয়ে যায় ভয়ানক।
লেপ্টোস্পাইরোসিস এই রকম ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌঁছলে, তাকে Weil's disease বলা হয়। ওয়েল'স ডিজিজ, লেপ্টোস্পাইরোসিসের একটি গুরুতর রূপ । এক্ষেত্রে কিডনি ও লিভার বিকল করার সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসও ঝাঁঝরা হয়ে যায়। আর এমন পরিস্থিতি হলে বাঁচার আশা ৮০ শতাংশ ক্ষীণ হয়ে যায়। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেলে রোগী অক্সিজেনের অভাবেই মারা যায়। এই পরিস্থিতিটাই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে একমোর সাহায্যে। ফুসফুসকে বিশ্রাম না দেওয়া গেলে রোগী মৃত্যু একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাকে মিরাকলের থেকে কম কিছু ভাবছেন না জয়দীপের মা-বাবা।
লেপ্টোস্পাইরোসিসের প্রাথমিক লক্ষণ
জ্বর, মাথাব্যথা, ঠান্ডা লাগার পাশাপাশি সব থেকে বেশি কষ্ট দেয় পেশীর যন্ত্রণা। বমি বমি ভাব, বমি এবং ডায়রিয়া হতে পারে। অবস্থা গুরুতর হলে ত্বক এবং চোখের হলুদ ভাব প্রকট হতে শুরু করে। জন্ডিসে হলুদ হয়ে যায় শরীর। অভ্যন্তরীণ রক্তপাত শুরু হয়ে যায়। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং কালো, পিচ্ছিল মল শুরু হয়ে যায়। এমন উপসর্গ গুলি বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে।
Check out below Health Tools-
Calculate Your Body Mass Index ( BMI )























