Rabindra Jayanti 2024: ২২০০ গানের মধ্যে মাত্র একটি স্বরলিপি কবির নিজে লেখা ? ‘এ কি সত্য...’ ?
Rabindra Jayanti 2024 Rabindra Sangeet Notation controversy: দীর্ঘ ৮১ বছরের জীবনে ২২০০ গান লেখেন কবি। এর মধ্যে একটিমাত্র স্বরলিপি তাঁর নিজের ? সত্যিই কি তাই ? আলোচনায় বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক পীতম সেনগুপ্ত।
গান ও বাঙালি নিয়ে কবি
‘জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মরাইতে জমা হবে তা বলতে পারি নে। কিছু ইঁদুরে খাবে, তবু বাকি থাকবে কিছু। জোর করে বলা যায় না; যুগ বদলায়, কাল বদলায়, তার সঙ্গে সব কিছুই তো বদলায়। তবে সব চেয়ে স্থায়ী হবে আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালিরা, শোকে দুঃখে, সুখে আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এই গান তাদের গাইতে হবেই।’আলাপচারী রবীন্দ্রনাথে এই কথাই রাণী চন্দকে বলেছিলেন বিশ্বকবি। নিজের লেখা নিয়ে মনে সংশয় থাকলেও গান নিয়ে সেই সংশয়ের অবকাশ তাঁর ছিল না। বরং গানের মধ্যে দিয়েই বাঙালির অন্তরতম স্থান ছুঁয়ে গিয়েছেন যেন। তাই মৃত্যুর আগের বছর আশি বছর বয়সে তাঁর উপলব্ধি - ‘সব চেয়ে স্থায়ী হবে আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালিরা, শোকে দুঃখে, সুখে আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই।’
ইন্দিরা দেবীর বয়ান
কিন্তু বাঙালির প্রাণাধিক প্রিয় এই গান নিয়ে জটিলতা কম নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাশি বছরের জীবৎকালে ২২০০-র বেশি গান লেখেন। কিন্তু গানের স্বরলিপি লিখতেন না কবি। বরং পরিচিত আত্মীয় অনাত্মীয়দের লিখিয়ে নেওয়াতেই তাঁর বেশি উৎসাহ ছিল। ইন্দিরা দেবী তাঁর ভাইঝি, মেজদার মেয়ে। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর তিনিই গানের স্বরলিপি সংকলনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, দীর্ঘ ৮১ বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথ একটি মাত্র গানের স্বরলিপি লেখেন। আর সেই গানটি হল ‘এ কি সত্য সকলি সত্য’। সেটিকেই শুধুমাত্র স্বরবিতানে স্থান দেওয়া হয়। ইন্দিরার চিঠিটি কবির প্রয়াণের পর লেখা। ১৯৫০ সালের ১৭ মার্চ। ১৮৯৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শিলাইদহ পর্বে ‘এ কি সত্য সকলি সত্য’ গানটির স্বরলিপি লেখেন তিনি। কিন্তু এই একটিই গান ? আর কোনও গানের স্বরলিপি লেখেননি কবি ?
মাত্র একটি গানের স্বরলিপি ?
এই প্রসঙ্গেই এবিপি লাইভে নিজের গবেষণার কথা জানালেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক পীতম সেনগুপ্ত। তথ্য় প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন অন্তত আরও দুটি গানের স্বরলিপি। কিন্তু সেগুলি স্বরবিতানে স্থান পায়নি। অথচ রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর তৈরি স্বরলিপি সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা দেবী। পীতমবাবুর কথায়, ‘এ কি সত্য সকলি সত্য’ গানটির স্বরলিপি লেখার দুদিন আগেই আরেকটি গানের স্বরলিপি লেখেন কবি। সেটি হল ‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’। ১৮৯৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর লেখা হয় গানটি। ১৩০২ সনে রচিত ‘পাদপ্রান্তে রাখ সেবকে’ গানটির স্বরলিপিও তিনি করেন।
‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’
‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’ গানটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকার ১৩০৪ সনের কার্তিক সংখ্যায়। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা জোত্যিরিন্দ্রনাথ স্বয়ং। স্বরলিপিকারের স্থানে নাম ছিল রবীন্দ্রনাথের। পীতমবাবু জানাচ্ছেন, ওই একই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গান প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গানটি ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’। এই গানের স্বরলিপিকারের স্থানে নাম ছিল সরলা দেবীর। অর্থাৎ যদি জ্য়োতিদাদা প্রশ্রয় দিয়ে ‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’তে রবীন্দ্রনাথের নাম ছাপেন, তাহলে ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’র ক্ষেত্রেও তাই করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। আবার ভুল করে রবীন্দ্রনাথের নাম ছেপে থাকলে সে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই জানাতেন। কিন্তু তেমন কোনও তথ্য প্রমাণ নেই। বরং রবীন্দ্রনাথ যে এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তা ধরে নেওয়া যায়। কারণ পত্রিকা তাঁর দাদারই সম্পাদিত।
‘পাদপ্রান্তে রাখ সেবকে’
‘বঁধু মিছে রাগ কোরো না’র পর আর যে গানের স্বরলিপির হদিস পেয়েছেন রবীন্দ্র গবেষক পীতম, সেটি হল ‘পাদপ্রান্তে রাখ সেবকে’। সেই সময় সঙ্গীত বিষয়ক দুটি বিখ্যাত পত্রিকা ছিল। একটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকা। অন্যটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা’ পত্রিকা। শরৎচন্দ্রের ‘সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা’ পত্রিকা সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ১৩৩১ সনের প্রথম সংখ্য়ায় প্রকাশিত হয় ‘পাদপ্রান্তে রাখ সেবকে’। স্বরলিপিকার হিসেবে নাম ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু সে নিয়ে কোনও আপত্তির কথা শোনা যায়নি রবীন্দ্রনাথের।
ইন্দিরা দেবীর বয়ান নিয়ে যেখানে সংশয়
দুটো গানই রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই পত্রিকায় স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। একই সঙ্গে ছিল স্বরলিপিও। স্বরলিপিকারের নামে যদি ভুল থাকত, তাহলে রবীন্দ্রনাথের তরফে আপত্তিবাক্যও থাকত। কিন্তু তেমন কিছুর কথা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। অন্যদিকে ইন্দিরা দেবীর স্বরলিপি সংক্রান্ত বয়ান রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর জানা যায়। অর্থাৎ সেই বয়ানে ভুল থাকলেও তা শুধরে দেওয়ার সঠিকতম ব্যক্তি সেখানে নেই।
গীতবিতানের সুরহীন গান
একেবারে না পারতে নিজে কিছু গানের স্বরলিপি লিখেছিলেন কবি। কিন্তু এর বাইরেও আরেকটি পন্থা অবলম্বন করতেন তিনি। স্বরলিপি না লিখতে পারলেও স্বরগুলি লিখে রাখতেন। এতে ভুলে গেলেও গানটি ঠিক গেয়ে নেওয়া যেত। পাশাপাশি গানের স্বরলিপি বানিয়ে ফেলা যেত। সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় রবীন্দ্রনাথ তেমনটাই করতেন। কিন্তু তাঁর অনেক গান আজও সুরহীন। ২২০০ গানের মধ্যে এখনও ২০০টি মতো গানে কোনও সুর দেওয়া হয়নি।
সুকুমার রায়ের মৃত্যুশয্য়ায় গাওয়া…
সুরহীন এমনই একটি গানের উদাহরণ দিলেন পীতমবাবু। তাঁর কথায়, ‘১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। তরুণ প্রতিভা সুকুমার রায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে যান। সুকুমার তাঁকে একটি গান শোনানোর অনুরোধ করেন। গানটি ছিল গীতালি কাব্যগ্রন্থের ‘দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো।’ আসলে সেটি কবিতা যদিও। তাই সুর তাল কিছুই তৈরি ছিল না। রবীন্দ্রনাথ গানটির অনুরোধ শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন। এর পর তখুনি সুর বেঁধে গান শোনান। সেদিনের এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার। তাঁর বয়ানে জানা যায়, এই কবিতাটির সুর দেওয়া ছিল না। সেখানে সকলের সামনে বসে সুর দিয়ে গানটি শুনিয়েছিলেন কবি। কিন্তু পরে সুর ভুলে যান কবি। যথারীতি হারিয়ে যায় সেই সুর
বিদেশে করা স্বরলিপি নিয়ে প্রশ্ন
রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি নিয়ে ইন্দিরা দেবীর সেই ‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকায় একটি মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। ইন্দিরা দেবীর বয়ান অনুযায়ী, ‘অন্তত কলকাতা বাসকালে আমরা তাঁকে কখনো স্বরলিপি করতে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। শান্তিনিকেতনের অধিবাসীরাও বোধহয় এ সম্বন্ধে অনুরূপ সাক্ষ্যই দেবেন।’ কিন্তু এর বাইরেও রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন। লিখেছেন অন্যস্থানে বসে। বিদেশ বিভুঁইয়ে প্রায়ই ডাক পড়ত কবির। জলপথ বা রেলপথে বসে গান রচনা করার অনেক নজির রয়েছে রবীন্দ্রনাথের। সেই গানগুলির স্বরলিপি লিখতেন কে ? সবসময় যে সঙ্গে একজন স্বরলিপিকার এমন তো নয়। এই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা আবশ্যক বলে মনে করেন রবীন্দ্র গবেষক পীতম।
রবিগানের স্বরলিপিকারেরা
রবীন্দ্রনাথের গানের কমবেশি ৩০ জন স্বরলিপিকার ছিলেন। এর মধ্যে আত্মীয় যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন অনাত্মীয়। রবীন্দ্রনাথের প্রায় ৭০০র বেশি গানের স্বরলিপি রচয়িতা ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবির নাতি। দিনু ঠাকুরের নামে একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। তা হল তিনি কবির করা সুরে অদলবদল ঘটাতেন। সাতশোটি গানের স্বরলিপি করলেও কবির সঙ্গে একবার মতানৈক্য হয় দিনু ঠাকুরের । ‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে’ গানটির স্বরলিপি নিয়ে মতবিরোধের জেরে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসেন দিনেন্দ্রনাথ। এর পরেই যাঁর নাম করতে হয়, তিনি ইন্দিরা দেবী। প্রায় ৩০০টি গানের স্বরলিপি রচয়িতা তিনি। তাই তাঁর বয়ানের মূল্য অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই সেই বয়ান নিয়ে রয়েছে সংশয়ও…।
আপনার পছন্দের খবর এবার হোয়াটসঅ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে।
আরও পড়ুন - Rabindra Jayanti 2024: নানা মানুষের প্রভাবপুষ্ট ছেলেবেলা, কাদের উৎসাহে রবি ঠাকুর আজ বিশ্বকবি ?