আপত্তি 'গরু, গুজরাত, হিন্দুত্ব'র মতো শব্দে, অমর্ত্যকে নিয়ে তথ্যচিত্রে কোপ সেন্সর বোর্ডের
কলকাতা: ফের বিতর্কে সেন্সর বোর্ড। এবার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রেও সেন্সরের কোপ। সাক্ষাৎকারে গরু, গুজরাত, হিন্দু, হিন্দুত্ব শব্দে আপত্তি সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের। শব্দে বিপ বসাতে নারাজ পরিচালক, তাই মিলল না ছাড়পত্র। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক। গরু, গুজরাত, হিন্দু ও হিন্দুত্ব..আপাতদৃষ্টিতে চারটি নিরীহ শব্দ! কিন্তু, না, সেন্সর বোর্ড চাইছে এই শব্দগুলো আপনি এভাবে শুনবেন না, শুনবেন অন্যভাবে। চারটে ‘বিপ’ আওয়াজে! ঠিক এমনটাই চাইছে সেন্সর বোর্ড। যাতে এই চারটি শব্দ শোনা যায়। আর এই বিপ তারা কোনও চিত্রনাট্যের ডায়লগের উপর বসাতে চাইছে, এমনটা নয়, বসাতে চাইছে অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকারে! তাঁর মুখ থেকে বেরোনো কিছু শব্দই সাধারণ মানুষকে শুনতে দেওয়া নিয়ে বড়সড় আপত্তি সেন্সর বোর্ডের। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন অর্থনীতিবিদ সুমন ঘোষ। নাম ‘অ্যান আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’। অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে তাঁর জীবন, কাজ এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তার কথা। সেখানেই নানা সময় নানা কথা বলতে গিয়ে তাঁর মুখে এসেছে এই শব্দগুলি। গুজরাত শব্দটি অমর্ত্য সেনের কথায় আসে করনেল ইউনিভার্সিটির একটি বক্তৃতায়। হিন্দু শব্দটি অমর্ত্য সেন বলেন অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে। একইভাবে তথ্যচিত্রের অন্য অংশে বিভিন্ন সময় গরু এবং হিন্দুত্ব-র মতো শব্দ এসেছে। আর এখানেই ঘোর আপত্তি সেন্সর বোর্ডের। গুজরাত, গরু, হিন্দু এবং হিন্দুত্ব--- এই চারটি শব্দেই কাঁচি চালাতে চেয়েছে তারা। তাদের দাবি, এই চারটি শব্দে বিপ দিতে হবে। যাতে তা দর্শকদের কানে না পৌঁছোয়। কিন্তু, পরিচালক সুমন ঘোষ তা মানতে নারাজ।তিনি বলেন, কী কী নিয়ে আপত্তি। আমি অ্যাডজাস্ট করব না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এই মুহূর্তে শান্তিনিকেতনে। তিনি এই বিতর্ক নিয়ে কিছুই বলতে চাননি। শুধু জানান, আমি কিছু বলব না। যা বলার বলবেন পরিচালক সুমন ঘোষ। তবে এনিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে বিদ্বজ্জন মহলে। কবি শঙ্খ ঘোষের প্রতিক্রিয়া, স্পর্ধা যে কতদূর পৌঁছোচ্ছে, এ তার একটা লজ্জাজনক নজির। সেন্সর বোর্ডের এহেন সিদ্ধান্তের সমালোচনায় সরব হয়েছেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন ও অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নবনীতা দেবসেন বলেন, সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্তে বিদেশে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, অমর্ত্য সেন সারা বিশ্বের শ্রদ্ধা পাওয়া মানুষ। তাঁর তথ্যচিত্র বন্ধ করে দেওয়া মুর্খামি। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এভাবে বিতর্ককে মুছে দেওয়া যায় না। দেশে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, মত শিক্ষাবিদ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির। কেন আমরা আমাদের মত বলতে পারবো না। এনিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। মন্তব্য শিক্ষাবিদ কৃষ্ণা বসুর। সেন্সর বোর্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, সেন্সরের কাঁচির কোপে এবার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের সাক্ষাত্কারও। এনিয়ে ট্যুইট করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লেখেন, বিরোধিতার প্রতিটি কণ্ঠই রোধ করা হচ্ছে। এবার অমর্ত্য সেন। তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব যদি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে না পারেন, তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে? তথ্যচিত্রটিতে অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যিনি, বিশ্বব্যাঙ্কের সেই প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তথা অধ্যাপক সেনের ছাত্র কৌশিক বসুর বক্তব্য, অমর্ত্য সেনের বক্তব্য সেন্সর করার চেষ্টা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা আমার বন্ধুরাও এই ঘটনায় ততটাই হতবাক, যতটা আমি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের মানের সঙ্গে এ ধরণের সিদ্ধান্ত খাপ খায় না। ভারত যে দেশগুলোর সমালোচনা করে, এখন যদি সেইসব দেশগুলির কর্মকাণ্ডকেই অনুসরণ করতে শুরু করে, তাহলে তা হতাশাজনক। অনেকে বলছেন, বাণিজ্যিক ছবির ওপর সেন্সর বোর্ডের কাঁচি চালানো নতুন নয়। কিন্তু, এ তো তথ্যচিত্র। যেখানে অমর্ত্য সেন নিজের মতামত ব্যক্ত করছেন। তাই এর উপর কাঁচি চালানো মানে তো, তাঁর মতামতের ওপর কাঁচি চালানোর চেষ্টা। এও সম্ভব?