ব্লগ : শাসক এবং তাঁদের ক্ষমতা : এক নীতিগল্পের দুই অধ্যায়
বর্তমান ভারতেও রয়েছেন মহম্মদ তুঘলক। তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতালোভী হিসাবে পরিচিত। তিনি কীভাবে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করেছেন তা এখন গোটা পৃথিবী জানে। এমনকী বিজেপির কয়েকজনও তা বোঝেন। যদিও তাঁদের জনসমক্ষে বলার কোনও সাহস নেই।
মহম্মদ তুঘলক। চতুর্দশ শতকের দিল্লির সুলতান। একজন কঠোর, গোঁড়া অথচ উদার শাসক ছিলেন। খামখেয়ালিপনা আর ক্ষমতার নৃশংস প্রয়োগের জন্য ছিল তাঁর পরিচিতি। তাঁর শাসনকালের সবথেকে বিশ্বস্ত ও পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় মরক্কোর পরিব্রাজক ইবন বতুতার লেখা থেকে। তিনি সুলতানের রাজসভায় ছয় বছর ছিলেন। ইবন বতুতা লক্ষ্য করেছিলেন, "এই সুলতানের উপহার দেওয়া আর রক্তপাতে আসক্তি বেশি।" পরের ৩০ পাতা ধরে ইবন বতুতা বর্ণনা করেছেন সুলতান কীভাবে অভিজাতদের, মূলত বিদেশিদের উপহার দিয়েছেন। আর যাঁরা তাঁর সঙ্গে সহমত হননি সুলতান তাঁদের কীভাবে শাস্তি দিয়েছেন, তার ভয়ংকর বিবরণও আছে।
তুঘলক দিল্লির বুকে কী ধ্বংসলীলা চালিয়েছেন, তা ইবন বতুতার বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। দিল্লি, তখন এবং এখনকার রাজধানী। এখানকার নাগরিকরা সুলতানের রক্তপাতের প্রবণতায় ক্ষুব্ধ হয়ে "তাঁকে অপমানপত্র" পাঠাতেন। এবং এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুলতান একবার প্রত্যাঘাত হিসাবে পুরো শহরটাকে নষ্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দিল্লির বাসিন্দাদের উদ্দেশে আদেশ দেন, তাঁরা যেন শহর ছেড়ে দৌলতাবাদে চলে যান। যার দূরত্ব দক্ষিণের দিকে প্রায় হাজার মাইল। যেখানে সুলতান নতুন রাজধানী তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইবন বতুতা লিখেছেন, সুলতান তাঁর দাসদের দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়েছিলেন এটা নিশ্চিত করতে যে প্রত্যেকে তাঁর আদেশ মানছেন। ওই ভৃত্যরা দুজনকে রাস্তায় টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল। এই দুইজন লুকিয়ে পড়েছিলেন। এঁদের মধ্যে "একজন পঙ্গু এবং অন্যজন অন্ধ" ছিলেন। পঙ্গু ব্যক্তিটিকে ম্যাঙ্গোনেল(মধ্যযুগে দুর্গের দেওয়ালে কোনও কিছু নিক্ষেপ করার জন্য ব্যবহৃত ইঞ্জিন) থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। এবং অন্ধ ব্যক্তিটিকে দিল্লি থেকে টানতে টানতে দৌলতাবাদে ("৪০দিনের যাত্রাপথ") নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যাত্রাপথে অন্ধ মানুষটির শরীর টুকরো টুকরো হয়ে পড়তে থাকে। "দৌলতাবাদে পৌঁছায় তাঁর পা।" এদিকে সুলতান তাঁর দিল্লির রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে দেখতেন যে কোনও ঘরে "আগুন বা বাতি বা ধোঁয়া" জ্বলছে কি না। আর বলতেন, "এখন আমার মন শান্ত এবং আমি তৃপ্ত।" দুই বছর পর তুঘলক প্রত্যেককে দৌলতাবাদ থেকে দিল্লি ফিরে আসতে আদেশ দেন।
বর্তমান ভারতেও রয়েছেন মহম্মদ তুঘলক। তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার প্রতি আসক্তির জন্য পরিচিত। অনেকে অভিযোগ করেন, নিজের জায়গীরের মতো তিনি দেশ পরিচালনা করেন। তিনি কীভাবে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করেছেন তা এখন গোটা পৃথিবী জানে। এমনকী বিজেপির কয়েকজনও তা বোঝেন। যদিও তাঁদের জনসমক্ষে বলার কোনও সাহস নেই। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সতর্কবার্তা ছিল। কিন্তু, তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ঘৃণা করেন। তাই গোটা বিশ্বের কাছ থেকে এখন করুণা আর উদ্বেগের বার্তা। যা অবহেলা করছেন তিনি(প্রধানমন্ত্রী) এবং তাঁর মন্ত্রীরা। ভারতে এখন বেশ কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন ৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর পাশাপাশি ভাইরাসও বিভিন্ন শহর ও গ্রামে হানা দিচ্ছে। এই বছরেরই গোড়াতে মোদি বুক বাজিয়ে জয়ের ঘোষণা করে বলেছিলেন, ভারত ভাইরাসকে শুধু জয়-ই করেনি, বাকি বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে।
আরও অনেক মিল একসূত্রে বেঁধেছে চতুর্দশ শতকের সুলতানের সঙ্গে একবিংশ শতকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাকে। টাকা নিয়ে দুই শাসকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাথায় আসে। সুলতান সবসময় টাকা চাইতেন। তিনি শুনেছিলেন চিনে কাগজের টাকা তৈরির কথা। তাই শুনে তিনি ভেবেছিলেন, তামা দিয়ে নিজের রাজত্বে একই কাজ করবেন। ইলিয়াস ক্যানেত্তি-র ক্রাউডস অ্যান্ড পাওয়ার অনুযায়ী, "তিনি প্রচুর তামার কয়েন জড়ো করে রেখেছিলেন, নির্বাচারে সেগুলি রুপোর কয়েনে পরিণত করেন এবং সোনা ও রুপোর পরিবর্তে সেগুলি ব্যবহার করতে বলেন।" খুব দেরি হওয়ার আগেই, নতুন টাকার মূল্য কমে যায়। তামার কয়েন আর নুড়ির মূল্য সমান হয়ে ওঠে। এবং "টাকার তীব্র অভাব" দেখা দেয়। মোদিরও একইরকম মানসিকতা। দেশকে কালো টাকা মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে নেমে তিনি দেশকে স্তব্ধ করে দেন। ২০১৬-র ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঘোষণা করেন, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল। তার পরিবর্তে ব্যাঙ্কের নতুন নোট আসবে। তাঁর নোট বাতিলের ঘোষণা দেশকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দেয়। নোটের ঘাটতি দেখা দেয়। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁরা ক্যাশ টাকার উপর নির্ভরশীল তাঁরা সমস্যায় পড়েন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত বিশাল ব্যর্থতা। ৯৯.৩ শতাংশ বাতিল নোট ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, অর্থনীতি থেকে কালো টাকা সরানো গেল না।
কাজ চলছে সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পে, ফোটো-ভিডিওয় নিষেধাজ্ঞা
যাইহোক, মুসলিম সুলতান মহম্মদ তুঘলক এবং মোদির মধ্যে সূক্ষ্ম মিলের জায়গাটা দেখাতে গেলে দিল্লিকে শাহি রাজধানী করার মোদির যে বিশাল প্রকল্প তার দিকে নজর দিতে হবে। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে চেয়েছেন মোদি। তুঘলক যেখানে দিল্লির ‘অবাধ্য’ নাগরিকদের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন শহর ছাড়ার ব্যবস্থা করে, মোদি দিল্লিবাসীর ওপর সেন্ট্রাল ভিস্তা নামক প্রকল্প চাপিয়ে সে শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সরকারি দপ্তর, সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট এবং বিশাল সংসদ ভবন তৈরির বিষয়। প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে এবং গঠনকার্য শুরু হয় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। মোদি বিষয়টির ওপর সিলমোহর দেন এই বলে, ১০০ বছরের পুরনো। বিশেষ করে ভারতীয় সংসদভবনটি এবং যা বর্তমান সময়ের জন্য অনুপযুক্ত।
ভয়ংকর সমালোচনার মুখে পড়েছে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প।’ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বিশেষ করে যখন ভারতীয় অর্থনীতিতে স্থিতাবস্থা নেই, তখন এই ধরণের প্রকল্পের আদৌ এখন কোনও প্রয়োজন ছিল কি না । এবং যেখানে যে কোনও বড় দেশের থেকে করোনা অতিমারিতে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। ২০২০ সালে ভারতের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৯.৬ শতাংশে। সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের প্রস্তাবিত খরচ প্রায় কুড়়ি হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ এমন এক দেশে, যেখানে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং যা দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম। অন্যরা আপত্তি জানিয়েছেন আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করেও। তাঁদের মতে, এ্ডউইন লুটিয়েনস এবং হারবার্ট বেকারের নকশাকৃত ইমপেরিয়াল কমপ্লেক্সের স্থাপত্যশৈলীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে নতুন এই প্রকল্প।
দিল্লিতে বিশাল এই স্থাপত্যের উত্তরাধিকার সৃষ্টির মাধ্যমে প্রায় দিল্লির সুলতানদের মতো, মুঘল সম্রাট এবং ব্রিটিশ শাসকদের মতো তাঁর নিজস্ব ছাপ দেশের ওপর রাখতে চাইছেন মোদি। তা সে হাজারো ভারতীয়র জীবনদানের বিনিময়ে হলেও। দিল্লিতে চব্বিশ ঘণ্টা চিতা জ্বলছে। ভেন্টিলেটরের আকাল, অ্যাম্বুলেন্স নেই, হাসপাতালে বেড নেই, নেই ওষুধ, পিপিই কিট, ঘাটতি ডাক্তার, নার্সের। হাজার হাজার মানুষ শ্বাস নেওয়ার জন্য আকুল, অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি। আর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে। দিল্লি আবার লকডাউনের আওতায়। তবুও, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রখ্যাত ইংরেজি সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছে , “India’s descent into Covid hell”। তবুও কাজ চলছে দিনরাত। নরেন্দ্র মোদির রাজকীয় আদেশবলে ‘অত্যাবশকীয়’ পরিষেবা দিয়ে চলেছে শ্রমিকরা। মানুষের জীবনে এর থেকে বড় ঠাট্টা আর কি হতে পারে ?
(বিশেষ দ্রষ্টব্য - উপরিউক্ত লেখাটির পরিসংখ্যান, দাবি ও মতামত লেখকের নিজস্ব। এবিপি লাইভের সম্পাদকীয় কোনওরকম প্রভাব এতে নেই। লেখাটির বিষয়ে এবিপি কোনওরকম মত পোষণ করে না।)