Indian Cricket News: ভারতের বিশ্বজয়ের নেপথ্যে বাঙালি কোচ, কীভাবে তৈরি হয়েছিল মুকুটরক্ষার নকশা?
Rajib Dutta: ভারতের মেয়েদের এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে এক বাঙালি কোচের মগজাস্ত্রও। যিনি নিজে বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন।

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: অভিজ্ঞরা বলেন, সিংহাসনে বসা কঠিন। সিংহাসন ধরে রাখা আরও কঠিন।
সেই কঠিন কাজই করে দেখিয়েছেন ভারতের মেয়েরা। ২০২৩ সালের পর ফের অনূর্ধ্ব ১৯ টি-২০ বিশ্বকাপ জিতেছে। ফাইনালে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে কার্যত একপেশেভাবে হারিয়েছে টিম ইন্ডিয়া (Team India)।
ভারতের মেয়েদের এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে এক বাঙালি কোচের মগজাস্ত্রও। যিনি নিজে বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটার হিসাবে যতটা স্বপ্ন দেখেছিলেন, পূরণ হয়নি। সব আক্ষেপ কোচ হিসাবেই যেন মিটিয়ে নিচ্ছেন। পরপর দুবার ভারতের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অন্যতম কোচ রাজীব দত্ত (Rajib Dutta)। আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেন। তবে ছাত্রীদের জোড়া ট্রফি তাঁকে প্রচারের আলোয় এনেই ছেড়েছে।
কুয়ালা লামপুর থেকে ফিরে আপাতত কলকাতায় ছুটি কাটাচ্ছেন। তার মাঝেই আড্ডা জমালেন এবিপি আনন্দের সঙ্গে। রাজীব বললেন, '২০২৩ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ মেয়েদের ঘরোয়া টি-২০ টুর্নামেন্ট চলার সময়ই পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে। আমি এবং অপূর্ব দেশাই নির্বাচকদের সঙ্গে নিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরেছিলাম। মেয়েদের ম্যাচ দেখে ৫-৬ জনকে চিহ্নিত করে রেখেছিলাম।'
মহিলা ক্রিকেটে দেশের উঠতি প্রতিভা তুলে আনতে রাঁচি, পুঁদুচেরি-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে আঞ্চলিক শিবির হয়েছিল। রাজীব বলছেন, 'নিজেদের মধ্যে দল তৈরি করে ম্যাচ খেলানো হয়েছিল। তারপর মোট ২৫-৩০ জনকে নিয়ে ধর্মশালায় প্রথম শিবির হয়েছিল গত বছরের জুন মাসে। একমাসের জন্য ধর্মশালায় শিবির হয়েছিল। হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট সংস্থা পুরো মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল। মেয়েদের জন্য পুরো মাঠ পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে গ্রীষ্মকালেও মনোরম আবহাওয়া, সেই কারণেই ধর্মশালাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল শিবিরের জন্য।'
দলগঠন করলেন কীভাবে? পরিকল্পনা কীভাবে তৈরি করেছিলেন? রাজীব বলছেন, 'আমরা একটা চ্যালেঞ্জার্স টুর্নামেন্ট করেছিলাম। ৫২ ক্রিকেটারকে ৪ দলে ভাগ করে খেলানো হয়েছিল। যে সমস্ত ক্রিকেটারদের চোখে পড়েছিল, সকলকেই সুযোগ দেওয়া হয়। ব্যাটার, বোলার, উইকেটকিপার, বিভিন্ন বৈচিত্রময় বোলারদের সব দলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুযোগ দেওয়া হয়। সেই টুর্নামেন্ট থেকেই ক্রিকেটারদের বাছাই করার কথা ছিল। সেই চ্যালেঞ্জার্স হয় রাজকোটে। সেখানে আমি ও অপূর্ব দেশাই তো ছিলামই, গিয়েছিলেন ভি ভি এল লক্ষ্মণও। সেই টুর্নামেন্ট থেকে সেরা ১৮ জনকে বাছাই করে নিই।'
দল বাছাই হয়ে গেলেও দুটো জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছিল। যদি নতুন কাউকে চোখে পড়ে, সেখানে নেওয়া হবে বলে। চ্যালেঞ্জার্সের পর সব ক্রিকেটারকে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে প্রত্যেককেই চোখে চোখে রাখা হয়েছিল। তারপর ১৫ জনকে নির্বাচন করে বেঙ্গালুরুতে প্রস্তুতি শিবির করা হয়। সঙ্গে ৩ জনকে রাখা হয় স্ট্যান্ড বাই হিসাবে। তখনও পর্যন্ত কথা ছিল, অনূর্ধ্ব ১৯ এশিয়া কাপ হবে শ্রীলঙ্কায়। আর টি-২০ বিশ্বকাপ হবে মালয়েশিয়ায়। তবে বেঙ্গালুুরুর শিবির চলাকালীনই জানা যায় যে, বিশ্বকাপ যেখানে হবে, সেই মালয়েশিয়াতেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এশিয়া কাপ। রাজীবের কথায়, 'তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, বিশ্বকাপের দলকেই খেলানো হবে এশিয়া কাপে। অক্টোবর মাসে সেই সিদ্ধান্ত হয়।'
টি-২০ বিশ্বকাপে ভারতীয় ক্রিকেটারেরা যেন আত্মবিশ্বাসে টগবগ করেছেন। তাঁর রহস্যও ফাঁস করলেন রাজীব। বললেন, 'প্রত্যেকের ভূমিকা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কাকে কেন দলে নেওয়া হয়েছে, কার মাঠে কী ভূমিকা থাকবে, সব বলে দেওয়া হয়। এমনকী, প্রত্যেক ব্যাটার বা বোলারকে বলে দেওয়া হয়েছিল, ওভার ধরে ধরে কার কী কাজ। যেমন ১-৬ ওভার কোন ব্যাটারকে কী করতে হবে, কিংবা, প্রথম ২ ওভার কীভাবে এগনো হবে, সব খুঁটিয়ে বলে দেওয়া হতো। অপূর্ব ব্যাটারদের পরিকল্পনা করেছিল, আমি বোলার ও ফিল্ডারদের জন্য নকশা তৈরি করেছিলাম।'
মহিলাদের ক্রিকেটে ধারণা হল, একজন মহিলাকেই হেড কোচ করা হবে। সেই জন্য নুশিন আল খাদিরকেই দায়িত্বে রেখে দেওয়া হয়। সঙ্গে একজন ফিল্ডিং কোচ নিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি ফিজিও, ট্রেনার মিলিয়ে একটা দল তৈরি করা হয়েছিল।
এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে পুণেতে একটা সিরিজ খেলে ভারত। তারপরই চূড়ান্ত একাদশ বাছাই হয়। পুণে থেকেই কুয়ালা লামপুরে এশিয়া কাপ খেলতে উড়ে যায় দল। রাজীব বলছেন, 'এশিয়া কাপে সমস্ত পরীক্ষা করা হয়। প্রত্যেক ম্যাচে ৪-৫ জন করে ক্রিকেটার পরিবর্তন করা হয়। ১৫ জনকে চূড়ান্ত করে ফেলা হয়।'
অনূর্ধ্ব ১৯ টি-২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। এবার ছিল খেতাবরক্ষার লড়াই। যে লড়াই মোটেও সহজ ছিল না। রাজীবের কথায়, 'আগেরবারের দলে তিতাস সাধু, শ্বেতা শেরাওয়াত, শেফালি বর্মা ও রিচা ঘোষ ছিল। এরা প্রায় সবাই পরে সিনিয়র ক্রিকেট খেলেছে। কিন্তু এবার ওরা ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম, এমন ক্রিকেট খেলব যে, সকলে আমাদের ভয় পায়। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এমন ভয়ডরহীন খেলব যাতে প্রতিপক্ষ মাঠে আসার আগে ভাবতে বাধ্য হয় যে, আমাদের সামলাবে কী করে। তাতে ৪০ রানে অল আউট হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। পরের দিন ২০০ করার জন্য ঝাঁপাব। প্রতিপক্ষকে ৬০ রানে অল আউট করে দেওয়ার জন্য ঝাঁপাব। এশিয়া কাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ওই মাঠেই বিশ্বকাপের সব ম্যাচ খেলেছি, তাতে সুবিধা হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাদের নখদর্পণে ছিল।'
রাজীব আরও বললেন, 'বিশ্বকাপে ফেভারিট হিসাবেই আমরা খেলতে নামি। আমাদের মেয়েদের শরীরী ভাষা দেখে সকলেই ভাবত। প্র্যাক্টিসে কারও মধ্যে কোনও স্নায়ুর চাপ থাকত না। বিশ্বকাপে একটা ম্যাচ বাদ দিয়ে আমাদের ৫ নম্বরকে ব্যাট করতেই নামতে হয়নি। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ড ছাড়া আমাদের বিরুদ্ধে কেউ একশো রানও করতে পারেনি।'
বাঙালি কোচ অবশ্য কৃতিত্ব দিচ্ছেন ছাত্রীদেরই। 'কৃতিত্ব মেয়েদেরই। পরিকল্পনা করা আমাদের কাজ। সেগুলো মাঠে নেমে সফলভাবে প্রয়োগ করেছে মেয়েরাই,' বলছিলেন রাজীব।
মেয়েদের এত আত্মবিশ্বাসের নেপথ্যে কী? রাজীব বলছেন, 'মানসিক জোর তখনই আসে যখন একজন নিজের ভূমিকা নিয়ে খুব ভাল করে জানে। একজন মনোবিদ প্রত্যেক মেয়ে কে কী ভালবাসে তার তালিকা তৈরি করে দিয়েছিল। মেয়েদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যে যেভাবে খেলতে ভালবাসে, সেভাবেই খেলানো হয়েছে। স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এতে ওরা অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছিল।'
তবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের মেয়েরা যাতে হারিয়ে না যায়, তার জন্য পাঁচ বছর বোর্ডের সেন্টার অফ এক্সেলেন্সের তত্ত্বাবধানে রাখা হবে সকলকে। তিতাস, শ্বেতারা এভাবেই বোর্ডের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছেন। রাজীব বলছেন, 'ভারতের সিনিয়র দলের সাপ্লাই লাইনে এরাই থাকবে। ৩৬৫ দিন ওদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। কে কী খাচ্ছে, কীরকম ট্রেনিং করছে, কীরকম পারফর্ম করছে, সব দেখা হবে।'
ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ ট্রফি তুলে দেন মেয়েদের হাতে। পরে ড্রেসিংরুমে এসে রাজীব-সহ সকলকে অভিনন্দনও জানান। বোর্ডের সচিব দেবজিৎ সাইকিয়া এসে পুরস্কার অর্থ ঘোষণা করেছিলেন। দুজনই চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের বলেছেন, সকলকে সিনিয়র দলে দেখতে চান তাঁরা।
আপাতত কলকাতায় রয়েছেন রাজীব। তবে সিএবি থেকে কেউ কোনও অভিনন্দন জানাননি। জোড়া বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে অবশ্য কোনও আক্ষেপ পুষে রাখতে নারাজ মধ্য পঞ্চাশের বাঙালি কোচ।
আরও পড়ুন: 'সৌরভও বিনিয়োগ করছে', বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে আর কী বললেন মমতা?
ট্রেন্ডিং
সেরা শিরোনাম
