Syed Nayeemuddin Exclusive: ময়দান থেকে অনেক দূরে ভারতীয় ফুটবলের প্রথম ‘দ্রোণাচার্য’, সঙ্গী হতাশা আর অভিমান
Teacher's Day 2021 Special: ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো দিনে ১৬ ঘণ্টা অনুশীলন করে আর আমি দু’বেলা অনুশীলনের কথা বললেই অনেক সুপারস্টারের রাগ হয়, বলছেন সৈয়দ নইমুদ্দিন।
কলকাতা: ফোন ধরে প্রথমেই বললেন, ‘পাঁচ কোটি টাকা লাগবে। ১০ কোটি টাকা দিতে হবে।’তারপরেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমি লটারির টিকিট কাটছি, আপনিও কাটুন। লটারি পেলে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দেবেন।’
ভারতীয় ফুটবলের প্রথম ‘দ্রোণাচার্য’ সৈয়দ নইমুদ্দিন এখন ময়দান থেকে অনেক দূরে। তাঁর সঙ্গী নিঃসঙ্গতা, একরাশ অভিমান আর হতাশা। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান স্পোর্টিং, ভারতীয় দল, বাংলাদেশের ব্রাদার্স ইউনিয়নের কোচ হিসেবে অনেক সাফল্য পেয়েছেন। তাঁর কোচিংয়ে খেলে অনেক তরুণই পরবর্তীকালে তারকা হয়ে উঠেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ফুটবলারই এই কোচকে মনে রাখেননি।
ভারতীয় ফুটবলের এক সুপারস্টারের সঙ্গে নইমুদ্দিনের মতবিরোধের কথা সবারই জানা। সে প্রসঙ্গে এই বর্ষীয়ান কোচ বলছেন, ‘আমি সবসময় ডিসিপ্লিনের কথা বলি বলে আমার ওপর অনেকের রাগ। আরে বাবা, আমি তো নিজের জন্য কিছু চাই না। আমি চাই ফুটবলাররা টাকা পাক, ভাল খাবার পাক। আমি সবসময় ফুটবলারদের জন্য ভাল খাবার, ভাল ফল, ফুড সাপ্লিমেন্টের কথা বলে এসেছি। আগে ফুটবলারদের মিনারেল ওয়াটারও দেওয়া হত না। আমি মিনারেল ওয়াটার দিতে বলতাম। আর ডিসিপ্লিন ছাড়া সাফল্য পাওয়া যায় না। বিশ্বকাপে যে দলগুলি খেলে, তারা মিলিটারি ডিসিপ্লিন মেনে চলে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বলেছে, ও দিনে ১৬ ঘণ্টা অনুশীলন করে। আর আমি দু’বেলা অনুশীলনের কথা বললেই অনেকে রেগে যায়। যারা ডিসিপ্লিন মেনে চলে না, তাদের তো কেউ সাফল্য পেতে বারণ করেনি। বিশ্বকাপ খেলে দেখাও না, আমি খুশি হব। ফুটবলারদের ভালর জন্যই ডিসিপ্লিন মেনে চলতে বলি। কিন্তু তার জন্য অনেকের কাছ থেকেই আঘাত পেয়েছি।’
নিজে বিখ্যাত ফুটবলার ও কোচ। ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যেই একমাত্র তিনিই অর্জুন পুরস্কার ও দ্রোণাচার্য সম্মান পেয়েছেন। ছোটবেলায় বা পরবর্তীকালে গুরু হিসেবে কাদের পেয়েছিলেন? নইমুদ্দিন জানালেন, ‘ছোটবেলায় আমার বাবাকে দেখেছি। তিনি দারুণ ফুটবলার ছিলেন। বেঙ্গালুরুতে সেই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খেলতেন আমার বাবা। স্কুলে পড়ার সময় এনায়েতুল্লাহ খান, রহমতুল্লাহ খান সাহেবকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। কলকাতায় খেলতে এসে জ্যোতিষ গুহ সাহেবকে দেখেছি। তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় আমি বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলাম। জ্যোতিষ গুহ সাহেব সবসময় আমাদের পাশে থাকতেন। পরবর্তীকালে অরুণ সিনহা, অমল দত্তকে পেয়েছি। প্রদীপদা (বন্দ্যোপাধ্যায়), চুনীদার (গোস্বামী) মতো ব্যক্তিত্বরাও ছিলেন।’
নিজে যখন খেলতেন সেই সময়েও ভারতীয় দল আন্তর্জাতিক স্তরে বড় দলগুলির সঙ্গে লড়াই করত। কিন্তু তারপর ভারতীয় ফুটবল কেন পিছিয়ে পড়ল? নইমুদ্দিন বলছেন, ‘আমাদের সময় বিশ্বমানের সব ফুটবলার ছিলেন। তারপর আমরা প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারিনি। কোচ-ফুটবলারদের কোনওরকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি। আমি ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে সাফল্য পেয়েছি, কারণ, জীবন চক্রবর্তী, পল্টু দাসরা আমার কাজে নাক গলাতেন না। আমি যা চাইতাম, তাঁরা সেটাই দিতেন। তাঁরা আমাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন। তার ফলেই সাফল্য এসেছে। মোহনবাগান, মহমেডানের কোচ হিসেবেও সাফল্য পেয়েছি। আমার সময়ে ভারতীয় দল তিনবার সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিন্তু অনেক সময়ই আমি কোচিং করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছি। এটা কেন লাগবে, ওটা কেন লাগবে? শুধু এসব প্রশ্ন করেন কর্মকর্তারা। কোনওরকম সম্মান পাওয়া যায় না। ফুটবলারদের সুযোগ-সুবিধা দিতে বললেই কর্মকর্তাদের রাগ হয়। ফুটবলাররা টাকা, সুযোগ-সুবিধা না পেলে দলকে কীভাবে সাফল্য এনে দেবে? খেতে দেবে না, টাকা দেবে না, শুধু গালাগালি দেবে। আমি হতাশ। দুঃখ পেয়েছি।’
যাঁদের কোচিং করিয়েছেন, তাঁরা এখন যোগাযোগ রাখেন? শিক্ষক দিবসে কারও ফোন পান? হতাশ গলায় নইমুদ্দিন বললেন, ‘বাংলাদেশের ফয়সাল মাহমুদ আমাকে খুব সম্মান জানায়। ও একবার আমাকে বলেছিল, আপনি বিশ্বের সেরা কোচ। অমিত দাস চাকরি পাওয়ার পর ওর মা এসে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। এখন আর কেউ সেভাবে যোগাযোগ রাখে না। ময়দান থেকে আমি অনেক দূরে। এখনও পুরনো ভাঙা স্কুটার নিয়ে ঘুরে বেড়াই দেখে অনেকে হাসে। কিন্তু আমি ছেলেদের কাছ থেকে টাকা নিতে চাই না। এখনও কোচিংয়ের প্রস্তাব পাই। কিন্তু সম্মান না পেলে কোথাও কোচিং করাতে চাই না। আমার সম্মান আর ফুটবলারদের জন্য সুযোগ-সুবিধা চাই। সেই কারণেই লটারির টিকিট কাটতে চাইছি। লটারিতে অনেক টাকা পেলে নিজে অ্যাকাডেমি খুলব।’
বাংলাদেশের ব্রাদার্স ইউনিয়নের কোচ থাকাকালীন ফয়সাল মাহমুদকে দলে পেয়েছিলেন নইমুদ্দিন। এই ফুটবলারের প্রশংসা করে তিনি বললেন, ‘ও কর্নার থেকে সরাসরি গোল করেছিল। দুর্দান্ত ফুটবলার।’ পাল্টা কোচের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফয়সাল বললেন, ‘উনি আমার সর্বকালের সেরা ওস্তাদ। আমি ওঁকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করি। ওঁর কাছ থেকে অনেককিছু শিখেছি। তিনি শুধু আমার কোচই ছিলেন না, সারাজীবনের মেন্টর। তিনি দীর্ঘজীবী হোন।’