Bardhaman News: ২০% রফতানি শুল্ক নিচ্ছে কেন্দ্র, মড়াইয়ে ঘুণ ধরছে বিশ্বমানের গোবিন্দভোগ ধানে, চোখের জল ফেলছেন কৃষকরা
Gobindobhog Rice: চলতি খরিফ মরশুমে গোবিন্দভোগ ধান যেখানে কুইন্টাল প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ টাকায়, সেখানে রত্না সহ অনান্য প্রজাতির আমন ধান কৃষকদের বিক্রি করতে হচ্ছে ১৯৫০-২০০০ টাকায়।
কমলকৃষ্ণ দে, বর্ধমান: ফসল রফতানিতে চড়া শুল্কের হার। তার মাশুল গুনছেন কৃষকরা। তাই উন্নতমানের, জিআই প্রাপ্ত (জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি) গোবিন্দভোগ ধান এবং চাল উৎপাদন করলেও, বিদেশে রফতানি করতে পারছেন না তাঁরা। ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন পূর্ব বর্ধমানের কৃষকরা। শস্যগোলা কার্যত কাঁদছে। ফসল বিক্রি করতে না পেরে ভেঙে পড়েছেন কৃষকরা।
চলতি খরিফ মরশুমে গোবিন্দভোগ ধান যেখানে কুইন্টাল প্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ টাকায়, সেখানে রত্না সহ অনান্য প্রজাতির আমন ধান কৃষকদের বিক্রি করতে হচ্ছে ১৯৫০-২০০০ টাকায়। দেশ এবং বিদেশের বাজারে বাড়তি চাহিদা ও মূল্য বেশি থাকার কারণে গত তিন দশক ধরে সাধারণ আমন ধান চাষের বদলে, গোবিন্দ ভোগ ধান চাষই ‘নির্ভরযোগ্য’ হয়ে উঠেছে কৃষকদের কাছে।
পূর্ব বর্ধমান,বাঁকুড়া, হুগলি এবং পূর্ব মেদিনীপুরের একৃষকরা তাই এক নাগাড়ে গোবিন্দভোগ ধানই চাষ করে আসছিলেন। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইউরোপ-সহ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় গোবিন্দভোগ চালের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। যে কারণে প্রতি মরশুমেই সাধারণ আমন ধানের চেয়ে গোবিন্দভোগ ধানের দাম কুইন্টাল প্রতি অন্তত ১৫০০ টাকা বেশি থাকে। কিন্তু এ বছর সেই দাম প্রায় সমান সমান। এর উপর আবার বাড়তি সমস্যা তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন রফতানি নীতি।
এই নয়া রফতানি নীতি অনুযায়ী, ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে ফসল রফতানিতে। কৃষকদের অভিযোগ, কেন্দ্রের শুল্কনীতির জেরে রফতানি আটকে গিয়েছে। অতিরিক্ত দামের জন্যে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতেও গোবিন্দ ভোগের চাহিদা কম থাকায়, ধান কিনতে পারছে না তারাও। সেই কারণে সুগন্ধী ধানের দাম পড়তির দিকে। গত বছর জমি থেকে ওঠা আমন ধান ২৮০০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করেছিলেন কৃষকরা। সেখানে এ বার মিলছে ২২০০ থেকে ২৩০০ টাকা। পুরনো ধানের দর ছিল ৩৮০০ টাকা। সেই ধানই বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ টাকায়।
পূর্ব বর্ধমান, দক্ষিণ দামোদর এলাকা বলে পরিচিত রায়না ১,রায়না ২, খণ্ডঘোষ এবং জামালপুর ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চাষ হয় এই সুগন্ধী গোবিন্দভোগ ধানের। রাজ্যের গোবিন্দ ভোগ ধানের ‘গোলা’ বলা হয় এই এলাকাকে। এই এলাকার প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয় এই ধানের। উৎপাদন হয় প্রায় ১.৯০ লক্ষ টন গোবিন্দভোগ ধান। নতুন গোবিন্দ ভোগ ধানের চেয়ে বাজারে পুরনো ধানের কদর বেশি। স্বভাবতই দামও বেশি হয়। কিন্তু কেন্দ্রের নতুন রফতানি নীতির জন্য গত বছরেই অন্তত ৬০% ধান এখনও চাষির ঘরে পরে রয়েছে।
দক্ষিণ দামোদরের গোবিন্দভোগ ধানচাষীরা জানান, এক বিঘা জমিতে গোবিন্দ ভোগ চাষ করতে প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। সেই খরচই তুলতে পারছেন না তাঁরা। গত বছরের ধান এখনও বাড়ির মড়াইয়ে পড়ে রয়েছে। তার উপর আবার নতুন ধানও জমবে। রফতানি একপ্রকার বন্ধ থাকায় ধান কেনার খরিদ্দারও নেই।
দক্ষিণের বাজারে বিরিয়ানি তৈরির মূল উপাদান ছিল গোবিন্দ ভোগ। অতিরিক্ত দামের জন্যে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা গোবিন্দ ভোগের বদলে মহারাস্ট্রের ‘কলম’ চাল ব্যবহার করছেন। এর ফলে বাজারে কিছুটা চাহিদা কমেছে। তার উপর কেন্দ্রের রফতানি নীতির জেরে গোবিন্দ ভোগের বিদেশে যাওয়া আটকে গিয়েছে।
দক্ষিণ দামোদরের চালকলের উপর পূর্ব বর্ধমান ছাড়াও বাঁকুড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুরের একাংশ কৃষক নির্ভরশীল এই গোবিন্দভোগের উপর। রফতানি বন্ধ হওয়ায় চালের চাহিদা নেই। তাই রাইসমিলগুলিও ধান কিনতে পারছে না। কৃষকরা ধানের দাম পাচ্ছেন না। রফতানি চালু না হলে ধানের দাম আরও কমে যাবে। ১৯৯১ সালে গোবিন্দ ভোগ দাক্ষিণাত্যে জয়ের জন্যে বেরিয়েছিল। সেই বাজার দখলের পরে ২০০১ সাল থেকে বিদেশের মাটিতে গোবিন্দ ভোগের যাত্রা শুরু হয়। এ বারের মতো আশঙ্কা আগে কখনও তৈরি হয়নি।
রায়না ১ নং পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ বামদেব মণ্ডল বলেন, "কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মানুষ মারার কল করেছে। ছলে, বলে, কৌশলে গরিবদের মেরে পুঁজিপতিদের দালালি করছে। দক্ষিণ দামোদরের যে গোবিন্দভোগ ধান দেশ ও বিদেশে সমাদৃত, সেই ধানেরই রফতানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে খামখেয়ালি কেন্দ্রীয় নীতির জন্য।এর ফলে শস্যগোলার কৃষক চোখের জল ফেলছেন।"
পশ্চিমবঙ্গ ধান্য ব্যবসায়ী সমিতির বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক তথা রাজ্য কমিটির আহ্বায়ক বিশ্বজিৎ মল্লিক বলেন, "প্রথমত, কৃষকের ক্ষতি মানে আমাদের সমাজের ক্ষতি। কৃষক আমাদের অন্নদাতা। এবছর গোবিন্দভোগ ধানের দাম অনেক কম। এই কারণটা যতদূর সম্ভব আমরা জানি, কেন্দ্রীয় সরকার একটা শুল্ক চাপিয়েছে এক্সপোর্টের ওপর। গোবিন্দভোগ চালটা মূলত রফতানি করা হয় আরব দেশগুলিতে। আমেরিকা এবং ইউরোপীয় কিছু দেশেও যায়। সেই রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, রাইস মিলের মালিকরাও ধান কেনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।"
কেন্দ্রীয় সরকারের এই শুল্ক নিয়ে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত ব্যবসায়ী সমিতির। তাদের মতে, রফতানি শুল্ক ২০ শতাংশ হয়ে যাওয়ায়, আমদানিকারীদের সঙ্গে রফতানিকারীদের দাম মিলছে না। জেলার রাইস মিলগুলির ২০ শতাংশ এই মুহূর্তে চলছে। ৮০ শতাংশ বন্ধ। এ বছর এ বছর ধানের উৎপাদনও কম হয়েছে, বিঘে পিছু ১০ বস্তার পরিবর্তে ৮ বস্তা থেকে সাড়ে ৮ বস্তা করে। এই মুহূর্তে ধানের দাম বস্তা পিছু পিছু ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ২৮০০-৩০০০ টাকা। অর্থাৎ এ বছর চাষের খরচই উঠছে না। মড়াইয়ে পড়ে রয়েছে ধান এবং চাল।