Durga Puja 2021 Exclusive: দশমীতে 'বাড়ির মেয়ে'কে নবমীর রাঁধা ভোগ অর্পণ, গান গেয়ে মা দুর্গাকে বিদায় জানায় চট্টোপাধ্যায় পরিবার
দশমীর দিন দেবীর দুর্গাকে পান্তা ভোগ দেওয়া। বলা যেতে পারে দেবীর অরন্ধন।
কলকাতা : চোরবাগানের চট্টোপাধ্যায় পরিবার। কলকাতার ইতিহাসে এই পরিবারের নাম জ্বলজ্বল করছে। এই পরিবার এক সময় ছিল শিক্ষা-সংষ্কৃতি-সঙ্গীতচর্চার পীঠস্থান। আজও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। একই নিয়ম মেনে স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে আজও এই দালানে চলছে দশপ্রহরণধারিনীর পুজো। উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সুবিশাল বাড়ি। কথিত আছে, রামচন্দ্র স্ত্রী দুর্গাদাসীর পরামর্শে বাড়ির ঠাকুরদালানে ১৮৬০ সালে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। পরিবার সূত্রে জানা যায়, অসুরের কোমরবন্ধে এই সালেরই উল্লেখ আছে। ইংরেজ আমলে ব্যবসা করে বিশাল আয় ও প্রভাব তৈরি করেছিলেন তিনি। এরপর চোরবাগান অঞ্চলে এই বাড়ি তৈরি করেন তিনি।
সেই অনুসারে ১৬০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে এই পরিবারের পুজোর। পরিবারের অন্যতম প্রবীণ সদস্য অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায় জানালেন,এই বাড়িতে কাঠামোপুজো অনুষ্ঠিত হয় জন্মাষ্টমী তিথিতে। একটি গরান গাছের ডাল দিয়ে পুজো করা হয় কাঠামো। সেই ডাল প্রতিমার সঙ্গেই নিরঞ্জন হয়। বাড়ির দালানে প্রতিমা তৈরি হয় না। কাঠামো পুজোর পর সেই ডাল যায় কুমোরটুলিতে। সেখানেই প্রতিমাশিল্পী নিমাই পাল তৈরি করেন মা দুর্গার মূর্তি। মায়ের পরনে থাকে বেনারসী শাড়ি। গা-ভরা সোনার সাজ।
মহাষষ্ঠীর রাতে বাড়ির বউরা মা-কে বরণ করেন, তাকে বলে বেলবরণ প্রথা। বৃহন্নান্দীকেশ্বর মতে পুজো হয় এই বাড়িতে। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুযায়ী। পুজোর রীতি অবশ্য প্রতিবছর একই। জানা যায়, আগে বেলবরণের সময় বাইরের কেউই পুজোর দালানে প্রবেশ করতে পারতেন না। তবে এখন সেই রীতি পালন করা সম্ভব হয় না।
সপ্তমীর সকালে কলাবউ স্নান করানো হয় বাড়িতেই। পুজোর সব জোগাড় করেন বাড়ির মেয়েরাই। তবে ভোগ রান্নার দায়িত্বে থাকেন বাড়ির ছেলেরা। ভোগের ঘরে ঢোকার জন্য উপনয়ন হওয়া আবশ্যিক। তাই বাড়ির ছোট ছোট ছেলেরা উসখুশ করে, কবে পৈতে হবে, কবে ভোগের ঘরে ঢুকব!
এক সময় এ বাড়িতে পশুবলির রীতি ছিল । পরে পশুবলি উঠে যায়। মায়ের ভোগে নানারকম উপকরণের পাশাপাশি রোজই থাকে মাছ, আমিষ ভোগ। প্রায় প্রতিটি পুজোর মতোই খিচুড়ি , ভাত, পাঁচ ভাজা তো থাকেই সেই সঙ্গে থাকে নানাবিধ চাটনি ও মিষ্টির উপকরণ। সপ্তমী থেকে দশমী নানারকম মাছের পদ মা-কে নিবেদন করা হয়।
এই পরিবারের ব্যতিক্রমী রীতি হল, দশমীর দিন দেবীর দুর্গাকে বাসি-ভোগ দেওয়া। বলা যেতে পারে দেবীর অরন্ধন। ইলিশের অম্বল এই ভোগের সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে। নবমীর রাতে রান্না করা ভোগ পরদিন সকালে দেবীকে উত্সর্গ করা হয়। এই বাড়ির ভোগের মধ্যে চিংড়ির মালাইকারি সহ নানারকম মাছ সাজিয়ে দেওয়ার রীতি আছে।
দশমীতে স্বামীগৃহে মেয়েকে পাঠানোর আগে পরিবারের সদস্যরা মিলে একসঙ্গে গান ধরেন , ভজিতে তোমারে শিখি নাই কভু, ডাকি শুধু তোমায় মা বলে। সাধনার রীতি জানি নাকো নীতি, পুজি শুধু তোমায় আঁখি জলে।' এই গান গেয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন পরিবারের সদস্যরা। দেবী যেন কোনও ভুলত্রুটি হলে মার্জনা করেন ! এ বাড়ির রীতি অনুযায়ী দেবীকে কাঁধে করে বিসর্জন দেওয়া হত। এখন অবশ্য কাঁধে বিসর্জন হয় না।
এখনও চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নতুন ও পুরনো প্রজন্মের মানুষরা মিলেমিশে পুজো সামলান। এই বাড়িতে পুজোর কয়েকদিন কেউ বাইরে ঠাকুর দেখতে যায় না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বড়জোর কাছাকাছি বের হয়। এক সময় পুজোয় নাটক অনুষ্ঠিত হত দেখার মতো। এই বাড়িতে কানন দেবীর মতো মানুষ এসেছেন যাত্রা দেখতে। বসত শাস্ত্রীয় গানের আসর। আসতেন তাবড় তাবড় শিল্পীরা। এখন এত কিছু না হলেও, পুজোর কয়েকটা দিন চেহারা বদলে যায় বাড়িটার।