Durga Puja 2025: শারোদৎসবের অপেক্ষায় গোটা রাজ্য, পুজো শুরু হয়ে গেল মল্লরাজ পরিবারে, কামানের তোপধ্বনিতে আগমন ঘটল দেবী মৃন্ময়ীর
Bishnupur Mrinmoyee Puja: বিষ্ণুপুরের মল্লরাজবাড়িতে পুজো শুরু হয়ে গেল।

তুহিন অধিকারী, বাঁকুড়া: রাজা নেই। নেই রাজত্ব। কিন্তু রাজকীয় আয়োজন রয়েছে। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ পরিবারে সেই মতো শুরু হল দেবী মৃন্ময়ীর পুজো। কামান দেগে দেবীকে স্বাগত জানানো হল মন্দিরে। ঢাকঢোল, কাঁসর, সানাইয়ের সুরে ভরে উঠল চারিদিক। গোটা রাজ্যের আগে, সেখানে শুরু হয়ে গেল পুজো। (Bishnupur Mrinmoyee Puja)
মাথার উপর শরতের আকাশ। উৎসবের আমেজ চারিদিকে। মহালয়ার দিন এগিয়ে আসছে। তার পরই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, দুর্গাপুজো। কিন্তু গোটা রাজ্যে এখনও শারদোৎসবের সূচনা না ঘটলেও, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ পরিবারে পুজো শুরু হয়ে গেল। আজ বলে নয়, গত ১০২৯ বছর ধরে এভাবেই পুজো হয়ে আসছে সেখানে। (Durga Puja 2025)
দেবীর বোধনের প্রথম দিনটি কৃষ্ণনবমী হিসেবে গণ্য় হয়। সেই কৃষ্ণনবমীতেই পুজো শুরু হল বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ পরিবারে। গোপাল সায়েরে মহাস্নান পর্বের পর বড় ঠাকুরানি মন্দিরে প্রবেশ করেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে গোপাল সায়েরের পাড় থেকে মুহুর্মুহু কামান দাগা হয়। সেই সঙ্গে ঢাকঢোল, কাঁসর, সানাই বাজিয়ে স্বাগত জানানো হল দেবীকে। গোটা রাজ্যে পুজো শুরু হওয়ার আগে, মল্লরাজ পরিবারের কূলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো শুরু হয়ে গেল।
প্রাচীন রীতি অনুযায়ী, গোটা রাজ্যে পুজো শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই কৃষ্ণনবমী তিথিতে দেবী মৃন্ময়ীর পুজো শুরু হয়ে যায় মল্লরাজ পরিবারে। সেই মতো সোমবার সাত সকালেই বিষ্মুপুরের ফৌজদার পরিবারের হাতে আঁকা বড় ঠাকুরানির পট নিয়ে রাজ দরবার লাগোয়া গোপাল সায়েরে পৌঁছন রাজপুরোহিতরা। রাজপরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।
গোপাল সায়েরে মন্ত্র সহযোগে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এর পর বাদ্যযন্ত্র-সহযোগে, শোভাযাত্রার মাধ্যমে পট নিয়ে আসা হয় মৃন্ময়ী মন্দিরচত্বরে। মন্দিরচত্বরে ঠাকুরানির প্রবেশের মুহূর্তে গাপাল সায়েরের পাড়ে পর পর তিন বার তোপ দাগা হয়। এর পর পট রাখা হয় বেদীতে। সেখানে ফের এক প্রস্থ পুজো-মন্ত্রপাঠ হয়। রাজপরিবারের সদস্যরা দেবীকে বরণ করেন। এর পর পানপাতায় পা রেখে দেবী প্রবেশ করেন মৃন্ময়ীর মূল মন্দিরে। সেখানে ঢোকার আগে আরও তিনবার কামানের তোপধ্বনি শোনা যায়।
মল্লরাজ পরিবারের এই পুজোর বয়স ১০২৯ বছর। মৃন্ময়ীর পুজোর পদ্ধতিও সম্পূর্ণ আলাদা। মল্লরাজ পরিবারের স্বতন্ত্র ‘বলিনারায়ণী পুঁথি’ অনুযায়ী, এই পুজো হয়। সেই রীতি অনুযায়ী, কৃষ্ণনবমীতে মন্দিরে প্রবেশ করেন বড় ঠাকুরানি, অর্থাৎ মহাকালী। এর পর, মান চতুর্থীতে একই ভাবে মন্দিরে প্রবেশ করেন মেজো ঠাকুরানি ওরফে মহা-সরস্বতী। ষষ্ঠীর দিন মন্দিরে আসেন ছোট ঠাকুরানি, অর্থাৎ মহা-লক্ষ্মী। অষ্টমী ও নবমীর মধ্যরাতে মন্দিরে খচ্চরবাহিনী বা মহামারির পুজো হয়।
মহামারির প্রকোপ থেকে প্রজাদের রক্ষা করতেই এই পুজোর প্রচলন বলে কথিত রয়েছে। জানা যায়, অতীতে শাক্ত মতে এই পুজো হতো। সেই সময় নরবলির প্রচলনও ছিল। কিন্তু শ্রীনিবাস আচার্যের সান্নিধ্যে এসে মল্লরাজ পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। সেই থেকেই বলি বন্ধ হয়ে যায় সেখানে। আর তখন থেকেই শব্দকে ব্রহ্মজ্ঞান করে তোপধ্বনির রীতি চালু হয়।
মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুরের প্রদ্যুম্নপুর গ্রামে। কথিত আছে, মল্লরাজ জগৎমল্ল শিকারে বেরিয়ে পথভ্রষ্ট হন। ভুল করে বন বিষ্ণুপুরে ঢুকে পড়েন তিনি। ক্লান্ত শরীরে জঙ্গলের মধ্য়ে একটি বটগাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। সেই সময় দৈব ঘটনাবলী ঘটতে শুরু করে তাঁকে ঘিরে। দৈব নির্দেশেই ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওই বটগাছের নীচে দেবী মৃন্ময়ীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে রাজধানী সরিয়ে বিষ্ণুপুরে নিয়ে চলে আসেন তিনি। সেই থেকে মহা ধূমধাম করে পুজো হয় সেখানে।
রাজস্ব বাবদ সেই সময় বিপুল আয় ছিল মল্লরাজাদের। ফলে রাজকীয় আয়োজনে পুজো হতো। সময়ের সঙ্গে রাজা, রাজত্ব সব গিয়েছে বটে। তবে পুজোর জৌলুস, আভিজাত্য হারাতে দেননি রাজ পরিবারের সদস্যরা। পুজোকে ঘিরে রাজপরিবারের নিষ্ঠা ও ভক্তিতে যেমন ভাঁটা পড়েনি, তেমনি মানুষের আবেগও নিভে যায়নি। বয়সের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন পুজোর রীতিনীতিও একই রয়েছে।
একসময় মৃন্ময়ীর পুজো উপলক্ষে যে তোপধ্বনি শোনা যেত, সেই অনুযায়ী মল্লরাজত্ব-সহ গোটা রাঢ়বঙ্গের পুজোর নির্ঘণ্ট তৈরি করা হতো। বর্তমানে তোপধ্বনির সেই ব্যাপ্তি না থাকলেও, ঐতিহ্য কিন্তু বজায় রয়েছে। দেবী মৃন্ময়ী মল্লরাজ পরিবারের কূলদেবী হলেও, বিষ্ণুপুরের আপামর মানুষের মধ্যে এই পুজোকে ঘিরে বাড়তি আবেগ দেখা যায়।























