ইংরেজ তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো খুঁজেছে। দিল্লির অ্যাসেম্বলিতে বোমা মারার পর ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির পর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দ্বীপান্তরে। হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। বেতের ঘা, বুট দিয়ে বুকে পিঠে আঘাত, খেতে না-দেওয়া,  ভেতর-বাইরে থেকে শরীরটা ঝাঁঝরা করে করে দিয়েছে ইংরেজ। তারপর দেশ স্বাধীন হল কিন্তু তিনি হলেন না। স্বাধীন ভারতের সরকারও তাঁকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার বাইরে বেরোতে মানা করে দিল। কেন ?তা কেউ জানে না। এমনটা চলেছিল কয়েক মাস...তিনি বঙ্গসন্তান। তিনি ভগৎ সিংহের সহযোদ্ধা। তিনি বটুকেশ্বর দত্ত। পরিবারের কথায় তিনি ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধের 'আনসাং হিরো' ! 


বাবা চলে গিয়েছেন, তিনি তখন ১৪। তবু বাবার শেষদিনগুলোর কথা বড্ড মনে পড়ে ৭৫ বছরের ভারতী বাগচির। স্বাধীনতা সংগ্রামী বটুকেশ্বর দত্তর মেয়ে তিনি। ABP Live বাংলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, ভারতী জানালেন, স্বাধীন ভারতে জন্ম তাঁর তাই বাবার বিপ্লবের দিনগুলো দেখেননি, কিন্তু দেখেছেন স্বাধীন ভারতে কতটা লড়তে হয়েছিল তাঁকে, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। তবে স্মৃতি হাতড়ালে প্রথমেই যেটা মনে পড়ে, সেটা হল , বাবার দেওয়া জীবন দর্শনের  পাঠ।  ভারতী বলেন, বাবা তাঁকে সব সময় বলতেন অন্যদের কথা ভাবতে হবে। আমাদের দেশকে পরিবার হিসেবে ভাবতে হবে। দেশের মানুষের কথা ভাবতে হবে। ভারত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ হবে একদিন । 


কিন্তু স্বাধীন ভারত কী দিয়েছিল ভারতীর বাবা বটুকেশ্বরকে ? সেই আলোচনার আগে একবার ফিরে দেখা যাক বটুকেশ্বরের জীবনের ইতিহাসের দিকে । বটুকেশ্বর দত্তের বাবা গোষ্ঠ বিহারী দত্ত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ওঁয়ারি গ্রামে জন্ম। পরে বাবার কর্মসূত্রে তিনি কানপুরে ও তারও পরে বারাণসীতে চলে যান। স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে যখন কৈশোরে পা রেখেছেন তখন থেকেই তাঁর চোখে স্পষ্ট হতে শুরু করে ব্রিটিশদের বিভাজনের নীতি, ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা। তখন থেকেই আস্তে আস্তে তাঁর মন যায় স্বদেশি আন্দোলনের দিকে। বাড়ির লোকের অজান্তেই যোগাযোগ শুরু হয়েছিল স্বদেশি আন্দোলনের যোদ্ধাদের সঙ্গে। হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের  সঙ্গে  যুক্ত হয়েছিলেন। বোমা তৈরি করতে শিখেছিলেন। কানপুরে থাকতেই পরিচয়ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে।  বটুকেশ্বর দত্ত এবং ভগৎ সিং অ্যাসেম্বলিতে বোমা নিক্ষেপ করেন। এরপর বটুকেশ্বর দত্তকে দ্বীপান্তরিত করা হয় আর ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি হয়ে যায়। বটুকেশ্বর দত্তকে সে-সময় নৃশংস অত্যাচার সইতে হয় । একদিকে অপুষ্টি কুরে খাচ্ছিল, অন্যদিকে  ব্রিটিশের শারীরিক অত্যাচার বাড়ছিল উত্তরোত্তর।  তা সত্ত্বেও বটুকেশ্বর,  রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে  অমানবিক আচরণ এবং জেলের বৈষম্যমূলক ও অমানবিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন। শরীর আরও ভেঙে পড়ে। তখন তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন বটুকেশ্বর। এখানেই লড়াইয়ের শেষ নয়। ১৯৪২ এ  গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। বন্দি ছিলেন বাঁকিপুর জেলে। তারপর ১৯৪৭ এ স্বাধীনতার সূর্য দেখল দেশ। 


দেশ স্বাধীন তো হল কিন্তু বটুকেশ্বরের যাতায়ার নিয়ন্ত্রণ করল স্বাধীন ভারতের সরকারই। জানালেন তাঁর মেয়েই। মাস আটেক চলেছিল এই অবস্থা। কেন? হয়ত বটুকেশ্বরের মতো স্ফুলিঙ্গকে পঞ্জাব বা কানপুরে হয়ত ফিরে যেতে দিতে সাহস করেনি তৎকালীন সরকার। তবে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ অবশ্য সেই নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন। ততদিনে অনেকটা সময় বয়ে গিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের সরকার বিপ্লবী বটুকেশ্বরের রুজি রুটির কোনও দায়িত্বই নিল না। সেটাই সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক , বললেন বটুকেশ্বর কন্যা। খুব ছোটবেলায় বাবাকে নানা ছোটখাটো ব্যবসা করতে দেখেছেন তিনি। কিন্তু ব্যবসায়ী মনোভাব তো কোনওদিনই ছিল না তাঁর। ফলে সংসারের দায়িত্ব নিলেন তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি দত্ত। স্বাধীনতার পর বটুকেশ্বরের দাদা-ই কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক অঞ্জলির সঙ্গে বিয়ে দেন ভাইয়ের । তারপর ১৯৪৮ এ জন্ম ভারতীর। 


বাবাকে ছোট থেকে দেখেছেন আদর্শকে আঁকড়ে থাকতে। মেয়েকেও সেই শিক্ষাটুকুই দিতে চেয়েছিলেন। হয়ত স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধের কথা ততটা বুঝতেন না ছোট্ট ভারতী। তবে বাবার শিক্ষাটা আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। এসব কিছুর মধ্যেই বাবার শরীরটা খারাপ হতে শুরু করে, তখন ভারতী কিশোরী। সেই সব দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে এখনও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তিনি। 'ব্রিটিশরা এমন মেরেছিল বাবাকে,পাঁজরে একটা বড় ক্ষত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারেনি তখন। আস্তে আস্তে সেই ক্ষতটাই বেড়ে গিয়ে বড় রোগ হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি এইমসে। চিকিৎসার খরচ তখন বিরাট ! সে-সময়  পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী গুলজারি লাল নন্দ।  খরচ খরচা সামলেছিল সরকারই। এইমসেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি '।




ভারতী আরও বলেন, বাবা যখন হাসপাতালে ভর্তি, তখন দেখা করতে এসেছিলেন পাঞ্জাবের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বাবাকে জিগ্যেস করেছিলেন, আপনার শেষ ইচ্ছে কী। বাবা নিজের জন্য, পরিবারের জন্য কিচ্ছুটি চাননি। শুধু চেয়েছিলেন নিজের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ভগৎ সিংয়ের পাশে মৃত্যুর পর জায়গা পেতে। তাই বটুকেশ্বরের শেষকৃত্য হয়েছিল পঞ্জাবেই।  পাঞ্জাবের হুসেনিওয়ালায় রয়েছে বটুকেশ্বরের শেষকৃত্যের স্মৃতিসৌধ। সেখানে এখন প্রতি বছর তাঁর মৃত্য়ু দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন হয়। 


ভগৎ সিং বটুকেশ্বর দত্তকে বটু বলে ডাকতেন। শহিদ হওয়ার আগে ভগৎ সিং তাঁর মাকে বলেছিলেন, আমি বটুকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি, সে তোমার ছেলে। ছেলের কথা মনে রেখেছিলেন মা। বটুর শেষ শয্যায় পাশে ছিলেন ভগতের মা। বটুকেশ্বরের মেয়ে ভারতীর বিয়ের সময় , নিজের পরিবারের মেয়ের মতোই তত্ত্ব সাজিয়ে দিয়েছিলেন ভগতের মা। পাঠিয়ে ছিলেন বিয়ের পোশাক , গয়না। পঞ্জাবি ও বাঙালি পরিবারের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও, রয়েছে এমন এক সম্পর্ক, যা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যাকে বলা যায় ন হন্যতে। 


ভারতী আরও জানালেন, জীবদ্দশায় হয়ত তেমন কদর পাননি দেশের সরকারের থেকে। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বটুকেশ্বর দত্তকে মনে রেখেছে। বর্ধমানের ওঁয়ারির বাড়িটিকে সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন বটুকেশ্বর কন্যা। সেই ভবন এখন সেজে উঠছে মহান বিপ্লবীর স্মৃতিতে। হয়ত ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠবে পূর্ব বর্ধমানের ওঁয়ারির বাড়িটি। 




আরও পড়ুন - 


ব্রিটিশ পুলিশের চোখ এড়াতে ১৮ দিন কেটেছিল এই সুড়ঙ্গে, এখন ধ্বংসের অপেক্ষায় ভগৎ-বটুকেশ্বরের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়ি 


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।