Rat Dakhal Protest: মুষ্টিবদ্ধ হাতে ধরা একফালি চাঁদ...বাংলায় রাত দখলের ডাক...ফিরে দেখা ইতিহাস সৃষ্টি করা আন্দোলন
Year Ender 2024: জীবনের বিনিময়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে প্রতিবাদের এক সুতোয় বেঁধে দিয়ে গেলেন আর জি কর মেডিক্যালের নিহত তরুণী চিকিৎসক।
রাস্তার ক্যানভাসে রং-তুলির গর্জন। গানে-কবিতা-পথনাটিকায় জনগর্জন, বিচারের দাবি। মোম, মশাল আর মোবাইলের আলোয় আঁধার-বিনাশী অঙ্গীকার। কে বলবে গভীর রাত। আর জি কর মেডিক্যালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের পর প্রতিবাদের অন্য ছবি দেখাল কলকাতা ! রিক্লেম দ্য নাইট - সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ঘোষণা। যে রাতে এক কর্মরতা তরুণী তাঁর কর্মস্থলেই ধর্ষিত হয়েছেন, সেই রাতের দখল নিতে মেয়েদের ডাক, স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের রাতে । মধ্যরাতে কলকাতার রাজপথে জড়ো হয়ে নিজেদের অধিকার জানান দেওয়ার আন্দোলন। সেই আহ্বান যে এভাবে সাড়া ফেলবে, তা বোধ হয় ভাবেননি আহ্বায়করাও।
সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুরু হয় প্রচার। ক্রমেই এই 'রাত দখল' গণ আন্দোলনের চেহারা নেয়। শহর থেকে শহরতলি, রাজপথ থেকে গলি, ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদের ধ্বনি। আর জি কর মেডিক্য়াল, গড়িয়া, যাদবপুর, রাসবিহারী, কলেজ স্কোয়ার, শ্য়ামবাজার, লেকটাউন থেকে চন্দননগর, শ্রীরামপুর, কোন্ননগর। জীবনের বিনিময়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে প্রতিবাদের এক সুতোয় বেঁধে দিয়ে গেলেন আর জি কর মেডিক্যালের নিহত তরুণী চিকিৎসক।
৯ অগাস্ট ভোরে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ধর্ষণ করে খুন করা হয় কর্তব্যরত এক পিজিটি ছাত্রীকে। সেই ঘটনায় নারী নিরাপত্তা ইস্যুতে গোটা রাজ্যে যখন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছে, তখন সেই ঘটনার ৬ দিনের মাথায়, স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে ডাক দেওয়া হয় রাত দখল আনদোলনের। নীলচে কালো অন্ধকারে মুষ্টিবদ্ধ হাতে চাঁদ ধরার স্বপ্ন। ১৪ ও ১৫ অগাস্টের সেই মধ্যরাতে নারী স্বাধীনতার উড়ান দেখেছিল কলকাতা-সহ গোটা বাংলা। কোনও রাজনৈতিক ব্য়ানার, কোনও রাজনৈতিক পতাকা ছাড়াই, সেদিন পথে নেমে এসেছিল রাতজাগা তারারা। সোশাল মিডিয়ায় রিমঝিম সিংহ নামে এক তরুণীর আবেদন যে এভাবে ঢেউ তুলবে, তা ভাবতে পারেননি তিনি নিজেও। তারপর 'রাত দখলের আন্দোলন' তৈরি করেছে নাগরিক আন্দোলনের নতুন ইতিহাস।
পথনাটিকা থেকে মানববন্ধন কিংবা রাস্তায় প্রতিবাদে ভাষা লেখা। আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে জেলায় জেলায় প্রতিবাদে মুখর হন নবীন থেকে প্রবীণরা। এতে যেমন ছিলেন চিকিৎসকরা , তেমনই ছিলেন অভিনেতা - অভিনেত্রীরা, তেমন ছিলেন স্কুলছাত্রী, কলেজছাত্রী, গৃহবধূরা। সবাই পথে নামেন ঘরের মেয়ের বিচারের দাবিতে। ১৪ অগাস্টের রাত দখলের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যেই আর জি মেডিক্যালে হানা দেয় একদল দুষ্কৃতী। ভয়ঙ্কর তাণ্ডবলীলা চলে ঘণ্টাকয়েক ধরে। আহত লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক নিয়ে আক্রমণের পাশাপাশি পাথর নিক্ষেপ, আহত হয় পুলিশও। সে-রাতের কথা কলকাতা আজও ভোলেনি।
এরপর থেকে বারংবার, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে স্থানীয় উদ্যোগেই শুরু হয়ে যায় রাত দখলের আন্দোলন। শুধু রাত দখল নয়, রাতভর আন্দোলনের পর ভোর দখলও হয় বিভিন্ন এলাকায়। স্বাধীনতা দিবসের প্রাকদিবস থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলন কিন্তু কয়েকদিনে থেমে যায়নি। শারদ উৎসবের প্রাক্কালেও একই রকম ভাবে চলতে থাকে নাগরিক আন্দোলন। মহালয়ার দিনও ভোর দখল থেকে তর্পণ, আর জি কর-কাণ্ডের বিচার চেয়ে পথে নামে সাধারণ মানুষ। ঘাটে ঘাটে হয় তর্পণ। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে জলে ভাসে প্রতিবাদের প্রদীপ। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তার ধারে তৈরি হয় মানববন্ধন। 'পুজোয় আছি, উৎসবে নেই' , একসুরে গর্জে ওঠেন প্রতিবাদীরা।
যতদিন গড়িয়েছে, প্রতিবাদের ঝাঁঝ কমেনি, বরং বেড়েছে। মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য মানুষকে ডাকতে হয়নি। মানুষ মিছিল খুঁজে যোগ দিয়েছে। এই আন্দোলন ঘিরে রাজনৈতিক আকচাআকচিও হয়নি। আন্দোলনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন শাসকদলের কোনও কোনও নেতা। আবার সেই শাসকদলেরই হেভিওয়েট নেতারা রাত দখলের আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিতর্কে জড়ান। দলীয় নীতির বিপরীতে হেঁটেই আন্দোলনে যোগ দেন শান্তনু সেন থেকে সুখেন্দু শেখর রায়। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে রাজনৈতিক রং ভুলে অনেকেই আন্দোলনের পাশে থেকেছেন , আছেন।
এরপর আরও কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। রাত দখল আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে দিক দিক থেকে। অভিযোগের তির ছিল শাসক দলের দিকে। পুলিশের সামনেই রাস্তায় ফেলে আন্দোলনকারীদের পেটানো থেকে লাথি-ঘুষি মারা, রক্তপাত, সবই হয়। রাত দখলের আন্দোলনে যোগ দেওয়া বিনোদন জগতের মানুষদের নিয়ে কুৎসাও কম হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যায় ট্রোলের বন্যায়। তাতেও থামেনি আন্দোলন। তারকা-স্টেটাস ভুলেই রাতের পর রাত রাজপথে থেকেছেন তাঁরা। মিশে গিয়েছেন সাধারণ মানুষের স্রোতে। যে স্রোত কলকাতা পেরিয়ে, বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে ধাক্কা মারে ভূমধ্যসাগরের তীরেও।
এখনও বিচার পাননি তিলোত্তমা। তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে উঠেছে প্রশ্নও। কিন্তু আন্দোলন কি থেমে গিয়েছে ? না, প্রতিবাদীরা বলছেন , 'তিলোত্তমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই' ।