'কলেজে রাজনীতি ঢুকতে দেব না, গেটে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়েছিলেন ফাদার'
'স্কুল, কলেজের গণ্ডি থেকে কেবল শিক্ষক হয় না, যাঁরা জীবনের কোনও না কোনও সময়ে যে কোনও ভালো শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা সবাই শিক্ষক। তাঁদের জন্যই আজ আমি খরাজ মুখোপাধ্যায়।'
কলকাতা: 'তখন ক্লাস সেভেন। প্রথমদিন ক্লাসে এসেই ফাদার ফঁসো বললেন, আমরা কেউ নাকি এ বি সি ডি লিখতেই শিখিনি এখনও পর্যন্ত। প্রথম ৬ মাস ক্লাসে পড়ালেন না। রোজ ক্লাসে এসে ধরে ধরে হাতের লেখা শেখালেন। ৬ মাস পরে ক্লাসের প্রত্য়েকটা ছেলের হাতের লেখা যেন স্বর্ণাক্ষর..। আরও একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল ওঁর। স্কুলের মধ্যে জাপানি ঘুড়ি ওড়াতেন। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম।'
সেন্ট লরেন্স স্কুলের গণ্ডি পার করেছেন কয়েক দশক আগে। কিন্তু ছোটবেলার স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, প্রথম অভিনয়ের সুযোগ, সব স্মৃতি এখনও স্পষ্ট মনে আছে অভিনেতার। তাঁর কথায়, 'স্কুল, কলেজের গণ্ডি থেকে কেবল শিক্ষক হয় না, যাঁরা জীবনের কোনও না কোনও সময়ে যে কোনও ভালো শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা সবাই শিক্ষক। তাঁদের জন্যই আজ আমি খরাজ মুখোপাধ্যায়।'
ছোটবেলার শিক্ষক বলতে প্রথমেই খান স্যারের কথা মনে পড়ে খরাজের। বলছেন, 'বড় হয়ে যতবার খান স্যারকে প্রণাম করতে গেছি, প্রথমে উনি চিনতে পারতেন না। বলতেন, কে রে বাবা? প্রশ্ন শুনে ছাত্ররা হাসলেই সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলতেন। নাম বলে দিতেন। বলতেন হাসি মুখ দেখলেই চিনতে পারি। ছোটবেলায় তো তোরা সবসময় হাসতিস।'
সেন্ট লরেন্স স্কুলের এক একজন শিক্ষক যেন এক একটা নতুন উপন্যাসের মত। খরাজ বলছেন, 'ফাদার ফঁসোর কাছে যদি কোনোদিন কারও নামে অভিযোগ করতে যাওয়া হত, উনি দুই ছাত্রকে একজোড়া করে বক্সিং গ্লাভস দিতেন। তারপর বলতেন, লড়াইতে যা জিতবে, সে অন্যের কথা শুনবে। ফ্রান্সিস স্যার স্কুলে ফুটবল খেলতেন। বিশ্বনাথ স্যার বিনা মাইনেতে ফিজিক্স পড়িয়েছিলেন আমায়। ওনার জন্যই পাশ করেছি। ফাদার পিন্টু ছিলেন সরাসরি আইনস্টাইনের ছাত্র। ওনার ঘরে একটা ময়না পাখি ছিল। খুব সুন্দর কথা বলত। সেটা দেখবার জন্য আমরা সবাই বার বার ওই ঘরে যেতাম। যেদিন ফাদার মারা গেলেন, অদ্ভুতভাবে, পাখিটাও ঠিক সেইদিন মারা গেল।'
এরপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, একটু বড়বেলার স্মৃতি। সেখানকার ফাদার জরিসকে ভুলতে পারেননি অভিনেতা। খরাজ বলছেন, 'ফাদার জরিস সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। কিন্তু বিরতির সময় উনি গোটা কলেজে হেঁটে ঘুরতেন। আর যে যে ঘরে আলো-পাখা জ্বলত, সেগুলো বন্ধ করাতেন। তৎকালীন এক নেতা একবার কলেজে রাজনৈতিক ইউনিয়ন করতে চেয়েছিলেন। কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে তাঁকে বন্দুক নিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন ফাদার। সেই নেতাকে বলেছিলেন, এই কলেজে রাজনৈতিক ইউনিয়ন করতে চাইলে সবার প্রথমে আমি তোমাকে মারব। তারপর এই কলেজটাকে একটা হাসপাতাল করে দেব। যেখানকার প্রথম রোগী হবে তুমি। '
খরাজের রুপোলি পর্দায় পা রাখাও কলেজ জীবনেই। এক শিক্ষকের স্মরণসভায় গান গেয়েছিলেন তিনি। সেই গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলেন জীমূতবাহন সেনগুপ্ত। যখন জানতে পারেন খরাজ অভিনয়ও করেন, তখন তাঁকে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন উনিই। তাপস পাল ও মুনমুন সেনের ছবি 'হুলস্থুল'-এ অভিনয় করেছিলেন খরাজ। সেই প্রথম রুপোলি পর্দার সঙ্গে আলাপ অভিনেতার।
অভিনয় জীবনের শিক্ষক হিসাবে সুকান্ত বসাকের নামই প্রথম মনে আসে অভিনেতার। খরাজ বলছেন, 'তখন সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি। লুকিয়ে সিগারেট খেতে ম্যাডক্সে আসতাম। সুকান্তদা সেসময় সান্ধ্যভ্রমণ করতেন ওখানে। হঠাৎ একদিন এসে বললেন, 'সবাই কত কিছু গঠনমূলক কাজ করে, তোদের ইচ্ছা করে না? থিয়েটার কর না...' তারপর একদিন আমাদের বাড়িতে ডাকলেন, গল্প বললেন। সেই গল্পই নাট্যরুপে সুজাতা সদনে মঞ্চস্থ হল। বাঁচার আলো। 'অযান্ত্রিক' নাট্য সংস্থায় অভিনয় করি এখন। এই দলে যোগ দেওয়াও সুকান্তদার হাত ধরেই। সুকান্তদা দল ছেড়ে দিয়েছেন বহুদিন। আমি এখনও 'অযান্ত্রিক'-এই আছি।'