Independence Day Exclusive: বীর বিপ্লবী বাঘা যতীন: যাঁকে ভয় করত ইংরেজ, যিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন
Freedom Fighter Bagha Jatin: ব্রিটিশ টেগার্ট তার সহকর্মীদের একবার বলছিলেন, বাঘা যতীন যদি একজন ইংরেজ হতেন তবে তার মূর্তিটি সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফলগার স্কয়ারে নেলসনের কলামের পাশে তৈরি করা হতো।
কলকাতা: সালটা ১৯০৭। অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনে। আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়া এক সহযাত্রীর জন্য দৌড়ে দৌড়ে জল আনার সময় অজান্তেই এক ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনকে ধাক্কা মারেন এক বাঙালি যুবক।
রাগের চোটে ওই যুবককে চরম অশালীন ভাষা প্রয়োগ করে বেত্রাঘাত করে ওই ক্যাপ্টেন। সেই সময় যুবক জল নিয়ে চলে গেলেও, কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে। ক্যাপ্টেনকে প্রশ্ন করে, তার এহেন ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের কারণ কী। ক্যাপ্টেন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তার আশেপাশে চলে আসে আরও তিন জওয়ান। চারজন মিলে এই যুবককে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়।
এ ঘটনার পরে কী হয়েছিল তার ইতিহাস সকলেরই জানা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই, চারজনকেই প্ল্যাটফর্মে ধরাশায়ী করেছিলেন ওই যুবক। এক কথায় চারজনকেই উত্তম-মধ্যম দিয়েছিলেন। চারজনের চোয়াল ভেঙে ধরাশায়ী করার অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়।
আদালতে উল্টে তীব্র ভর্ৎসিত হয় ব্রিটিশ সেনা। বিপুল সমালোচনার মুখে সরকার চাপে পড়ে মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং আদালত কক্ষে সেনাদের সর্তক করা হয়। কারণ, এক বাঙালি যুবক খালি হাতে চার ব্রিটিশ সামরিক কর্মীকে ধরাশায়ী করছেন-- ব্রিটিশ আত্মাভিমানে এর চেয়ে বড় দাগ কিছুই হতে পারে না। সেই সময় ইংরেজ সামরিক কর্মকর্তাদের এক বাঙালি যুবকের কাছে নতি স্বীকার করা অত্যন্ত অপমানজনক ছিল। আর এই ঘটনা ব্রিটিশ শাসনের খ্যাতি কালিমালিপ্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
সেই যুবক আর কেউ নন, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া বীর বাঙালি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বিশ্ব যাকে বাঘা যতীন নামেই চেনে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের মহানায়ক। যিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণের বলিদান দিয়েছিলেন।
বীর বিপ্লবী বাঘা যতীন বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়ায় ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলায় তার বাবা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হারান। বিধবা মা, স্বভাবকবি ও নিবেদিত সমাজসেবিকা শরৎশশী দেবীর আদরযত্নে বড় হতে থাকেন যতীন। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীনকে সাহসী করে তোলার পেছনে ছিলেন তার মা শরৎশশী।
শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন যতীন্দ্রনাথ। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড ডাকাবুকো বলেও নামডাক ছিল। ভোজালি দিয়ে বাঘ মারার ঘটনা আগুনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর থেকে শক্তিমত্তার জন্য লোকমুখে তিনি “বাঘা যতীন” নামে পরিচিতি পান।
শক্ত-সামর্থ্য ও নির্ভীকচিত্তের যতীনের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। তিনি শরীর গঠনের জন্য গাছে চড়া, সাঁতার কাটা ও বন্দুক ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
ছাত্রাবস্থায় যতীন্দ্রনাথ সিস্টার নিবেদিতার আয়োজিত একটি ত্রাণ শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পরিচয় হয় বিবেকানন্দের সঙ্গে। স্বামী বিবেকানন্দই যতীন্দ্রনাথকে নির্দেশ দিয়েছিলেন "লোহার পেশী" এবং "ইস্পাতের স্নায়ু" সহ নিবেদিত যুবকদের একত্রিত করতে যাঁরা মাতৃভূমির সেবায় নিবেদিত থাকবেন।
পরবর্তীকালে, ঋষি অরবিন্দর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের জন্য তাঁর প্রবল উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। অরবিন্দই তাঁকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের জন্য নিবেদিত যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি "গোপন সমাজ" তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই গোপন সমাজ যুগান্তর নামে পরিচিত ছিল এবং বাঘা যতীন এর সর্বাধিনায়ক হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দেশে তীব্র জনজাগরণ উঠেছিল। সেই সময় যতীনের স্পষ্টবাদী আহ্বান "আমরা মরব, জগৎ জাগবে" ভারতের জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান স্রোতকে উস্কে দিয়েছিল। হাজার হাজার অস্থির যুবক যতীনের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।
বিভিন্ন উপশহরগুলোতে এক গোপন বৈপ্লবিক দল গঠনের কাজ করত যুগান্তর, যারা ব্রিটিশবিরোধী তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার কাজ করত। এ দলে কাজ করার সময় নরেনের (মানবেন্দ্র নাথ রায়) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অচিরেই তাঁরা একে অপরের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন।
১৯০৮ সাল। তখন যতীন আপাদমস্তক বিপ্লবী। এসময় যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়। এ মামলার বিচারে বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে যাবজ্জীবন নির্বাসন, অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল এবং অনুশীলন সমিতিকে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এবং নরেনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
তারা উভয়েই আত্মগোপন করেন এবং অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে গুপ্তভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। যতীনকে পুনরায় হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়। অত্যাচারের শিকার হয়ে তাদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয় এবং অপর কয়েকজন পাগল হয়ে যান। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে যতীন এ মামলা থেকেও মুক্তি পান। কিন্তু তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
জেলে থাকা অবস্থায় বিপ্লবী যতীন এবং নরেন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তারা দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দলকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে নরেন সন্ন্যাসিরূপে ব্যাপকভাবে সমস্ত ভারত ভ্রমণ করে বাংলাসহ বিভিন্ন এলাকার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন।
বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ হুগলি এবং মেদিনীপুরের বন্যার ত্রাণকার্য উপলক্ষে একত্রিত হন। তারা যতীন মুখোপাধ্যায় এবং রাসবিহারী বসুকে যথাক্রমে বাংলা এবং উত্তর ভারতের নেতা মনোনীত করেন। ভারতবর্ষের বাইরেও বিপ্লবীদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়।
যুগান্তর শীঘ্রই একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। যুগান্তর পার্টি সফলভাবে ভারত জুড়ে তার শাখা স্থাপন করে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সানফ্রানসিসকো শহরে যুগান্তর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রস্তাবিত কাঠামোর বিরোধিতা করে “পূর্ণ স্বাধীনতা” অর্জনের জন্য নিবেদিত এক প্রাণ হয়ে উঠেন বাঘা যতীন। ১৯১২ সালে কলকাতা সফরকালে জার্মান যুবরাজের সঙ্গে দেখা করেছিলেন যতীন এবং তাঁকে ভারতে বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপে অবস্থানরত ভারতীয় বিপ্লবীরা ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি’ গঠনের উদ্দেশ্যে বার্লিনে সমবেত হন এবং তারা এতে জার্মানির সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। যতীনকে বালেশ্বরে গোপন জায়গায় রেখে নরেন বাটাভিয়া যান এবং সেখানে জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাহাজে অস্ত্র পাঠানো ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ে আলোচনা করেন।
যতীন ও তার সহযোগীরা জার্মান থেকে আসা অস্ত্রের চালান গ্রহণের জন্য বালেশ্বরের নিকট ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার কাপ্তিপদা গ্রামে অবস্থান নেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ তথ্য পৌঁছে গেলে তারা কোনও দেরি না করে অভিযানে নেমে পড়ে।
ব্রিটিশ অভিযানের খবর এসে পৌঁছয় বিপ্লবীদের কাছেও। যতীন ও তার দল ময়ূরভঞ্জের রুক্ষ ভূখণ্ড দিয়ে দুই দিন পায়ে হেঁটে বালেশ্বর রেলওয়ে স্টেশন পৌঁছেছিলেন। তাঁরা বালেশ্বরের চশখন্ড গ্রামের একটি টিলাতে ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আশ্রয় নিয়েছিলেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বুড়িবালাম নদীর তীরে চার সহযোগী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য জার্মান অস্ত্র ব্যবহার করে বালেশ্বর রেললাইন দখল করে ব্রিটিশ সেনাদের মাদ্রাজ থেকে কলকাতা যাত্রা বন্ধ করা। কিন্তু পুরস্কারের লোভে গ্রামবাসীরা পুলিশকে খবর দেয়।
কলকাতা এবং বালেশ্বরের শীর্ষ ইউরোপীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ও ব্রিটিশ পুলিশের এক বিশাল ব্যাটালিয়ন চারদিক থেকে পাঁচ বিপ্লবীর ওপর আক্রমণ চালায়। তবে বিনা লড়াইতে প্রাণ দেননি কেউ। ব্রিটিশ এবং বিপ্লবীদের মধ্যে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী গুলির লড়াই হয়।
যতীনের তলপেটে গুলি লাগে এবং পরের দিন ১০ সেপ্টেম্বর ৩৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন এই মহানায়ক। শেষ হয় এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মহান অধ্যায়।
বিখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ কর্তা চার্লস টেগার্ট তার সহকর্মীদের একবার একটি কথা বলছিলেন। তা হল-- বাঘা যতীন যদি একজন ইংরেজ হতেন তবে তার মূর্তিটি সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফলগার স্কয়ারে নেলসনের কলামের পাশে তৈরি করা হতো।