কারও বয়স ৩০, তো কারও ৩২! কেউ কেউ আবার সামান্য ছোট, ২৫। মানুষ হলে তারুণ্যের তেজে টগবগ করত এরা। দাপিয়ে বেড়াত মাঠ-ময়দান। কিন্তু আকাশে ওড়ার জন্য ২৫-৩০ বছর বয়স অনেকটাই বেশি। শুধু তাই নয়, এই সব বুড়ো হাড় আকাশে কতটা ভেল্কি দেখাতে পারবে তা নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন উঠছে। ‘এরা’ আদতে বায়ুসেনার হাতে থাকা বিভিন্ন বিমান—মিগ, মিরাজ, জাগুয়ার। প্রতিরক্ষা সূত্রে বলা হচ্ছে, সিয়াচেন হিমবাহ এলাকায় নিয়মিত উড়ে বেড়ানো চেতক ও চিতা হেলিকপ্টারের বয়স তো আরও বেশি। ২০১৫ সালে সরকারি একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, বায়ুসেনার হাতে থাকা ১৮১টি চেতক ও চিতা হেলিকপ্টারের ৫১টির বয়স ৪০ বছরের বেশি পুরনো এবং ৭৮টির বয়স ৩০-৪০ বছরের মধ্যে! বায়ুসেনার হাতে থাকা বিমান বহরের এই বুড়িয়ে যাওয়া নিয়ে বহু দিন ধরেই প্রশ্ন উঠেছিল বায়ুসেনার অন্দরে। নতুন নতুন বিমান চাই, এ কথা বারবার বলছিলেন বায়ুসেনার পাইলটেরা। এ বার সেই প্রশ্নটাই ফের উস্কে দিয়েছে চেন্নাই উপকূলের বিমান রহস্য। শুক্রবার সকালে ২৯ জন যাত্রী নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর মাঝ আকাশেই উধাও হয়ে গিয়েছে বায়ুসেনার একটি এএন-৩২ বিমান। শনিবার রাত পর্যন্ত যাত্রী বা বিমান, কারও খোঁজ মেলেনি। ৩২ বছর ধরে বায়ুসেনাকে পরিষেবা দিচ্ছে এএন-৩২। বিমানের বয়সের হিসেবে যা অনেকটাই বেশি। এই বয়সের ভারেই সে মাঝ আকাশে নুয়ে পড়েছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। যে প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে মিগ, মিরাজ, জাগুয়ারদের বয়সের হিসেব। এই যে বিমানের বয়স বাড়ছে তা তো অনেক দিন ধরেই জানা ছিল। কিন্তু নতুন বিমান কেনার তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। প্রতিরক্ষা সূত্রে বলা হচ্ছে, বফর্স কেলেঙ্কারির ভূত এমনিতেই ছিল। ফলে বিদেশ থেকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত জিনিসপত্র কেনার ব্যাপারে একটু সাবধানী ছিলেন ইউপিএ জমানার মন্ত্রীরা। তার উপরে দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় অগুস্তা কপ্টার কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। ফলে দুর্নীতি থেকে নিজের ভাবমূর্তি বাঁচাতে আরও বেশি তৎপর হন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি। ফলে এই সব কেনাকাটার উপরেও অনেক বেশি রাশ টানা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বু়ড়ো বিমানকেই হাতিয়ার করে কাজ করতে হচ্ছে বায়ুসেনাকে। এ কথা যে কিছুটা সত্যি তা মেনে নিয়েও বায়ুসেনা সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিমানের যন্ত্রাংশ বদলানো হয়। তার ফলে বিমানের আয়ুষ্কাল কিছুটা বাড়ে। যেমন ভাবে এএন-৩২ বিমানের যন্ত্রাংশ বদল হচ্ছিল। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, মিগ, এএন-৩২ এ সব বেশির ভাগই সোভিয়েত জমানার। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরে তার যন্ত্রাংশের গুণমান অনেকটাই পড়ে গিয়েছিল। ফলে যন্ত্রাংশ বদল করা হলেও সেগুলি কতটা ভাল মানের তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। বায়ুসেনার একটি সূত্র অবশ্য বলছে, সোভিয়েত ভাঙার পর প্রথম প্রথম সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে সেই সমস্যা অনেকটাই কেটে গিয়েছে। যেমন আন্তোনভ (এএন-৩২ নির্মাতা) আদতে ইউক্রেনীয় সংস্থা। ফলে সোভিয়েত ভাঙার পরে ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তি করে যন্ত্রাংশ আনতে হচ্ছে। চলতি বছরের মার্চে পাঁচটি এএন-৩২ ইউক্রেনে গিয়ে যন্ত্রাংশ সারিয়েও এসেছে। বায়ুসেনা সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, মিরাজ বা জাগুয়ারকেও নতুন ভাবে উন্নীত করা হচ্ছে। ফলে এখনই তা বসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেই। মিগ-২১ বাইসন এবং মিগ-২৭ বিমানগুলিকে ধীরে ধীরে ছাঁটাই করা হবে। সে জায়গায় নিয়ে আসা হবে তুলনায় নতুন সুখোই যুদ্ধবিমান। বাহিনীতে নিয়ে আসা হচ্ছে অ্যাপাচে এবং চিনুক হেলিকপ্টারও। কিন্তু সেই সব ‘পক্ষীরাজ ঘোড়া’ কবে এসে বায়ুসেনার হাতে পৌঁছবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।