Tej Pratap Yadav: বিয়ে, রাজনীতি, প্রেম…বরাবরই ‘ট্রাবলমেকার’ তেজপ্রতাপ, বড় ছেলেকে জীবন থেকেই বাদ দিলেন লালুপ্রসাদ!
Lalu Prasad Yadav: এই প্রথম নয়, আগেও বার বার পরিবার এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (RJD) অস্বস্তি বাড়িয়েছেন তেজপ্রতাপ।

পটনা: বিধানসভা নির্বাচনে বাকি আর মাত্র কয়েক মাস। সেই নিয়ে প্রস্তুতি যখন চরমে, সেই সময়ই বিহারের রাজনীতিতে শোরগোল। রাজনৈতিক কারণে নয়, লালুপ্রসাদ যাদবের পারিবারিক কলহই এই মুহূর্তে রাজ্যের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ বড় ছেলে তেজপ্রতাপকে শুধু দল থেকেই বহিষ্কার করেননি লালু, ছেলের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কও ছিন্ন করেছেন। এক তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তেজপ্রতাপের নাম জড়ানো এবং সেই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জেরেই এতদবর জল গড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এই প্রথম নয়, আগেও বার বার পরিবার এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (RJD) অস্বস্তি বাড়িয়েছেন তেজপ্রতাপ। (Tej Pratap Yadav)
১) সম্প্রতি তেজপ্রতাপের ফেসবুক পেজ থেকে একটি পোস্ট করা হয়। অনুষ্কা যাদব নামের এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর ছবি পোস্ট করে লেখা হয়, 'আমি তেজপ্রতাপ যাদব। আমার সঙ্গে যিনি আছেন তিনি অনুষ্কা যাদব। ১২ বছর ধরে পরস্পরকে চিনি আমরা, গভীর ভাবে ভালবাসি একে অপরকে। এত বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক। সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছিলাম, কিন্তু সঠিক শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আজ এই পোস্টের মাধ্যমে মনের জানলা খুলে দিলাম। আশাকরি আপনারা বুঝবেন'। (Lalu Prasad Yadav)
পরে যদিও পোস্টটি মুছে দেওয়া হয়, কিন্তু তত ক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। বিহারের রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, অনুষ্কার সঙ্গে যদি ১২ বছর ধরে সম্পর্কই থাকে, তাহলে ২০১৮ সালে প্রাক্তন RJD নেতা চন্দ্রিকা রাইয়ের মেয়েকে কেন বিয়ে করেছিলেন তেজপ্রতাপ। বিয়ের কয়েক মাস পরই বিচ্ছেদ হয়ে যায় তেজপ্রতাপের। সেই সময়ও বিস্তর শোরগোল হয়েছিল। জোর করে তেজপ্রতাপকে বিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসগ্রহণের পথেও বেরিয়ে পড়েন তেজপ্রতাপ। সেই টানাপোড়েনের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে ক্ষতি হয় RJD-র। চন্দ্রিকা দল ছেড়ে বেরিয়ে যান। পরবর্তীতে নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দলে যোগ দেন। তাই তেজপ্রতাপের প্রোফাইল থেকে করা ওই পোস্ট নতুন করে অস্বস্তিতে ফেলে দলকে। বিশেষ করে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে সকলে যখন ব্যস্ত, তেজপ্রতাপ এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেন কী করে, ওঠে প্রশ্ন। বিপাকে পড়ে তেজপ্রতাপ জানান, তাঁর প্রোফাইল হ্যাক হয়েছিল। কিন্তু ভাই তেজস্বী প্রতাপ পর্যন্ত তাঁর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
২) চলতি বছরেই হোলির দিন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। দেখা যায়, এক পুলিশ আধিকারিককে নাচতে বলছেন তিনি। তাঁকে বলতে শোনা যায়, “ও সিপাহি, ঠুমকা লাগাও। নইলে সাসপেন্ড করে দেওয়া হবে।” ভিডিওটি সামনে আসতেই বিতর্ক চরমে ওঠে। ক্ষমতায় না থেকেও তেজপ্রতাপ সরকারি আধিকারিককে ‘গরম দেখাচ্ছেন’ বলে মন্তব্য করেন বিরোধীরা। তেজপ্রতাপের দাবি ছিল, তিনি রসিকতা করেন মাত্র। যে কারণে ‘বুরা না মানো হোলি হ্যায়’ বলেন ওই আধিকারিককে।
৩) হোলির দিনই আর একটি ভিডিও সামনে আসে, যেখানে হেলমেট ছাড়া স্কুটার চালিয়ে পটনার রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায় তেজপ্রতাপকে। মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের বাড়ির বাইরে পৌঁছে চিৎকার করে বলেন, “পল্টুচাচা কোথায় গেল?” বার বার দলবদল করায় লালু খোদ নীতীশকে ‘পল্টুরাম’ বলে খোঁচা দিয়েছেন একাধিক বার, যা রাজনৈতিক কটাক্ষই ছিল। কিন্তু পদে আসীন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির বাইরে গিয়ে এভাবে হাঙ্গামা বাঁধানোয় সমালোচনার মুখে পড়েন তেজপ্রতাপ। হেলমেট না পরে স্কুটার জালানোর জন্য ৪০০০ টাকার চালাও কাটা হয় তেজপ্রতাপের নামে।
৪) রাষ্ট্রীয় জনতা দলের বিধায়ক তেজপ্রতাপ বিধানসভাতেও হুমকি-হুঁশিয়ারি দেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিধানসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর যে আচরণ, তা নিয়ে বার বার প্রশ্ন ওঠে। ভাই তেজস্বীর সমালোচনা শুনে একবার মারমুখী হয়ে উঠতেও দেখা যায় তাঁকে। ২০২২ সালে বিধানসভার স্পিকার বিজয় সিনহার কাছে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের দাবি জানান তেজপ্রতাপ। কথা বলার সময় যে মেজাজ দেখান তিনি, তা নিয়ে আপত্তি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।
৫) বিতর্কিত মন্তব্যের জন্যও বার বার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন তেজপ্রতাপ। নীতীশ কুমার, নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সীমাও অতিক্রম করেছেন তিনি বার বার। একবার মোদিকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে আক্রমণ করেন।
৬) নিজের দলের বর্ষীয়ান নেতাদেরও রেয়াত করেননি তেজপ্রতাপ। ২০১৮ সালে তেজপ্রতাপ নিজের ঘনিষ্ঠ একজনকে মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সেই নিয়ে দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রামচন্দ্র পূর্বের কাছে সেই মর্মে সুপারিশও করেন। সেই সুপারিশ গৃহীত না হলে রামচন্দ্র ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ তৈরি করতে চাইছেন বলে অভিযোগ করেন তেজপ্রতাপ। এর পর নিজের ঘনিষ্ঠ রাজেন্দ্র প্রতাপকে রাজ্য মহাসচিব পদেও বসান তিনি।
৭) ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ নিয়েও প্রায়শই খবরের শিরোনামে জায়গা করে নেন তেজপ্রতাপ। কখনও কৃষ্ণের বেশ ধারণ করেন তিনি। বাঁশি হাতি সংবাদমাধ্যমের সামনে পোজ দেন। কখনও আবার শিবলিঙ্গ আঁকড়ে ধরে নিজের জলাভিষেক করান। সেই নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি।
৮) দলের রাজ্য সভাপতি জগদানন্দ সিংহের সঙ্গেও বিবাদ বাঁধে তেজপ্রতাপের। ২০২১ সালে তেজপ্রতাপ সরাসরি জগদানন্দকে আক্রমণ করতে নামেন। তেজপ্রতাপের সমর্থক আকাশ যাদবকে ছাত্র সংগঠনের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেন জগদানন্দ। সেই পদে বসান গগন যাদবকে। গগন তেজস্বীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি তেজপ্রতাপের সঙ্গে যে অনুষ্কা নামের তরুণীর ছবি ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়, সেই অনুষ্কা আসলে আকাশের বোন। সেই সময় জগদানন্দের সঙ্গে তেজপ্রতাপের দ্বন্দ্ব মেটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয় লালুকে।
৯) রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘ (RSS)-এর মোকাবিলা করতে ২০১৫ সালে পৃথক সংগঠন তৈরি করেন তেজপ্রতাপ। নাম রাখেন ‘ধর্ম নিরপেক্ষ সেবক সঙ্ঘ’ (DSS). RJD কখনও ওই সংগঠনকে নিজেদের শাখা বলে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং এভাবে দলের বাইরে গিয়ে পৃথক সংগঠন তৈরি করার জন্য সমালোচিত হন তেজপ্রতাপ।
১০) ২০১৮ সালে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দারোগা রাইয়ের নাতনি, চন্দ্রিকা রাই যাদবের ঐশ্বর্যার সঙ্গে বিয়ে হয় তেজপ্রতাপের। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদের আর্জি জানান তেজপ্রতাপ। এখনও সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। তার মধ্যেই অনুষ্কার সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানিয়ে ফেসবুকে ওই পোস্ট করা হয়। আদালতে পরস্পরের বিরুদ্ধে মারাত্মক সব অভিযোগ এনেছেন তেজপ্রতাপ ও ঐশ্বর্যা। ঐশ্বর্যার দাবি, মাদক নিতেন তেজপ্রতাপ, পাশাপাশি, মহিলার পোশাকেও সাজগোজ করতেন। অন্য দিকে, তেজপ্রতাপের দাবি, খোরপোশ বাবদ প্রচুর টাকা দাবি করছেন ঐশ্বর্যা।
একের পর এক বিতর্কের জেরে RJD-তেও তেজপ্রতাপকে নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছিল। সেই আবহেই রবিবার বড় ছেলেকে দল ও পরিবার থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত সকলকে জানান লালু। সোশ্য়াল মিডিয়ায় তিনি লেখেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনে নৈতিক মূল্যবোধকে অবহেলা করলে, সামাজিক ন্যায়ের সার্বিক লড়াইও দুর্বল হয়ে পড়ে। জ্য়েষ্ঠপুত্রের গতিবিধি, আচরণ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আচরণ আমাদের পারিবারিত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। এমন পরিস্থিতিতে ওকে পরিবার ও দল থেকে দূর করলাম। এখন থেকে পরিবার এবং দলে ওর কোনও ভূমিকা থাকবে না। ছ’বছরের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হল’। লালু আরও লেখেন, ‘নিজের জীবনের ভাল-মন্দ, দোষ-গুণ সব বোঝার ক্ষমতা রয়েছে ওর। যে বা যাঁরা ওঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন, তাঁরা নিজের মতো করে শুনে সিদ্ধান্ত নিন। আমি জনসমক্ষে বরাবর ভদ্রতা বজায় রেখেছি। পরিবারের অনুগত সদস্যরা এই নীতি মেনেই চলেন’।
প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে ব্যক্তিগত জীবন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তেজপ্রতাপের রয়েছে বলে যদিও মন্তব্য করেছেন ভাই তেজস্বী। কিন্তু দাদার আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনিও। বোন রোহিনী আচার্য যাদবও বাবার সিদ্ধান্তকে কার্যত সমর্থন জানিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় রোহিনী লেখেন, ‘বার বার যে সীমা লঙ্ঘন করে, পরিবারের সম্মানকে যে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, তাদের সমালোচনার মুখে পড়তেই হবে। পরিবারই আমাদের মন্দির, বাবা আমাদের কাছে ঈশ্বরের সমতুল্য। সামাজিক ন্যায়কে সামনে রেখে বাবা যে দল তৈরি করেছেন, তা আমাদের কাছে আরাধ্য। কারও জন্য সেই মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে, তা মেনে নেব না’।
তেজপ্রতাপকে যে সময় দল এবং পরিবার থেকে বহিষ্কার করলেন লালু, তাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আর কয়েক মাস পরই বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। নীতীশ ও বিজেপি সরকারকে পরাজিত করতে জোর কদমে কাজ করছে RJD, যার আগ্রভাগে রয়েছেন তেজস্বী। সেই সময় তেজপ্রতাপের জন্য় দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করছিলেন কর্মী-সমর্থকরা। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে দল ও পরিবার থেকে ছেঁটে ফেলার কথা জানালেন লালু। তেজপ্রতাপের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সেদিকেই এখন তাকিয়ে সকলে।






















