এক্সপ্লোর
Advertisement
Blog: 'ইয়ে ইনকিলাব হ্য়ায়, স্যার'-প্রতিবাদের স্থপতি ভারতীয় কৃষকরা
পঞ্জাব, হরিয়ানার, ক্রমশঃ বাকি ভারতের চাষিরাও রাস্তায় নেমে সরকারকে একটু হলেও বিড়ম্বনায় ফেলেছেন। শাহিনবাগের প্রতিবাদীদের দেশ-বিরোধী তকমা দেওয়া হয়েছিল, যেহেতু তাঁদের অনেকেই মুসলিম মহিলা। তাই ওঁদের আর ওঁদের সমর্থক-পড়ুয়া, উদারবাদী, মানবাধিকার কর্মী, আর যাঁরা শুধু বিশ্বাস করেন ভারতের সবার ক্ষেত্রেই অতিথিপরায়ণ হওয়া উচিত, সবাইকেই এই ছাপ মেরে দেওয়া সহজ হয় যে, এঁরা ভারতের সামাজিক কাঠামোকে ভেঙেচুরে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন।
এক বছর আগে এই সময়টাতেই শাহিনবাগের দাদিরা ভারত রাষ্ট্রের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। ভারতীয় মধ্যবিত্তদের অধিকাংশই নিস্পৃহ ভাবে সেদিকে তাকিয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি তো কয়েক বছর আগেই মোদি সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অহিংস আন্দোলনগুলির অন্যতম ছিল দাদিদেরটা। সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিবাদ চলেছিল বেশ কয়েক মাস। তারপর এল অতিমারি। প্রত্য়েকের জীবনকে গ্রাস করল। সরকার দাদিদের তুলে বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে পাঠানোর অজুহাত পেয়ে গেল। এবার কৃষকরা বিদ্রোহ করেছে। একটা সম্পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশের আমআদমির লড়াইয়ে একটা নতুন ফ্রন্ট খুলেছে। এই সরকার শুধু বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর রোধই করে না, দম্ভ, ঔদ্ধত্যের অহঙ্কারেও ফুটছে। ইংরেজ রাজনীতিক-লেখক লর্ড অ্যাকটন বলেছিলেন, ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয় আর চূড়ান্ত ক্ষমতা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে।
পঞ্জাব, হরিয়ানার, ক্রমশঃ বাকি ভারতের চাষিরাও রাস্তায় নেমে সরকারকে একটু হলেও বিড়ম্বনায় ফেলেছেন। শাহিনবাগের প্রতিবাদীদের দেশ-বিরোধী তকমা দেওয়া হয়েছিল, যেহেতু তাঁদের অনেকেই মুসলিম মহিলা। তাই ওঁদের আর ওঁদের সমর্থক-পড়ুয়া, উদারবাদী, মানবাধিকার কর্মী, আর যাঁরা শুধু বিশ্বাস করেন ভারতের সবার ক্ষেত্রেই অতিথিপরায়ণ হওয়া উচিত, সবাইকেই এই ছাপ মেরে দেওয়া সহজ হয় যে, এঁরা ভারতের সামাজিক কাঠামোকে ভেঙেচুরে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু চষিদের এত সহজে বাতিল করে দেওয়া যায় না, যদিও এমন নয় যে, সেই চেষ্টা বিজেপি সরকার করেনি। রিপাবলিক টিভি, আরও নানা মিডিয়ায় তার লোকজন চিত্কার, শোরগোল করেছে। আর অবশ্য়ই মাঠে নেমেছে তার বিরাট ট্রোলবাহিনী, যারা ধুয়ো তুলেছে যেহেতু আন্দোলনরত কৃষকদের অনেকেই শিখ, তাই প্রতিবাদীরা নাকি খলিস্তানি। যখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনটা ধর্মনিরপেক্ষ, তখন তাকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়ার এক মরিয়া চেষ্টা এটা, ওদের কৃষক বিদ্বেষেরও প্রয়াস। বিজেপির সিনিয়র নেতারা অবশ্য ভিন্ন কৌশল, ভাষা প্রয়োগ করছেন, বলছেন, সেপ্টেম্বরে চালু হওয়া আইন সম্পর্কে ভুল ধারণা ঢোকানো হয়েছে কৃষকদের মনে, আর বিরোধীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ওঁদের ভুল বুঝিয়েছেন।
ব্যাপারটা অশোভন বটে, কিন্তু বিজেপির ঔপনিবেশিক শাসন কৌশলের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই যে, যে তিনটি আইনের দেশের কৃষিক্ষেত্রের ওপর বিরাট প্রভাব-প্রতিক্রিয়া হবে এবং যার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে, সেগুলি করোনাভাইরাস অতিমারীর মধ্য়েই পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা না করেই বিলগুলি পেশ করে দ্রুত অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। বিরোধী দলগুলি প্রতিবাদ করেছিল বটে, দাবি করেছিল, বিলগুলি আরও আলোচনা, মতামত বিনিময়ের জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হোক। কিন্তু বিজেপি সংসদে চূড়ান্ত সংখ্য়াগরিষ্ঠতার শক্তিতে সেপ্টেম্বরের শেষে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের ছাড়পত্রও আদায় করে নেয়। লোকজনকে যখন প্রকাশ্যে জমায়েত করতে বারণ করা হচ্ছে, তখন ভারতীয় কৃষকদের অবধারিত ভাবে বিপদে ফেলবেই যে বিলগুলি, সরকার সেগুলি পেশ করায় ভাবনাচিন্তা করেনি, কথাটা সহজেই বলা যায়, কেননা চিন্তা, যুক্তিবোধ, বৌদ্ধিক আলোচনা, মতামত বিনিময়- বর্তমানে ক্ষমতাসীন লোকজনের সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্কই নেই। কিন্তু একথাও সমান সত্য়ি, এটা করা হয়েছে একেবারে জেনেশুনে, এই আশায় ভরসা রেখে যে, করোনাভাইরাস অতিমারী ভারতবাসীর জীবনে এতটাই উথালপাতাল ঘটিয়ে দিয়েছে যে, সেদিকে লোকের নজর পড়বে না।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভারতে কৃষিক্ষেত্রে গভীর সঙ্কট চলছে, তার সংস্কার না হলেই নয়। একইভাবে এটাও মানতে হবে, যে তিনটি কৃষি আইন কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেট ও আর্থিক স্বার্থকামী শক্তির সামনে ‘উন্মুক্ত করে দেবে’, তার সমর্থকও আছে কৃষকদের একাংশের মধ্য়ে। এরা হল ধনী কৃষক, বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা, নয়া উদারবাদী সংস্কারের প্রতি দায়বদ্ধ অর্থনীতিবিদরা।
যদিও মোদি সরকারের ‘আলোচনা’র কোনও বাসনাই নেই এবং গত সাত বছরে তারা এমন কিছু প্রকাশে একগুঁয়ে অনীহা দেখিয়েছে, যাকে দুর্বলতার ইঙ্গিত বলে মনে হয়। ভারতীয় কৃষি ব্য়বস্থার অসুখটা কোথায়, তাকে চাঙ্গা করতে কী করা যেতে পারে যা কৃষককে আশার আলো দেখাবে, আমি আরেকটা নিবন্ধে বলব। যদিও মানুষের অহিংস কায়দায় বিরুদ্ধ মতপ্রকাশের অলঙ্ঘনীয় অধিকারের ইস্য়ুটাও বর্তমানে বিপন্ন। এই বিরুদ্ধ মত জানানোর অধিকারটাই সরকার খারিজ করতে চেয়েছে। কৃষকদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দেওয়া যেমন নিন্দার, তেমনিই এটা ধরে নেওয়াও অপমানজনক যে, নিজেদের স্বার্থ কীসে সবচেয়ে ভাল সুরক্ষিত থাকে, নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক কার্যকলাপ কাকে বলে, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা তাঁদের নেই। হাজারে হাজারে কৃষকের দিল্লিমুখী স্রোত রুখতে সরকার ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাস্তা ব্য়ারিকেড করেছে, ট্রাক্টর চড়ে আসা বহু কৃষকদের আটকাতে রাস্তা খুঁড়ে দিয়েছে। সম্প্রতি কয়েকদিন নিরাপত্তাবাহিনী কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্য়াস, জলকামান ব্যবহার করেছে। এগুলি হল একটা সরকারের মৌলিক দিক যাদের বিরুদ্ধ মতের প্রতি কোনও সহনশীলতাই নেই। এই বর্বরতার মুখে কৃষকদের অনমনীয় মনোভাব নায়কোচিত না হোক, অনুপ্রেরণামূলক তো বটেই।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ দেখিয়ে দিয়েছে, ভারতবাসীর মধ্যে সচেতনতা দিনদিন বাড়ছে, বিশেষতঃ যারা ক্ষমতাহীন, সহায়সম্বলহীন বা প্রান্তিক, তাদের মধ্যে। তারা সচেতন যে প্রতিবাদ করতে হবে পথে নেমে। বর্তমান আন্দোলনের আরেকটা চমকে দেওয়া দিক হল, সরকার এটাকে বিরোধীদের চালিত না হলেও, মদতপুষ্ট ‘বিপথগামী’ কৃষক আন্দোলন বলে দেগে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা একটা সরকারের বিরুদ্ধে জনমতের উত্সস্থল হয়ে উঠেছে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীর জীবনে ধ্বংস ডেকে আনা নীতি নিয়ে চলেছে। ভারতে প্রতিবাদের নতুন এক কাঠামো দেখা যাচ্ছে, যেখানে রাশটা মানুষের হাতে চলে এসেছে, রাস্তা হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের মূল পটভূমি। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পুনর্জন্মের জন্য় এই প্রতিবাদের কাঠামোটিকে দীর্ঘ সময় ধরে বাঁচিয়ে রাখতে ভারতবর্ষের জনগণের যাবতীয় সম্পদ প্রয়োজন হবে। আমার মনে হয়, এই মুহূর্তটার প্রতিশ্রুতি আর কোনওভাবেই ফুটে ওঠেনি যেভাবে তরুণ শিখ অভিনেতা দীপ সিধু, একটি ভিডিওতে যেমন দেখা গিয়েছে, ভাষণ দেওয়ার সময় ইউনিফর্ম পরা এক নিরাপত্তা অফিসারকে তিরস্কার করে বলছেন, এধরনের আন্দোলন মোকাবিলার এটা কোনও পথই নয়। ইয়ে ইনকিলাব হ্যায়, স্যার। এ এক বিপ্লব।
নিবন্ধকার মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মতামত ব্য়ক্তিগত
খবর (News) লেটেস্ট খবর এবং আপডেট জানার জন্য দেখুন এবিপি লাইভ। ব্রেকিং নিউজ এবং ডেলি শিরোনাম দেখতে চোখ রাখুন এবিপি আনন্দ লাইভ টিভিতে
আরও দেখুন
Advertisement
ট্রেন্ডিং
Advertisement
Advertisement
সেরা শিরোনাম
খবর
খবর
জেলার
জেলার
Advertisement