Jalpaiguri Profile: মাটিতে মিশে রয়েছে ইতিহাসের সোঁদা গন্ধ, স্নিগ্ধতায় মোড়া জলপাইগুড়িকে চিনুন অন্য় আঙ্গিকে
Jalpaiguri Profile: জলপাইগুড়ির আর এক নাম অলিভ টাউন। জেনে নিন বিস্তীর্ণ অভয়ারণ্য়ে ঘেরা এই জেলার অজানা তথ্য়।

ইতিহাস:
ইতিহাস অনুযায়ী এই জেলার নাম জল্পেশ্বর থেকে এসেছে যেটা শিব ঠাকুরের আরেক নাম,কিন্তু কেউ কেউ বলে এই স্থানে আগে নাকি জলপাই এর গাছ প্রচুর মাত্রায় ছিল,যাহার জন্য এই জায়গার নাম জলপাইগুড়ি। পূর্বে এই স্থানটি কোস্নিগ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বেড়াজালচ-রাজবংশীদের এক ভাগ ছিল যাহার নাম ছিল কামতাপুর।১৮৬৯ সালে এই জেলাটির স্থাপন করা হয়। জলপাইগুড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে করলা নদীর নাম। জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির ইতিহাসও বহু প্রাচীন। এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে এখনও ভিড় জমান বহু মানুষ। এটি বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের দৌলতে দেবী চৌধুরানির কথা সর্বজনবিদিত। জলপাইগুড়ি জেলাতেই রয়েছে তাঁর নামাঙ্কিত মন্দির। জলপাইগুড়ির গোশালা মোড়ে রয়েছে কালীমন্দির,যেখানে দেবী চৌধুরানি পুজো দিতেন বলে কথিত। পাশাপাশি শিকারপুরে আরও একটি মন্দির রয়েছে,যেখানে পূজিতা হন খোদ দেবী চৌধুরানি। এই মন্দিরে একবার ভয়াবহ আগুন লেগে বিস্তর ক্ষতিও হয়েছিল।
অবস্থান
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ভাগে অবস্থিত। জেলাটির পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা, উত্তরে ভুটান রাষ্ট্র এবং দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা এবং বাংলাদেশ-এর পঞ্চগড় জেলা অবস্থিত । এই জেলার সদর হল জলপাইগুড়ি। এটি এমন একটি অনন্য জেলা,যার দুই প্রান্তে দুটি ভিন্ন দেশ রয়েছে।
পর্যটন:
জলপাইগুড়ি শহর
জলপাইগুড়ি একটি সুন্দর পাহাড়ি শহর,যা “অলিভ টাউন” নামেও পরিচিত। এই নামের উৎপত্তি প্রায় ১৯ দশকে যখন এই অঞ্চলটি বেশ কয়েকটি সমৃদ্ধ জলপাই বাগানের আবাসস্থল ছিল। এই শহরটি বেশ কয়েকটি ছোট এবং সুন্দর নদী দিয়ে ঘেরা। এর চারপাশে রয়েছে এক । এগুলি ছাড়াও,আপনি চা বাগানের অন্তহীন দৃশ্যও দেখতে পারেন, যা এই চিত্তাকর্ষক যাত্রাপথের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
গোরুমারা জাতীয় উদ্যান
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত গোরুমারা জাতীয় উদ্যান জলপাইগুড়ি জেলার একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত, এই মাঝারি আকারের পার্কটি মূলত ভারতীয় গন্ডারের জন্য পরিচিত এবং এটি সবুজ গাছপালা এবং তৃণভূমিতে আচ্ছাদিত। পার্কের মনোরম দৃশ্য সত্যি তৃপ্তিদায়ক। এখানে তিনটি স্বতন্ত্র নদী-মূর্তি নদী, রায়ডাক নদী এবং প্রধান জলঢাকা নদীর অপূর্ব দৃশ্য পর্যটককে মুগ্ধ করে। সরস্বতী, বুধুরাম, চৌতুরাম, বিছাভাঙ্গা এবং মূর্তি প্রভৃতি গ্রামগুলি এই বিস্তৃত বনকে ঘিরে রেখেছে।অসংখ্য সাধারণ উদ্ভিদ,ছোট ও বড় গাছের দল এবং বন্য পরিবেশ পার্কটিকে শোভিত করে। বন্য শুয়োর,বড়ো কাঠবিড়ালি,চিতল হরিণ,কাঠঠোকরা,সাম্বল হরিণ এবং ভারতীয় নেকড়ে এখানের কিছু বিশেষ প্রাণী এবং পাখিদের জাতি।বন্যপ্রাণী দেখার সবথেকে ভাল উপায় হল জিপ সাফারি। এর মাধ্যমে আপনি এই বন্য পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন যাত্রাপ্রসাদ এবং চন্দ্রচূড়ের মতো ওয়াচ টাওয়ার এর উপর থেকে যেখান থেকে আপনিই চমৎকার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পেতে পারেন এই অরণ্যের ও প্রাণীদের।
ডুয়ার্স
বাংলা-অসম সীমানার কাছে অবস্থিত ডুয়ার্স (Dooars) ভ্রমণপ্রেমীদের অত্যন্ত পছন্দের স্থান। ডুয়ার্সের নামের অর্থই হল দরজা। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ডুয়ার্স হয়ে যেমন অসমে প্রবেশ করা যায়, তেমনই ডুয়ার্স কিন্তু ভারত থেকে ভুটান প্রবেশপথও বটে। তিস্তা থেকে ধানসিরি পর্যন্ত ৩৫০ কিলোমিটার লম্বা ডুয়ার্স তরাই অঞ্চলের অন্তর্গত। ডুয়ার্সের সবুজ গাছপালায় ভরায় চারিপাশ প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে ধরতে বাধ্য।
মূর্তি
মূর্তি হল একটি ছোট গ্রাম যার নামকরণ করা হয়েছে একটি সুন্দর নদীর ওপর। এই নদী এই গ্রাম বরাবর এবং নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের উঁচু ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম এবং ভুটানের সীমানার সংযোগের কাছে উৎপন্ন হয় এবং পাহাড়ি উপত্যকা থেকে স্যামসিং এলাকার মধ্য দিয়ে ডুয়ার্সে প্রবাহিত হয়।
বক্সা
অভয়ারণ্য় ও বন্যপ্রাণীর কথা যখন হচ্ছেই, তখন বক্সাকে (Buxa Tiger Reserve) বাদ দেওয়া একেবারেই সম্ভব। ৭৬০ স্কোয়ার কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত বক্সা জাতীয় উদ্যানের বাঘ সংরক্ষণের জন্য জগতজোড়া খ্যাতি। বাঘের পাশাপাশি হাতি, শূকর, গন্ধগোকুলের মতো প্রাণীদেরও এই উদ্যানে দেখা যায়।
জয়ন্তী অভয়ারণ্য
বক্সা বাঘ সংরক্ষণের মধ্যেই একটি ছোট্ট অভয়ারণ্য হল জয়ন্তী অভয়ারণ্য। এই স্থানটি হাইকার্সদের বিশেষভাবে টানে। অপরূপ পারিপার্শ্বিক দৃশ্য এবং একাধিক মনমুগ্ধকর ঝর্না হাইকার্সদের আকর্ষিত করে। বক্সাদুয়ার থেকে জয়ন্তীর ১৩ কিলোমিটার পথ হাইকিংয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। এছাড়া মহাকাল নামে একটি পাহাড়ও রয়েছে জয়ন্তীতে।
অর্থনীতি:
চা বাগান এবং পর্যটন-এই দুটি জলপাইগুড়ি জেলার অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। পাশাপাশি রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাধারি শিল্প। কৃষিকাজও জলপাইগুড়ি জেলার একটি বড় অংশের বাসিন্দারা পেশা। ডুয়ার্স এলাকায় চা বাগানের ছড়াছড়ি। ব্রিটিশ আমল থেকেই চা বাগান এই এলাকায় অর্থনীতির ভিত্তি ছিল। চা বাগানের কাজের জন্য ভিন রাজ্য থেকেও লোকজন আসতেন এখানে। তাঁদের উপর ভিত্তি করে স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলেছে। এই জায়গায় ধাক্কা লেগেছিল, ষাটের দশকের শেষদিকে। সেই সময় ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল জলপাইগুড়ি জেলায়। ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি হয়েছিল বহু। তারপর থেকেই চা বাগানের মালিকানা বদল হতে শুরু করে। নানা কারণে চা শিল্পের ভরকেন্দ্র ওই জেলা থেকে সরে আসে। তাছাড়া, বাংলার চা শিল্পে দীর্ঘদিন ধরেই ভাঁটা চলছে, তার প্রভাবও রয়েছে। চা শিল্প ছাড়া জলপাইগুড়ির অর্থনীতির ভরসার জায়গা পর্যটন। রাজ্য-দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ঘুরতে আসেন বহু পর্যটক। জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স বিদেশি পর্যটকদেরও অত্যন্ত পছন্দের জায়গা। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে বহু কর্মসংস্থান হয়। সেই ছবি দেখা গিয়েছে এই জেলাতেও। পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য সরকারের তরফেও একাধিক পদক্ষেপ করা হয়েছে।
জেলায় রয়েছে একাধিক শিল্প তালুক। আমবাড়ি-ফালাকাটা, রানিনগর, ডাবগ্রাম, ফাটাপুকুর-এ শিল্প গড়ে তোলার জন্য জমির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে সাড়াও মিলছে।
রাজনীতি:
জলপাইগুড়ি জেলা এমনিতে শান্তিপ্রবণ। রাজনৈতিক দিক থেকেও এই জেলার বেশ কিছু এলাকায় সৌজন্যের ছবি দেখা যায়। বাম আমলে এই জেলায় বামেদের দাপট ছিল সর্বজনবিদিত। তবে জলপাইগুড়ি পুর এলাকা ছিল কংগ্রেসের বরাবরের শক্ত ঘাঁটি। জেলাগত ভাবে বিচার করলে এই জেলায় আদিবাসী ভোট বেশ বড় অংশ। তার প্রভাবও রয়েছে। রয়েছে চা বাগান এলাকা। ২০১১ সালের রাজ্যের মসনদে পালাবদলের পরে এখানে একচেটিয়াভাবে তৃণমূলের জয় দেখা গিয়েছিল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জেলার ৬ বিধানসভা গিয়েছিল তৃণমূলের দখলে, একটি ছিল কংগ্রেসের। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে একেবারে পাল্টে যায় রাজনৈতিক সমীকরণ। বিপুল ভোটে জয়ী হয় বিজেপি। বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফল ধরলে ৬টিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি, মাত্র ১টিতে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য বেশ কিছু জমি ফের দখল করে তৃণমূল। ৪টি যায় বিজেপির কাছে, ৩টিতে জয়লাভ করে তৃণমূল। এখন এই জেলায় ঘাসফুল শিবির ও পদ্মফুল শিবির- দুটিরই শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। তবে সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে বাম ও কংগ্রেস।
প্রশাসনিক কাঠামো:
জলপাইগুড়ির আয়তন ৩৩৮৬.১৮ বর্গ কিলোমিটার। জলপাইগুড়ি জেলার সরকারি ওয়েবসাইট বলছে, এই জেলায় সাব ডিভিশন রয়েছে ২টি- জলপাইগুড়ি সাব ডিভিশন এবং মাল সাব ডিভিশন। ২টি সাব ডিভিশন মিলিয়ে মোট ৯টি ব্লক রয়েছে। পঞ্চায়েত সমিত ৯টি। এই জেলায় রয়েছে ৮০টি গ্রাম পঞ্চায়েত। জেলায় রয়েছে জলপাইগুড়ি আদালত। জলপাইগুড়ি জেলায় রয়েছে ৯টি থানা এবং ২টি পুলিশ আউট-পোস্ট।
এই জেলায় ৮টি বিধানসভা আসন রয়েছে। তার মধ্যে সাতটি হল ধূপগুড়ি,ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি,রাজগঞ্জ,ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি, মাল, নাগরাকাটা। এছাড়া রয়েছে মাদারিহাট বিধানসভা কেন্দ্র। যার কিছুটা জলপাইগুড়ি এবং কিছুটা আলিপুরদুয়ার জেলার অংশে পড়ে। এই জেলায় একটিই লোকসভা কেন্দ্র- নাম জলপাগুড়ি।
কীভাবে পৌঁছবেন?
কলকাতা, নয়াদিল্লি, চেন্নাই ও গুয়াহাটি থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে আসার বিমান রয়েছে। বাগডোগারাই এই জেলার সবথেকে কাছের বিমানবন্দর। বাগডোগরা থেকে সহজেই ভাড়ার ট্যাক্সি, বাসে করে জলপাইগুড়ি পৌঁছে যাওয়া যায়।
উত্তরবঙ্গ জাতীয় পরিবহন কর্পারেশন, দক্ষিণবঙ্গ জাতীয় পরিবহন কর্পারেশন, কলকাতা পরিবহন কর্পারেশনের একাধিক বাসের মাধ্যমে সড়কপথে সহজেই জলপাইগুড়ি পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।
কলকাতার এবং পারিপার্শ্বিক স্থান থেকে আগত পর্যটকরা নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে নেমে সহজেই এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলি ভ্রমণ করতে পারেন। এছাড়া বিশ্বখ্যাত দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে তো আছেই। এর মাধ্য়মেই জলপাইগুড়ি থেকে সহজে দার্জিলিংয়েও পৌঁছে যাওয়া যায়।


















