SSC Case: ‘হয়ত শিক্ষক হতে পারবেন না, গ্রুপ সি-তে যাতে হয়...শীঘ্রই জানাব’, চাকরিহারাদের উদ্দেশে মমতা
Mamata Banerjee: শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বুধবার কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন মমতা।

কলকাতা: 'দাগি'দের হয়ে সওয়াল করায় রাজ্যকে ফের ভর্ৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই আবহেই নিয়োগে জটিলতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, ২১ হাজার শূন্যপদ থাকলেও, মামলার কারণে নিয়োগ থমকে রয়েছে। আইনি জটিলতায় বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে নিয়োগপ্রক্রিয়া। শুধু তাই নয়, চাকরিহারাদের অন্তত গ্রুপ সি পদে যাতে কাজ দেওয়া যায়, তা নিয়ে আইনি পথে কোনও ব্যবস্থা করবেন বলে মন্তব্য করেছেন মমতা। (SSC Case)
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বুধবার কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন মমতা। সেখানে তিনি বলেন, "এই যে শিক্ষকদের অনেকের চাকরি চলে গিয়েছে। আপনারা কী ভাবছেন, আমি মানসিক ভাবে এতে খুশি? না। যাঁরা চাকরি করতেন, যাঁরা 'দাগি' নন, তাঁদের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছি ইতিমধ্যেই। ১০-১২ বছর চাকরি করেছেন বলে তাঁদের বয়সে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। ১০ শতাংশ বাড়তি রাখা হয়েছে অভিজ্ঞতার জন্য। প্রায় ৩০ শতাংশ রাখা হয়েছে যেটা, তাঁরা সুযোগটা পেতে পারেন আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী। এখানে আমাদের হাত-পা বাঁধা। আমরা এখানে যেটা করতে পারি, সেটা হচ্ছে, আমরা ওঁদের অ্যাডভান্টেজ দিয়েছি, যাতে পরীক্ষা দিয়ে স্বমহিমায় ফিরে আসতে পারেন তাঁরা।" (Mamata Banerjee)
মমতা আরও বলেন, "রইল গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি, অশিক্ষক কর্মচারীবৃন্দ। তাঁদের জন্য আদালত বলেছিল, অন্য জায়গায় তাঁরা করতে পারেন। সেটার বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিয়েছি আমরা। আদালতের এই প্রক্রিয়াটা মিটে যাবে দু'তিন মাসের মধ্যে। সেটা হয়ে গেলেই গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি-র পরীক্ষাটা হবে। আর রইল পড়ে আমার হাতে আরও কিছু, যাঁরা শিক্ষকতা করেও আজকে অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী হয়ত শিক্ষক হতে পারবেন না তাঁরা। কিন্তু তাঁরা যাতে গ্রুপ সি-তে পায়, বা সেরকম পর্যায়ে, আইনি পরামর্শ করে খুব শীঘ্র সেটা জানাব। আমি কাউতে হতাশ হতে বারণ করব। কারণ আমাদের সরকার মানবিক। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক নয়, মানবিক।"
কিন্তু মমতার এই মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চাকরিহারা শিক্ষক সুমন বিশ্বাস। তাঁর বক্তব্য, "সকল যোগ্যদের চাকরি ফেরাতে হবে ধারাবাহিকতা সহ। এই যে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, যোগ্যতার তালিকা প্রকাশিত হলে, পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তাই নেই। অনেক চাকরিপ্রার্থী আছেন, যাঁরা পরীক্ষায় বসতে পারেননি। রাজ্য সরকার মানবিক হয়ে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী পরীক্ষা স্থগিত করুন। জেদাজেদি না করে...আমরা এখন মৃত্যুপথযাত্রী। বিধানসভায় জরুরি অধিবেশন হচ্ছে না কেন? বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষত, এত এত যোগ্য শিক্ষক, এই রাষ্ট্র, এই দেশ, এই নির্বাচিত সরকার ন্যায় দিচ্ছে না। বিধানসভায় আমাদের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিকে সন্তানস্নেহে ডেকে নিন। নতুনদের সঙ্গে পুরনো চাকরিপ্রার্থীদের পরীক্ষায় বসিয়ে দিয়ে ২০২৬ সালের নির্বাচনী বৈতরণীর পার হওয়ার প্রচেষ্টা এটা।"
এদিন বিধানসভার বাইরে পৌঁছন সুমন। তিনি বলেন, "হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে প্রমাণিত। প্যানেল বাতিল হল কেন? এই যে ১৮০৬ জন অযোগ্য, চাকরিগুলি কারা বিক্রি করল? এদের কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? বেতন ফেরানো হচ্ছে না কেন? যোগ্যদের কথা ভাবা হচ্ছে না কেন?"
মমতার মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "আইনি পথে এই ধরনের ব্যবস্থা হয় না। এসব করে আরও আইনি জটিলতা তৈরি হবে। ভবিষ্যতে এই নিয়োগগুলি আবার না প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। বার বার আবেদন করা হয়েছিল তালিকা প্রকাশ করতে। শেষে সুপ্রিম কোর্ট বলার পর 'দাগি'দের তালিকা বের করা হল। এতেও অনেক গলদ রয়েছে। সঠিক তালিকা নয় এটা। আইনি জটিলতা তৈরি করে রেখেছেন, কারা প্য়ানেল এক্সপায়ারি, কারা ব্ল্যাঙ্ক OMR, কারা OMR মিসম্যাচ, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এই ধরনের জটিলতা হলে মামলা তো হবেই! দেখলেই বোঝা যাবে তালিকাটা গলদ। উনি ২১ হাজার বা ৫০ হাজার পদ তৈরি করুন। বঞ্চিতরা তো আদালতে আসবেই। এসব অবাস্তব কথা। উনি রাজনীতির জন্য বলতেই পারেন। এর সঙ্গে আইনের সম্পর্ক নেই। এঁদের যদি গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি-তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে উদ্দেশ্য স্পষ্ট। 'দাগি'দের বাঁচাতেই সরকার এই ব্যবস্থা করছে। দেখবেন তালিকার অধিকাংশই শাসকদলের লোক। অযোগ্যদের নিয়ে চিন্তিত উনি, যোগ্যদের জন্য নন, আবারও প্রমাণ করে দিলেন।"
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, "আজ যে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য দায়ী তৃণমূল, তাদের সীমাহীন লোভ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং লাগামছাড়া লুঠ। গোটা সমাজকে খোলা বাজার বানিয়ে দেওয়ায় এই পরিস্থিতি। মেধা প্রতারিত হয়েছে। শিক্ষকের চাকরি না পেলে করণিকের চাকরি দেওয়া হবে। এর পর বলবেন, আইনি জটিলতার কারণে করণিকদের গ্রুপ ডি-র চাকরি দেওয়া হবে। এটাই পশ্চিবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি। পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করলে, কারা চাকরি কিনেছে, কারা বিক্রি করেছে, তাহলেই এসব করতে হতো না। দুর্নীতিগ্রস্তদের উপর সরকারি সিলমোহর বসিয়ে দেওয়াতেই এই পরিস্থিতি। মেধা প্রতারিত হলে কোথায় যাবে, কালীঘাটে গিয়ে কাঁদবে? সে তো আদালতে যাবে! তাই গিয়েছে। মানুষের অধিকারের জন্য আদালত তৈরি হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী কি আদালত তুলে দিতে চান! কোনও মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে এই ধরনের মন্তব্য করতে পারেন কি?"
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী রোজ যেভাবে 'দাগি'দের হয়ে সওয়াল করছেন, তাতে রাজ্যের ভূমিকায় সুপ্রিম কোর্টও বিস্ময় প্রকাশ করছে। আসলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর বিকল্প নেই। 'দাগি'দের মারফত টাকা তুলেছেন, পরীক্ষার্থীদের দায়ে দাগ লাগিয়ে দিয়েছেন। আর সমস্ত অর্থ কালীঘাটে পৌঁছে গিয়েছে...মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর বাহিনী সবচেয়ে 'দাগি'। ওঁরা 'দাগি'দের হেডমাস্টার। তাই পাশে আছেন। ২১ হাজার নয়, শিক্ষাক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লক্ষ শূন্যপদ, সরকারি ক্ষেত্রে সাড়ে ৬ লক্ষ। নিয়ম মেনে সেগুলি পূরণ হোক। হোক নিয়ম মেনে। টাকা নিয়ে, কাউকে খুশি করে, গ্রুপ সি-তে না পেরে গ্রুপ ডি-তে ঢুকিয়ে দিলাম, এসব করে করে পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজের কাজের ব্যবস্থা ধ্বংস করেছেন। বন্ধ করুন।"
যদিও তৃণমূলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলেন, "বিরোধীরা আসলে এক শ্রেণির রাজনৈতিক অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। রাজনীতির ময়দানে পেরে না উঠে, আদালতকে ব্যবহার করে, রাজ্যের ভবিষ্যৎ নষ্টের চেষ্টা করছে। মুখ্যমন্ত্রী বেআইনি নিয়োগের কথা বলেননি। ৫৬ হাজার শূন্যপদ রয়েছে, তার মধ্যে ৩৫ হাজার ৭২৬টির জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২১ হাজার পদ খালি। ১০ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন যাঁরা, যাঁদের অযোগ্য বলা হচ্ছে, তাঁদের জন্য আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ বেআইনি কাজ নয়, যাঁর চাকরি চলে গিয়েছে, বেতন ফেরত দিতে হচ্ছে...যদি ধরেও নেওয়া হয় অন্যায় ভাবে চাকরি হয়েছিল, একই অপরাধে কতবার শাস্তি পাবেন! তিন দিনের জেলের পর সাত মাসের ফাঁসি তো হতে পারে না! আইন মেনে যেমন ১০ মাস সময় দেওয়া হচ্ছে, একই ভাবে ১০ বছর কাজ করে যাঁরা আজ সর্বহারা, তাঁদের জন্য শিক্ষকতা না হলেও, গ্রুপ সি বা গ্রুপ ডি-র ব্যবস্থা করতে যাওয়া কি মানবিক পদক্ষেপ নয়! রাজনৈতিক কারণে অনেক কথা বলতে পারেন বিরোধীরা। কিন্তু প্রায় এক লক্ষ মানুষের চোখের জলের বিনিময়ে যাঁরা রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড তুলছেন, তাঁরা তুলুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের পাশে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।"






















