Durga Puja Special: হিমালয় দর্শন, ভিনরাজ্যে আলুপোস্ত-ডাল, পরম শান্তি, এবারের পুজোর ছুটি কাটুক দেবভূমি উত্তরাখণ্ডে
হিমালয় বরাবরই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে স্বর্গরাজ্য। সুবিশাল পর্বতমালার অমোঘ আকর্ষণে প্রাচীনকাল থেকেই ছুটে যান অসংখ্য মানুষ। দেবভূমি উত্তরাখণ্ড এমনই একটি রাজ্য।
কলকাতা: করোনা আবহে গত দেড় বছর ধরে বাড়িতে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছেন? এবারের পুজোয় দূরে কোথাও যেতে চাইছেন? সাত-পাঁচ না ভেবে দুগ্গা দুগ্গা বলে বেড়িয়েই পড়ুন। ট্রেনের টিকিট পেতে এবার পুজোর আগে আর অন্যবারের মতো হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে না। সহজেই রিজার্ভেশন পাওয়া যাচ্ছে। হোটেলেও বুকিং পেতে সমস্যা হবে না। ফলে বেড়ানো সহজই হবে।
হিমালয় বরাবরই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে স্বর্গরাজ্য। সুবিশাল পর্বতমালার অমোঘ আকর্ষণে প্রাচীনকাল থেকেই ছুটে যান অসংখ্য মানুষ। দেবভূমি উত্তরাখণ্ড এমনই একটি রাজ্য। প্রকৃতি অপার ঐশ্বর্য সাজিয়ে রেখেছে এখানে। পুণ্যার্থীদের কাছে যেমন এই রাজ্যের বিশেষ গুরুত্ব আছে, তেমনই যাঁরা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাঁরাও বারবার ছুটে যান। এবারের পুজোর ছুটি কাটাতেও উত্তরাখণ্ডে যাওয়া যেতেই পারে। ভ্যাকসিন ডোজ সম্পূর্ণ হয়ে থাকলে তো কথাই নেই, না হলেও আরটি-পিসিআর টেস্ট করে নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে চলে যাওয়া যায়।
কুমায়ুন হিমালয়ের অন্যতম প্রধান শহর নৈনিতাল। এই অঞ্চলের সৌন্দর্য অপরিসীম। প্রকৃতিদেবী যেন নিজের হাতে এই অঞ্চলটিকে যত্ন করে সাজিয়েছেন। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও, নৈনিতাল ছাড়িয়ে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এখানে প্রকৃতি এখনও অনেকটাই ‘উন্নয়ন’-এর ছোঁয়াচ এড়িয়ে থাকতে পেরেছে। ফলে হিমালয় দর্শনের আনন্দ লাভ করা যায়। বেশিরভাগ পর্যটকই কুমায়ুন হিমালয় ভ্রমণ শুরু করেন কাঠগোদাম স্টেশন থেকে। হাতে কতদিন আছে, তার ওপর গন্তব্য নির্ভর করে। চার-পাঁচদিনের জন্য ঘুরতে চাইলে নৈনিতাল, আলমোড়া, রানিখেত, কৌশানি, বিনসর যাওয়া যেতে পারে। আর হাতে যদি দিনদশেক থাকে, তাহলে আরও অনেক জায়গা যাওয়া যায়। সবটাই নির্ভর করছে সময়ের ওপর।
প্রথমে দেখে নেওয়া যাক অল্প কয়েকদিনের জন্য কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে। যদি চার-পাঁচদিন থাকে, তাহলে কৌশানি দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। কাঠগোদাম থেকে কৌশানি ১৩৩ কিলোমিটার। সোজা গেলে সময় লাগে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। তবে পাহাড়ে যেহেতু সন্ধে নামলেই আর কিছু করার থাকে না, বিশেষ করে কৌশানির মতো জায়গায় তো হোটেলের বাইরে রাতের অন্ধকারে গিয়ে লাভ নেই, সেখানে শেষ বিকেলে পৌঁছনোর চেয়ে যাওয়ার পথে রানিখেত ঘুরে দেখা ভাল। সেনাবাহিনীর হাতে থাকা রানিখেত ছবির মতো সুন্দর। ছোট্ট এই শহরের সব জায়গাই অসাধারণ। কৌশানি যাওয়ার পথে চাইলে প্যারাগ্লাইডিও করে নেওয়া যেতে পারে।
সন্ধের মুখে কৌশানি পৌঁছে প্রথমবার যাওয়া পর্যটকরা কিছুটা চমকে যেতে পারেন। হোটেলে পরিষ্কার বাংলায় লেখা, কী করা যেতে পারে, কী করা বারণ। ডাল, ভারত, পোস্ত, আলুভাজা, মাছ, মাংস, নানারকম তরকারি, সবই পাওয়া যায়। খাবারের স্বাদও অপূর্ব।
কৌশানিতে প্রথমদিন হোটেলের ঘরে গিয়ে স্নান সেরে তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়াই ভাল। কারণ, ভোরে উঠেই সূর্যোদয় দেখতে হবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে উপত্যকার দিকে চোখ রাখলে দূরে হাজার হাজার আলো ঠিক যেন জোনাকির মতো দেখা যায়। অপূর্ব সে দৃশ্য। কৌশানির মতো প্রশস্ত উপত্যকা ভারতের খুব কম জায়গাতেই আছে। ফলে এখান থেকে খুব ভালভাবে সূর্যোদয় দেখা যায়। পরপর অনেকগুলো পর্বতশৃঙ্গ দৃশ্যমান। ভোরবেলা যখন প্রথম আলো ফোটে, তখন পাহাড়ের চূড়া লাল হয়ে যায়। ধীরে ধীরে রং বদলাতে থাকে পাহাড়। এই স্বর্গীয় দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করার পর প্রাতঃরাশ সেরে বেড়িয়ে পড়ুন। প্রথমেই চলে যান গাঁধী আশ্রমে। এখান থেকেই হিমালয় দর্শন করেছিলেন মহাত্মা গাঁধী। এই আশ্রমে অনেকে ধ্যানও করেন। গাঁধী আশ্রমের পাশেই সরলা আশ্রম। একটু হেঁটে গেলেই সুমিত্রনন্দন পন্থ মিউজিয়াম। বিখ্যাত সাহিত্যিক সুমিত্রনন্দন পন্থের জন্ম কৌশানিতেই। তাঁর বাসভবন এখন মিউজিয়াম হয়েছে। সুমিত্রনন্দন পন্থ অজিতাভ বচ্চনের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তিনিই অমিতাভ বচ্চনের নামকরণ করেন। বাংলার সঙ্গেও সুমিত্রনন্দন পন্থের যোগাযোগ ছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ছবিও আছে মিউজিয়ামে।
এবার আর হাঁটা পথে যাওয়া চলে না। গাড়ি নিয়ে প্রথমেই চলে যান বৈজনাথ মন্দিরে। কয়েক শতাব্দী প্রাচীন মন্দির ঘুরে দেখুন। পুকুরে অজস্র মাছ দেখতে পাবেন। এখানে কেউ মাছ ধরে না। বৈজনাথ মন্দির থেকে চলে যান সোমেশ্বর মন্দির, বাগেশ্বর মন্দিরে। হোটেলে ফেরার পথে দেখে নিন চা বাগান, শাল ফ্যাক্টরি। বাঙালি শৈলশহরে গেলে শীতবস্ত্র কেনেই। কৌশানিতে তার বিশাল সম্ভার রয়েছে। এছাড়া খুব সুন্দর সাবান, মোমের তৈরি নানা সুন্দর ঘর সাজানোর জিনিস, চা পাওয়া যায়। এগুলোও কেনা যেতে পারে। হোটেলে ফিরে খেয়ে বিকেলে ফের পাহাড়ের রং বদলানো দেখে নিন। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফের ঘুম। পরদিন ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখে নিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে নিয়ে হোটেল থেকে একেবারে মালপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। গাড়ি নিয়ে চলে যান রুদ্রধারী মন্দির দর্শনে। এখানে গাইড ছাড়া যাওয়া যায় না। দেড় কিলোমিটার উঠে শিবমন্দির দর্শন করা যায়। মন্দিরের পাশেই ঝর্ণা, জল কাচের মতো। এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঝর্ণা খুব কমই দেখা যায়। শ্বাসকষ্ট না থাকলে এবং পাহাড়ে চড়ার অভ্যাস থাকলে আট কিলোমিটার ওপরে যাওয়া যায়। এই আট কিলোমিটার ট্রেকের অভিজ্ঞতা সারাজীবন থেকে যাবে।
এবার কৌশানিকে বিদায় জানিয়ে চলে আসুন নৈনিতালে। আসার পথে ঘুরে নিন আলমোড়া। এখানে মিষ্টি খেতে ভুলবেন না। পাতায় মোড়া এক ধরনের সন্দেশ পাওয়া যায়, স্বাদ অপূর্ব। নৈনিতালে এসে হোটেলে মালপত্র রেখে স্নান সেরে ম্যাল, মার্কেট ঘুরে নিন। নয়না দেবীর মন্দিরেও যেতে পারেন। মার্কেটের মধ্যে একটা ছোট্ট মোমোর দোকান আছে। একবার যদি সেই দোকানের মোমো খান, শুধু এটা খাওয়ার জন্যই আরও একবার নৈনিতাল যাওয়ার ইচ্ছা হতে পারে।
নৈনিতালে দ্বিতীয় দিন ভোরে উঠে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। প্রথমেই চলে যান ভিউ পয়েন্টে। যাওয়ার পথে বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবন পড়বে। আপনার পূর্বপুরুষ যদি পূর্ববঙ্গ থেকে এসে থাকে, তাহলে গাড়ির চালক যখন উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট দেখাবে, তখন আপনি বলতেই পারেন, ‘বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাবেন না।’ কৌশানির মতো সুন্দর না হলেও, নৈনিতাল থেকেও দারুণ পাহাড় দেখা যায়। চাইলে ঘোড়ার পিঠেও চড়ে নিতে পারেন। এরপর এক এক করে সরিয়াতাল, খুরপাতাল, শুখা তাল, কমল তাল, ভীমতাল, সাততাল, নাকুচিয়া তাল ঘুরে নিন। পথে পড়বে বেশ কয়েকটি মন্দির। চাইলে রোপওয়েতে গোটা নৈনিতাল শহর পরিক্রমা করতে পারেন। পরদিন বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরার আগে নৈনিতালে বোটিং সেরে নিন। ভ্রমণ সম্পূর্ণ হবে।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় পরিকল্পনায়। হাতে আরও কয়েকদিন থাকলে ঘুরে নেওয়া যেতে পারে মুন্সিয়ারি, বিনসর, মুক্তেশ্বর, জগেশ্বর। কৌশানি থেকে বিনসর ৬২ কিলোমিটার। এখানে গণনাথ মন্দির, কসর দেবী মন্দির, বিনেশ্বর মহাদেব মন্দির ছাড়াও আছে জঙ্গল। অসম্ভব সুন্দর জায়গা বিনসর।
কৌশানি থেকে মুন্সিয়ারির দূরত্ব প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার। মুন্সিয়ারিও অসাধারণ সুন্দর জায়গা। এখানকার আকর্ষণ বিরথি ফলস, পঞ্চাচুলি পিকস, মহেশ্বরী কুণ্ড, খলিয়া টপ, নন্দা দেবী মন্দির, কলামুনি মন্দির, ঠামরি কুণ্ড। অসম্ভব সুন্দর জায়গা মুন্সিয়ারি। মুক্তেশ্বর যেতে চাইলে নৈনিতাল থেকে যাওয়া সহজ। নৈনিতাল থেকে মুক্তেশ্বরের দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। এই পাহাড়ি অঞ্চল মূলত ট্রেকিং বা ক্যাম্পিংয়ের জন্য বিখ্যাত। তবে গাড়ি নিয়েও ঘুরে আসা যায়।
আলমোড়া থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে জগেশ্বর ধাম। এখানকার আকর্ষণের মধ্যে আছে জগেশ্বর মহাদেব মন্দির, দণ্ডেশ্বর মন্দির, জগেশ্বর মিউজিয়াম, ঝঙ্কার সইম মহাদেব মন্দির, লাকুলিশা, মিরতলা আশ্রম, মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দির, বৃদ্ধ জগেশ্বর মন্দির।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া স্টেশন থেকে বাঘ এক্সপ্রেস, যা রোজ রাতে ছাড়ে, তাতে কাঠগোদাম বা সাপ্তাহিক লালকুঁয়া এক্সপ্রেসে লালকুঁয়া স্টেশন যাওয়া যেতে পারে। তবে এই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর হবে না। তার চেয়ে দিল্লি চলে গিয়ে নয়াদিল্লি স্টেশন থেকে শতাব্দী এক্সপ্রেসে কাঠগোদাম যাওয়া অনেক সহজ। ফেরার সময়ও কাঠগোদাম থেকে দিল্লি হয়ে ফেরা ভাল।
কোথায় থাকবেন?
নৈনিতাল, কৌশানি, বিনসর, মুন্সিয়ারি, আলমোড়া, মুক্তেশ্বর, জগেশ্বর, সব জায়গাতেই বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। ভাড়া মানের ওপর নির্ভর করছে। হোটেল বুক করে যেতে পারেন অথবা গিয়েও দেখে নিতে পারেন। পাহাড়ে গাড়ি ভাড়া একটু বেশি হয়। কাঠগোদাম স্টেশনের বাইরে অনেক গাড়ি থাকে। দরদাম করে যতদিন থাকবেন ততদিনের জন্য বুক করে নেওয়াই ভাল।