এক্সপ্লোর

নৌবিদ্রোহ এবং ব্রিটিশদের ভারতত্যাগ; ইতিহাসের এক ভিন্ন অধ্যায়

Naval Indian Mutiny: ১৯৪৫ সাল। অশান্ত হয়ে উঠল নৌবাহিনীও, শিকলভাঙ্গার সেই লড়াই ব্রিটিশদের চিন্তা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৪৬ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরণ হল সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের।

কলকাতা: 'নৌ বিদ্রোহ', ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যা চিরস্মরণীয়। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে নিজেদের শৃঙ্খলমুক্ত করতে তখন শেষ লড়াই চলছে ভারতে। বিদ্রোহের লেলিহান শিখা তখন গগনচুম্বী। ১৯৪৫ সাল। অশান্ত হয়ে উঠল নৌবাহিনীও, শিকলভাঙ্গার সেই লড়াই ব্রিটিশদের চিন্তা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৪৬ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরণ হল সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) এর ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে তখন সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন ব্রিটিশ শাসকরা। তবে এই ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিলেন এক বাঙালি যুবক। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস। তাঁর ক্যারিশ্মাটিক চরিত্র, লড়াকু ভাষণ, মুষ্টিবদ্ধ সেই হাতই হয় উঠেছিল গোটা ভারতের শক্তি। 

লড়াই সহজ ছিল না নেতাজিরও। ১৯৩৯তে মহাত্মা গান্ধীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন 'বাংলার ছেলে'। জয়ও পেয়েছিলেন। কিন্তু তীক্ষ্ণ মেধায় বুঝতে পারেন কংগ্রেসের এক নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের ছক। ১৯৪১ সালে গৃহবন্দী থাকাকালীনই ছদ্মবেশে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতার বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথমে আফগানিস্তান-সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানিতে যান বঙ্গতনয় সুভাষ। যা পলায়ন ইতিহাসে আজও স্মরণীয়। জার্মানিতে তখন হিটলার-রাজ। কিন্তু ব্রিটিশ উচ্ছেদ যার রক্তে তাঁকে আটকায় কে! সুভাষ-হিটলার সাক্ষাৎ হল জার্মানিতেই। লক্ষ্য একটাই- সেনা তৈরি করা। ১৪৪৩ সালে তৈরি করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ (আইএনএ)।  ইম্ফল এবং কোহিমা এবং বর্মা হয়ে তখন ভারতের পথে এগোচ্ছে আইএনএ। কপালে ভাঁজ পড়ছিল ব্রিটিশদের। কিন্তু চরমতম শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে আশু ভবিষ্যতের কথা ভেবে নেতাজি অন্যত্র চলে গেলেও এই লড়াই ছিল বারুদের ন্যায়। যা পরবর্তীতে নৌবিদ্রোহের জন্ম দেয়। 

তাইওয়ানের কাছে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে এই খবরে তো শোরগোল দেশে। যদিও শেষ লড়াই জারি রেখেছিল ব্রিটিশরাও। কিছু অফিসারের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কিন্তু যে বারুদে আগুন জ্বলে তা নিভে যাওয়ার ছিল না। নিভতে দেয়নি নেতাজির দেশের জন্য লড়াইয়ের সেই দীপ্ত তেজ। বরং নতুন করে জেগে ওঠে নৌবাহিনী। ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার লিখেছেন, 'আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে সত্যিকারের বীরত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির মধ্যে একটি এই বিদ্রোহ, যদি অনেকাংশে ভুলে যাওয়াও হয় তা। সেই সময়ের ধর্মঘট ডাকার কৌশল, তার মাধ্যমে নতুন লড়াইয়ের সূচনা আমাদের জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা বন্ধ হলে কী ক্ষতি হতে পারে তা দেখানো হয়েছিল। আমাদের ভাই ও বোনেরা ভুলে যাবে না সেই ইতিহাস। দীর্ঘজীবী হোক সেই লড়াই। জয় হিন্দ।'

কী কারণে এমন ক্ষোভের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল? ইতিহাস জানায়, ব্রিটিশরা বেতন, ভাল খাবার, বিপুল অর্থে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নৌবাহিনীতে চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতির অধীনে নিয়োগ করে সেনাদের। কিন্তু বিনিময়ে সেনাদের দেওয়া হয় পচে যাওয়া খাবার, খারাপ কাজের পরিবেশ, ইংরেজদের কটূক্তি প্রয়োজনে চাবুকও। তাঁদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় নিজেদের ছোট্ট জগতের পরিধি ছেড়ে বহির্বিশ্বের দেখার দরজা বন্ধ। বারুদে তৈরি হয় স্ফুলিঙ্গের। যদিও তা নেভানোর জন্য নেভাল সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটিও গঠন করা হয়েছিল, যারা বিক্ষুদ্ধদের দাবি দাওয়া শুনবে। এও শোনা যায়, সেই সময় অনেককে ইন্দোনেশিয়াতেও স্থানান্তরিত করা হয়েছিল জাপানি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় ডাচদের সাহায্য করার জন্য। তবে ব্রিটিশ সেনা এবং ভারতীয় সেনাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিস্তর ফারাক রাখা হয়েছিল বলে জানা যায় তৎকালীন তথ্য থেকে। 

এবার লড়াই শুরু নৌ অভ্যন্তরে। ১৮ ফেব্রুয়ারি HMIS Talwar-এ সমস্যা দেখা যায়। এটি দেখভাল করা কমান্ডিং অফিসারকে অত্যন্ত কদর্য ভাষায় আক্রমণ করে ইংরেজরা। ১৯৪৫ এর ১ ডিসেম্বর এইচএমআইএস তালওয়ার এবং অন্যান্য নৌ জাহাজ প্রদর্শনের কথা থাকলেও ইংরেজরা দেখতে পায় জাহাজের বদলে রয়েছে- 'ভারত ছাড়ো' স্লোগান। পরবর্তীতে জানা যায় সেই লেখা ছিল বলাই চাঁদ দত্তের হাতের কাজ। যিনি নৌবাহিনীতে একজন সিনিয়র টেলিগ্রাফিস্ট ছিলেন। এছাড়াও নৌবিদ্রোহের ওপর প্রমোদ কপুরের লেখা বই যেটি সম্প্রতি প্রকাশিত হবে তা থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ এমনই কিছু বিষয় জানা যায়। সাংবাদিক কুসুম নায়ারের লেখা বই- In Defense of the Irrational Peasant: Indian Agriculture After the Green Revolution থেকে জানা যায় কীভাবে ডালে কাঁকড় মিশিয়ে তা খাওয়ার অযোগ্য করে তুলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন নৌবাহিনীতে জ্বালানো হয়েছিল। 

অসন্তোষের তীব্রতা এতটাই ছিল যে তিন দিনেরও কম সময়ের মধ্যে ৭৫টি জাহাজ এবং ২০ হাজার নাবিক, যাঁদের বয়স ছিল ২৬ বছরের কম, তারা অংশ নেই এই বিদ্রোহে। সেই তেজ, সেই রেশ জমা পড়েছিল ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির কাছে। ব্রিটিশরা বুঝেছিলেন এবার লড়াইয়ের ময়দান কঠিন। একপেশে নয়। যদিও অ্যাডমিরাল জন হেনরি গডফ্রে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি নৌবাহিনীকে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেখতে প্রস্তুত কিন্তু তিনি বিদ্রোহ সহ্য করবেন না। কিন্তু বারুদের আগুন বেড়েই চলে। সেনাদের খাবার, অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে থাকে সাধারণ মানুষও। ধর্মঘট সারা দেশের নৌ-প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। করাচিতে যুদ্ধের পর এইচএমআইএস হিন্দুস্তান পরাজিত হয়। তৎকালীন বোম্বে জুড়ে তখন শিরোনাম-  ‘Bombay in Revolt: City a Battlefield’ (দ্য হিন্দুস্থান টাইমস); ‘Nightmare Grips Bombay’ (Dawn—then published in Bombay); and ‘Rioters Machine-Gunned in Bombay (দ্য স্টেটসম্যান )। 

মৃত্যুর নিরিখে প্রায় ৪০০ জন প্রাণ হারান। কিন্তু এই ধর্মঘট শেষ হয় আকস্মিকভাবেই। আসাফ আলী ব্যতীত, কোনও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, যিনি এই লড়াই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এমনকী মহাত্মা গান্ধীও নৌসেনাদের অস্ত্রপ্রত্যাহারের কথা জানিয়েছিলেন। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের নীতিগত অবস্থান নিয়ে তখনও সমালোচনা হয়েছিল। যদিও শোনা যায়, জওহরলাল নেহেরু নাবিকদের কাছে গিয়ে তাঁদের সমর্থন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কংগ্রেসের কমিটির আলোচনার পর নেহেরুকে সে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। প্রমোদ কপুর 1946—The Last War of Independence: Royal Indian Navy Mutiny-এ বিস্তারিত লিখেছেন এ বিষয়ে। সেখানে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে  রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথাও তুলে ধরা হয়। 

নৌবাহিনীর এই বিদ্রোহ কেবল লড়াইয়ের গল্প নয়। নানা প্রেক্ষাপট লুকিয়ে রয়েছে সেখানে। রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কংগ্রেস, মুসলীগ লিগ এবং কমিউনিস্ট ভাবধারার ইতিহাস। অনেকেই মনে করেন কমিউনিস্টদের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া এ লড়াই সম্ভব হত না। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় জায়গাই করতে পারেনি এই মতাদর্শ। অনেকে বলেছেন কমিউনিস্টরা ছিলেন বলেই হিন্দু-মুসলিমরা একজোট হয়ে লড়াই করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পক্ষে ছিল না। বরং ভারত গড়ার লক্ষ্য ছিল এটাই এক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে জন্ম দেওয়ার। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের শেষ প্রান্তে যখন চলে আসে সেই ধর্ম, সেই ধর্মীয় ভেদাভেদ রাজনীতি। লড়াই সেখানে যেন ইতিহাস থেকে গল্প হয়ে ওঠে। সে তুচ্ছতা মুছে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের নেপথ্য লড়াই দীর্ঘজীবী করে তোলাই পাথেয় হোক। 

(ডিসক্লেমার : এই প্রতিবেদনের মতামত ব্লগার বিনয় লালের নিজস্ব। এটি এবিপি লাইভের মতামত নয়)

আরও দেখুন
Advertisement
Advertisement
Advertisement

সেরা শিরোনাম

West Bengal Weather : কলকাতার দরজায় শীতের কড়া নাড়া, ২০ নিচে নামল পারদ, আজ কত ?
কলকাতার দরজায় শীতের কড়া নাড়া, ২০ নিচে নামল পারদ, আজ কত ?
Kasba shootout: মাত্র ১০ হাজার টাকাতেই কাউন্সিলরকে খুন করতে এসেছিল যুবক? ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কে এই ইকবাল?
মাত্র ১০ হাজার টাকাতেই কাউন্সিলরকে খুন করতে এসেছিল যুবক? ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কে এই ইকবাল?
Arjun Singh : অর্জুন সিংহের শরীরে সত্যি প্রাণঘাতী রাসায়নিক স্প্রে? কেন সকাল সকাল হাসপাতালে ?
অর্জুন সিংহের শরীরে সত্যি প্রাণঘাতী রাসায়নিক স্প্রে? কেন সকাল সকাল হাসপাতালে ?
Salman Khan: তাঁকে নিয়ে মিথ্যাচার! প্রকাশ্য মঞ্চে কোটিপতি ব্যবসায়ীকে সমঝে দিলেন সলমন
তাঁকে নিয়ে মিথ্যাচার! প্রকাশ্য মঞ্চে কোটিপতি ব্যবসায়ীকে সমঝে দিলেন সলমন
Advertisement
ABP Premium

ভিডিও

TMC News: 'এর সঙ্গে রাজনীতির কোন যোগ নেই', কসবার ঘটনায় দাবি তৃণমূল কাউন্সিলারের। ABP Ananda LiveLottery Scam : কোন প্রভাবশালীরা লটারীচক্রে জড়িত? কাদের কালো টাকা সাদা হয়েছে? উঠছে প্রশ্নTMC News: ভাটপাড়ায় তৃণমূল নেতার মৃত্যু, ধৃত আরও ১। ABP Ananda LiveKolkata News: কসবায় কাউন্সিলারের উপর হামলা, প্রশ্নের মুখে সাধারণের নিরাপত্তা। ABP Ananda Live

ফটো গ্যালারি

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
West Bengal Weather : কলকাতার দরজায় শীতের কড়া নাড়া, ২০ নিচে নামল পারদ, আজ কত ?
কলকাতার দরজায় শীতের কড়া নাড়া, ২০ নিচে নামল পারদ, আজ কত ?
Kasba shootout: মাত্র ১০ হাজার টাকাতেই কাউন্সিলরকে খুন করতে এসেছিল যুবক? ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কে এই ইকবাল?
মাত্র ১০ হাজার টাকাতেই কাউন্সিলরকে খুন করতে এসেছিল যুবক? ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কে এই ইকবাল?
Arjun Singh : অর্জুন সিংহের শরীরে সত্যি প্রাণঘাতী রাসায়নিক স্প্রে? কেন সকাল সকাল হাসপাতালে ?
অর্জুন সিংহের শরীরে সত্যি প্রাণঘাতী রাসায়নিক স্প্রে? কেন সকাল সকাল হাসপাতালে ?
Salman Khan: তাঁকে নিয়ে মিথ্যাচার! প্রকাশ্য মঞ্চে কোটিপতি ব্যবসায়ীকে সমঝে দিলেন সলমন
তাঁকে নিয়ে মিথ্যাচার! প্রকাশ্য মঞ্চে কোটিপতি ব্যবসায়ীকে সমঝে দিলেন সলমন
Cristiano Ronaldo: বয়স তো সংখ্যামাত্র, বাইসাইকেল কিকে দুরন্ত গোল ৩৯-র রোনাল্ডোর, নেশনশ লিগের শেষ আটে পর্তুগাল
বয়স তো সংখ্যামাত্র, বাইসাইকেল কিকে দুরন্ত গোল ৩৯-র রোনাল্ডোর, নেশনশ লিগের শেষ আটে পর্তুগাল
Gold Silver Price: সপ্তাহান্তে ফের সস্তা হল সোনা, বিয়ের গয়না গড়ালে আজ কমে পাবেন ?
সপ্তাহান্তে ফের সস্তা হল সোনা, বিয়ের গয়না গড়ালে আজ কমে পাবেন ?
Petrol Price: ৫ শহরে আজ ১০০-র নিচেই পেট্রোলের দাম, তেল ভরাতে খরচ কি কমবে ?
৫ শহরে আজ ১০০-র নিচেই পেট্রোলের দাম, তেল ভরাতে খরচ কি কমবে ?
Nimtala Fire: নিমতলা ঘাটের কাছে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভস্মীভূত একাধিক কাঠের গোলা
নিমতলা ঘাটের কাছে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভস্মীভূত একাধিক কাঠের গোলা
Embed widget