টানা বৃষ্টিতে জলের তলায় রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা, নামল নৌকা, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার
কলকাতা: নদীর বদলে রাস্তায় নামল নৌকা! ক’দনের টানা বৃষ্টিতে জলের তলায় পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা চন্দ্রকোণা, ঘাটাল ও ক্ষীরপাইয়ের। হু হু করে ঢুকছে শিলাবতী নদীর জল। এই পরিস্থিতিতে যাতায়াতের জন্য নামানো হয়েছে নৌকা! জলমগ্ন ডেবরা, সবং, পিংলাও। মুকুটমণিপুর জলাধার থেকে জল ছাড়ায় শিলাবতী ও কংসাবতী নদীর জলস্তর বেড়েছে। ঘাটাল-চন্দ্রকোণা রোডের ওপর দিয়ে বইছে নদীর জল। চন্দ্রকোণার মনোহরপুরে শিলাবতী নদীর বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রাম। ঝাড়গ্রামে সেতুর ওপর দিয়ে বইছে ডুলুং নদীর জল। বিভিন্ন নদীর জলস্তর কিছুটা নামলেও এখনও জলের তলায় বীরভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিপর্যস্ত জনজীবন। বৃষ্টির জেরে দিনকয়েক আগে কুয়ে নদীর জলে ভেসে যায় লাভপুরের লাঘাটা সেতু। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। চারদিন পর, সোমবার থেকে ফের এই সেতুতে যান চলাচল শুরু হয়েছে। লাঘাটা সেতুর আশপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম। এই সেতু দিয়েই বীরভূমের কীর্ণাহার থেকে পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া পর্যন্ত সড়কপথে যোগাযোগ। লাভপুর থেকে কলকাতাগামী বাসও এই সেতু দিয়ে যাতায়াত করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বেশি বৃষ্টি হলেই প্রতিবছর ভেসে যায় লাঘাটা সেতু। সমস্যায় পড়েন আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। এই পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাশের একটি রেল সেতু দিয়ে চলে যাতায়াত। অভিযোগ, লাঘাটা সেতু ভেসে যাওয়ায় কুয়ে নদীর জলে প্রতিবছর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এবছর ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। লাভপুরের শীতলগ্রামে তলিয়ে যাওয়া এক মহিলার দেহ সোমবার ৩ কিলোমিটার দূরে বলাইচণ্ডীপুর থেকে উদ্ধার হয়। তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের আশ্বাস, দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে। এই পরিস্থিতি যাতায়াতের জন্য নামানো হয়েছে নৌকা। মাথা পিছু ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা। প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের। এদিকে, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় খয়রাশোলের পাঁচরার কাছে ভেঙে যাওয়া ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক মেরামতির কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। শুরু হয়েছে যান চলাচল। টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সোনামুখী থেকে দুর্গাপুর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বন্ধ গাড়ি চলাচল। টানা বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে শালী নদী। হু হু করে ঢুকছে জল। জলের তলায় চলে গিয়েছে বিশ্বডাঙা, মহেশপুর-সহ বিভিন্ন গ্রাম। ফুঁসছে গন্ধেশ্বরী নদীও! জলের তোড়ে সেতুর একাংশ কার্যত ভেঙে গর্ত তৈরি হয়েছে। এই ভাবে টানা বৃষ্টি চললে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা স্থানীয় বাসিন্দাদের। কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টির জের। পশ্চিম বর্ধমানের জামুড়িয়ায় ফুলে উঠেছে অজয় নদ। সোমবার দরবারডাঙা এলাকায় জলের তোড়ে ভেসে যায় তিনটি অস্থায়ী সেতু। রাস্তার ওপর দিয়ে বইছে অজয়ের জল। তিন তিনটি সেতু ভেসে যাওয়ায় জামুড়িয়া-বীরভূমের মধ্যে যান চলাচল বন্ধ। সড়কপথে বীরভূমের সঙ্গে জামুড়িয়ার দরবারডাঙা, বাদডিহা, সিদ্ধপুর, বীর কুলটি, লালবাজার-সহ ৭টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অজয় পারাপারের জন্য গ্রামবাসীদের ভরসা একটিমাত্র নৌকা। অন্যদিকে, প্লাবিত আসানসোল, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া ও কুলটির বেশ কিছু এলাকাও। আসানসোল পুরসভার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের ২৫টি বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে। প্রবল বৃষ্টির জেরে মাটি আলগা হয়ে ধস নেমেছে জামুড়িয়ার কেন্দা এলাকায়। টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত আসানসোল, জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ ও কুলটির বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন। যদিও, রাজ্যে এখনও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী। আজ নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, রাজ্যে এখনও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। রাজ্যের বিভিন্ন নদীর জলের স্তর নিচুতেই আছে। জলাধার থেকে জল ছাড়ার জন্য কিছু কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সে সব জায়গায় ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে সরকার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এদিন বিভিন্ন জেলার জেলাশাসক ও সেচ দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রে খবর, নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর থেকে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে ত্রিপল, খাবার, ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী। সেচমন্ত্রী জানিয়েছেন, গতবারের তুলনায় এই সময় এবার ৫৭৯ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ২ দিনের মধ্যে বৃষ্টি না কমলে চিন্তার বিষয়। এই সময় প্রতিবেশী রাজ্য থেকেও জল ঢোকে রাজ্য। ওই সব রাজ্যকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাড়তি জল নেওয়া সম্ভব নয়। সেচ দফতরের পাশাপাশি, সতর্ক রয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও। যে সমস্ত জেলা প্লাবিত হয়েছে, সেই জেলাগুলিতে তৈরি করা হয়েছে ৬ সদস্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল। প্রয়োজনে তাঁদের দুর্গত এলাকায় পাঠানো হবে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানিয়েছেন, যে সব জেলা জলমগ্ন হয়েছে, সেখানকার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের জেলা না ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, প্রয়োজনে ওই সমস্ত জেলার স্বাস্থ্যকর্মীদের ছুটি বাতিল হতে পারে। পাশাপাশি, নবান্নে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। সেখান থেকেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জেলা প্রশাসনগুলির সঙ্গে।