US-China Trade War: শুল্কযুদ্ধে সাময়িক বিরতি, একধাক্কায় কমল Tariff, আমেরিকা-চিনের লড়াইয়ে উলুখাগড়া কারা?
Tariff War: আমেরিকার মসনদে প্রত্যাবর্তনের পরই শুল্কযুদ্ধের সূচনা করেন দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নয়াদিল্লি: রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, প্রাণ যায় উলুখাগড়ার। সমাজ জীবন বা রাজনীতিতেই নয় শুধু, বিশ্ব অর্থনীতির উপরও খাটে এই প্রবাদ। আমেরিকা বনাম চিনের সাম্প্রতিক শুল্কযুদ্ধই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। শুল্ক নিয়ে টানাপোড়েনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় বিশ্ব অর্থনীতিতে। রক্তক্ষরণ শুরু হয় তাবড় দেশের শেয়ার বাজারে। তাই আমেরিকা এবং চিন সাময়িক বিরতি নেওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে সকলেই। ছন্দে ফিরছে শেয়ার বাজারও। কিন্তু তাই বলে কি যুদ্ধ শেষ? নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই বলেই মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এটা সাময়িক যুদ্ধবিরতি। আরও বড় আঘাত নেমে এলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। (US-China Trade War)
আমেরিকার মসনদে প্রত্যাবর্তনের পরই শুল্কযুদ্ধের সূচনা করেন দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমরিকার পণ্যের উপর চাপানো শুল্কের পাল্টা আরও চড়া শুল্কের ঘোষণা করেন তিনি। কানাডা, ভারতের মতো তথাকথিত ‘বন্ধু দেশ’ও রক্ষা পায়নি ট্রাম্পের শুল্ক খাঁড়া থেকে। এর ফলে ভারত, চিন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির শেয়ারবাজারে ধস নামে। কিন্তু এই শুল্কের পাল্টা শুল্ক নিয়ে কার্যত সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয় আমেরিকা এবং চিন। ট্রাম্প এক ঘোষণা করছেন তো, শি চিনপিং সরকার পাল্টা ঘোষণা করছে, এমনটা নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি এমন হয় যে একটা সময় চিনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বসান ট্রাম্প। পাল্টা আমেরিকার পণ্যের উপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক বসায় আমেরিকা। (Tariff War)
চিন পৃথিবীর বৃহত্তম পণ্য উৎপাদনকারী দেশ। আর পৃথিবীর বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ আমেরিকা। তাদের এই যুদ্ধংদেহি আচরণে রক্তক্ষরণ শুরু হয় বিশ্ব অর্থনীতিতে। আমেরিকার অন্দরেই বিরুদ্ধস্বর শোনা যেতে শুরু করে। তার জেরে গত কয়েক দিন ধরেই দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছিল। শেষ পর্যন্ত সুইৎজারল্যান্ডের জেনিভায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় দুই দেশ। আপাতত ৯০ দিন এই যুদ্ধবিরতি চলবে বলে ঠিক হয়েছে। এই ৯০ দিন চিনা পণ্যের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আদায় করবে আমেরিকা। আমেরিকার পণ্যের উপর ১০ শতাংশ শুল্ক চালু রাখবে চিন। বিশ্ব অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সরবরাহ অব্যাহত রাখতেই তার একমত হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন এবং বেজিং।
এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, চিনের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ নিয়ে দেশের অন্দরেই বিরোধিতার মুখে পড়ছিলেন ট্রাম্প। চিনা পণ্যের উপর চড়া শুল্ক বসানোয়, সেই সব পণ্য কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছিল দেশের নাগরিকদের। উৎপাদনের জন্য আমেরিকার তাবড় সংস্থা চিনের উপর নির্ভরশীল। শুল্ক নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছিল তাদের। আবার চিনে আমেরিকার তাবড় সংস্থার কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কা করছিলেন সকলে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট চিনের সঙ্গে সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু করে। চিনা ভাইস প্রিমিয়ার হি রিফেংয়ের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে তিনি নিজে জেনিভা রওনা দেন। শেষ পর্যন্ত ৯০ দিনের জন্য শুল্কের হার শিথিল করা হলেও, আমেরিকার জন্য এই পরিস্থিতি যথেষ্ট অস্বস্তিকর।
শুল্কযুদ্ধে চিন যে মাথা নোয়াবে না, ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতেও পিছপা হবে না, তা কল্পনা করতে পারেনি আমেরিকা। চিনকে জব্দ করতে গিয়ে এখন বন্ধু দেশগুলির কাছে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে আমেরিকাকে। আমেরিকার খবরদারির মোকাবিলা করার পরার পর চিনকে যদি তার ফল ভুগতে না হয়, তাহলে বাকিদের কেন হবে, এই প্রশ্ন সামাল দিতে হতে পারে ওয়াশিংটনকে। পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়নি এখনও পর্যন্ত, যার মধ্য়ে অন্যতম হল চিনের মুদ্রা বিনিময়ের হার। এই শুল্কযুদ্ধের ফলে চিন আন্তর্জাতিক বাজারে সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে গেল বলেও মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, নিজেদের নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক সহযোগী হিসেবে তুলে ধরতে সফল হয়েছে চিন। আমেরিকাও যে তাদের চটিয়ে লাভবান হয়নি, তা দেখিয়ে দিয়েছে। আমেরিকা বিষয়টি যে খোলা মনে মেনে নেবে না, সে ব্যাপারেও একমত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
তাই আপাতত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও, এখনই যুদ্ধের সমাপ্তি নয় বলে মনে করা হচ্ছে। চিনের প্রেসিডেন্ট চিনপিংয়ের বক্তব্যেও বিষয়টি পরিষ্কার। তাঁর সাফ বক্তব্য, “শুল্কযুদ্ধে কেউ জয়ী হয় না। গুন্ডামি করলে, কর্তৃত্ব স্থাপন করতে গেলে নিজেকেই একঘরে হতে হয়।” আবার এই যুদ্ধবিরতির ফলে ভারতের মতো দেশগুলিকেও বিপাকে পড়তে হতে পারে। চিনা পণ্যের উপর থেকে আমেরিকা চড়া শুল্ক তুলে নেওয়ায়, আমেরিকায় চিনা পণ্যের চাহিদা আরও বাড়বে। এর ফলে ভারতীয় পণ্যকে কড়া প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিবিদ শি হেলিং বলেন, “তাবড় সংস্থাগুলিকে অতিরিক্ত ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে চিনকে। এটা ন্যায্য প্রক্রিয়া নয়। প্রতিযোগীদের জব্দ করতেই এই নীতি।আমেরিকার উচিত বাজেট ঘাটতি এবং দেনা কমিয়ে আনা। ৯০ দিন পার হয়ে গেলেও, অন্য সমস্যাগুলি কিন্তু রয়ে যাবে।” Ningbo Foreign Trade Company-র জেনারেল ম্যানেজার মিস বাও The Guardian-কে বলেন, “৯০ দিন পর কী হবে জানি না। ৯০ দিনের মধ্যে যত সম্বব পণ্য রফতানি করা যায়, সেই চেষ্টা করছেন সকলে।” চিনা সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, আমেরিকার পরিবর্তে এখন থেকেই বিকল্প বাজারের সন্ধান করছে দেশের তাবড় সংস্থা। বিশেষ করে এশিয়ার বাজারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ স্টিভেন জে ডেভিস বলেন, “আমেরিকার বাণিজ্য নীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ভবিষ্যতে কি এই নীতিই চালু থাকবে, প্রশ্ন তুলছেন সহযোগীরা। বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।” আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একসময়কার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অ্যালেক্স জ্যাকোয়েস বলেন, “শুধুমাত্র চিন থেকে আমদানিকৃত পণ্যকেই যদি ধরা হয়, তাহলে হাতে সময় কম। আমার মনে হয়, অনিশ্চয়তা কিন্তু রয়েই গেল। কী শর্তে ট্রাম্প চিনের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন ট্রাম্প, তা আমার জানি না।”
এই অনিশ্চয়তার মধ্যে এখনই কোনও বড় সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ আমেরিকার তাবড় সংস্থা। এমনকি নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেকে। শিকাগোর ফেডারাল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট অস্টান ডি গুলসবি জানিয়েছেন, কী হবে, তা কেউ বুঝে উঠতে পারছেন নায এই অনিশ্চয়তার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। বাণিজ্যনীতিতে অহরহ এমন পরিবর্তন ঘটালে দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কের পক্ষেও সুদের হার নির্ধারণে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই ৯০ দিন পর কী সিদ্ধান্ত হয়, এখন সেদিকেই তাকিয়ে সকলে।






















