প্রথম জীবনে রোগা বলে বাদ পড়েছিল ‘নয়া মিছিল’ থেকে। বুকের মধ্যে সেই তুষের আগুন নিভতে দেয়নি। তাই পৃথুলা বলে যখন তপন সিংহ ‘আদমি ঔর আউরত’ থেকে বাদ দেবেন বলে ঠিক করলেন, মহুয়া মাত্র তিন সপ্তাহ সময় চেয়েছিল। যথাসময়ে যখন তপন সিনহা তাকে দেখে, এক রকম অবাক হতেও ভুলে গিয়েছিলেন। দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করে বৃত্ত যখন সম্পূর্ণ করল, তত দিনে শুধুমাত্র চন্দ্রাভ সে মুখের স্মৃতিভারটুকু রেখে পুরস্কারের পাশে ‘মরণোত্তর’ কথাটুকু বসিয়ে দিয়ে মহুয়া চলে গেছে চিরকালের মতো। সব মায়ার ও পারে। তিলক ছিল ছেলেবেলার বন্ধু। ওদের প্রেম কৈশোরের। ভালবাসার অভাব ছিল না। ছিল প্রাত্যহিক বোঝাপড়ার অভাব। এই জুটিটির পরম বন্ধুর সে দিনের কথা বলতে বসে আজও গলা ধরে আসে। রত্না ঘোষাল। বললেন, ‘‘মৌয়ের মনটা ছিল বিরাট। কিন্তু ...।’’ গলায় স্তব্ধতা নেমে আসে। ‘‘মদ মৌ খাবেই আর...।’’ আবারও নিশ্চুপ। আর? ‘‘আর মদ খেলেই কেমন যেন পালটে যেত। পুরুষ চাই তখন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কী যে করত, কী বলত, কোথায় পৌঁছত, তার কণামাত্র মনে থাকত না। পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শিশুর মতো জিজ্ঞেস করত— ‘সত্যি মাটু আমি এরকম করেছি? কেন করলাম বল তো?’ সেই সরলতা আরোপিত নয়। কার সাধ্য তাকে অস্বীকার করে!’’ তিলককে তবে কি ধরিত্রীর মতো সহনশীল হতে হয়েছিল? সেই ধৈর্যের রাশ আলগা হয়েই কি দুর্ঘটনা? কীসের থেকে এই বেপরোয়া জীবনযাপন? শেকড় ছেঁড়া দোলাচল? অতি সাধারণ পরিবার থেকে হঠাৎ পাওয়া খ্যাতি, দুরন্ত আবেগ অথচ সাধারণ মেয়ের মতো স্বামী সংসারের আকাঙ্ক্ষার অনিয়ন্ত্রিত আন্দোলনে পায়ের তলার জমিটা কি বড় নরম হয়ে গেছিল? নাকি শৈশবে বিকৃতি আর লালসার শিকার হওয়া সংবেদনশীল মনটা রক্তাক্ত হচ্ছিল বারবার? একাধিকবার মহুয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। মহুয়ার মাধুমা আর মাটু দুজনেরই চোখ সজল হয়ে এল, গলা ধরে এল এ কথা স্বীকার করে নিতে গিয়ে। এক বুক শূন্যতা থেকে সুরাসক্তি। যে আসক্তি পৃথিবীর কাউকে কোনও সুস্থ জীবন দেয়নি। গড়পড়তা মাপকাঠিতে এ চরিত্রের তল পাওয়া অসম্ভব। তা’হলে এ কি শুধুমাত্র এক শিল্পীর অনন্ত খোঁজের তাড়না? অতি তীব্র আবেগের ভার? বঞ্চিত ছেলেবেলার যন্ত্রণাবোধ? নাকি মানসিক রোগ! নাকি কোনও একটি নয়, সবই আছে একত্রে? বহমান সময় আর নদীর জল কারও জন্য অপেক্ষা করে না, করেওনি। নায়িকারা এসেছে, আসছে, আসবেও। যে দর্শককুল তাঁকে যথাসময়ে পর্দায় দেখেছিলেন তাঁদের বুকের খুব কাছটাতে ওই প্রাণেশ্বরী কেন যেন বড় আলাদা করে নিজের জায়গাটুকু আগলে রেখেছে। এখনও, আজও। কোনও অবেলায় একলা বসে কেউ বুঝিবা ভাবেন, এই তো সেই মুখ, যাকে দেখে কেবলই মনে হয়— ওই মেয়েটির কাছে, সন্ধ্যাতারা আছে!