Israel Palestine War: রাতের অন্ধকারে গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণ, বাইডেনের সফর বাতিল করল জর্ডান, তেতে উঠছে পশ্চিম এশিয়া
Israel Palestine Conflict: ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধের মধ্যেই বুধবার পশ্চিম এশিয়া সফরে আসছেন বাইডেন।
নয়াদিল্লি: যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমনিতেই বিভাজন চোখে পড়ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। গত ২৪ ঘণ্টার ঘটনাবলী সেই ফাটল আরও চওড়া করে দিল। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে আগেই ইজরায়েলের পক্ষ নিয়েছে আমেরিকা (Israel Palestine Conflict)। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণে শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যুতে আন্তর্জাতিক সমীকরণেও রদবদল চোখে পড়ছে। কারণ ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ নিয়ে জর্ডানে আয়োজিত সম্মেলনে আলোচনায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল বাইডেনের। গভীর রাতে গাজার হাসপাতালে ওই হামলার পর, বাইডেনের সফরই বাতিল করে দিয়েছে জর্ডান। (Israel Palestine War)
ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধের মধ্যেই বুধবার পশ্চিম এশিয়া সফরে আসছেন বাইডেন। জর্ডানে আয়োজিত সম্মেলনে আরব দেশের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল তাঁর। গাজার উপর লাগাতার যেভাবে বোমা-রকেট বর্ষণ করে চলেছে ইজরায়েল, সেই নিয়ে আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালে বিস্ফোরণের পর বাইডেনের সফর বাতিল করে দিয়েছে জর্ডান।
এখনও পর্যন্ত হাসপাতালে বিস্ফোরণে ৫০০ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই মহিলা এবং শিশু। ধ্বংসস্তূপ থেকে দেহ বের করে আনার প্রক্রিয়া এখনও চলছে। বহু মানুষকে শনাক্তও করা যায়নি এখনও পর্যন্ত। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষ। কে হামলা চালিয়েছে, তা নিয়ে যদিও দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপ চলছে। রাতের অন্ধকারে ইজরায়েলি বাহিনী রকেট ছুড়েছে বলে অভিযোগ প্যালেস্তাইনের। ইজরায়েলের দাবি, ভুল করে হামাস অথবা সশস্ত্র সংগঠন প্যালেস্তাইন ইসলামিক জিহাদ সংগঠনই হাসপাতালে রকেট ছুড়েছে।
কিন্তু এই ঘটনায় ইজরায়েলের দিকেই আঙুল উঠছে মূলত। কারণ গত সপ্তাহেই গাজার বাসিন্দাদের ভিটেমাটি খালি করে দিতে হুঁশিয়ারি দেয় তারা। গাজায় অবস্থিত পাঁচটি হাসপাতালও খালি করে দিতে বলা হয়। কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, সব গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয় ইজরায়েল। অথচ আন্তর্জাতিক আইন বলছে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও হাসপাতালে হামলা চালানো যায় না।
Gaza's Baptist hospital, built in 1904 and managed by the Anglican Episcopal Church, one of the region's oldest, was tragically bombed by occupying forces last night, causing around 500 casualties primarily children. This illustrates the occupation's destruction of history. #Gaza pic.twitter.com/rBB4FcXaOM
— Ahmed #Gaza (@madhoun95) October 18, 2023
তাই এই মুহূর্তে কাঠগড়ায় ইজরায়েল। বিশ্বের তাবড় দেশ এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। তারই দরুণ জর্ডান বাইডেনের সফর বাতিল করল। এমনিতে ইজরায়েলের সঙ্গে জর্ডানের সংঘাতের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। কারণ জর্ডানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে রাখার পাশাপাশি, আঞ্চলিক রাজনীতিতেও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েক দশক ধরে যুদ্ধও করেছে দুই দেশ। ১৯৯৪ সালে তাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। কিন্তু প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে সম্পর্ক তিক্তই থেকেছে। সেই ইজরায়েলকে আমেরিকা সমর্থন জানানোর পরও বাইডেনের সফর ঘিরে প্রস্ততি চলছিল জর্ডানে। কিন্তু মঙ্গলবার গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণের পর বাতিল করা হল বাইডেনের সফর।
১৯৪৮ সালে ৭ লক্ষের বেশি প্যালেস্তিনীয়কে নিজভূম থেকে উৎখাত হতে হয়। ইহুদি সশস্ত্রবাহিনী এবং ইজরায়েলি সেনা মিলে কার্যতই ঘাড় ধরে প্যালেস্তিনীয়দের ভিটেমাটি থেকে বের করে দেয়। প্যালেস্তিনীয়দের কাছে সেই ঘটনা 'নকবা' নামে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে, আরবি ভাষায় যার অর্থ বিপর্যয়। ওই বছরই ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে রাষ্ট্রপুঞ্জ প্যালেস্তাইনের বিভাজন ঘটায়। তাতে জর্ডান-সহ আরবদেশ সংঘবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসে। যুদ্ধের পর পূর্ব জেরুসালেম এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দখল ছিল জর্ডানের হাতে।
১৯৬৭ সালে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছ'দিনের যুদ্ধেও যোগদান করে জর্ডান। সেবার যুদ্ধে জয়ী হয় ইজরায়েল। তাতে পূর্ব জেরুসালেম এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, দুই এলাকাই জর্ডানের হাতছাড়া হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সেই সময়ই ইজরায়েল এবং জর্ডান পিছনের দরজা দিয়ে কথাবার্তা চালু করে বলে শোনা যায়। ১৯৯৩ সালে সাক্ষরিত ওসলো চুক্তি অনুযায়ী, পৃথক ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন ওঠে। তার পর ১৯৯৪ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই সময় মিশরের পর জর্ডানই দ্বিতীয় আরব দেশ ছিল, যারা ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে।
Additional walkthrough of central courtyard and parking lot area of the Ahli Hospital in Gaza, after the explosion last night. pic.twitter.com/r37HAuE586
— OSINTtechnical (@Osinttechnical) October 18, 2023
আমেরিকার হোয়াইট হাউসে শত্রুতার অভসান এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বজায় রাখা নিয়েও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় ইজরায়েল এবং জর্ডান। এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতাও গড়ে ওঠে। জর্ডান থেকে বিনা শুল্কে পণ্য রফতানি শুরু হয় আমেরিকায়। পরবর্তী কালে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয় জর্ডান এবং আমেরিকার মধ্যে। আমেরিকার সঙ্গে জলপথ ভাগ করে নিতে সম্মত হয় জর্ডান। ২০১৪ সালে ইজরায়েল থেকে উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্য়াস, পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য জর্ডানের উপর দিয়ে আমেরিকায় পাঠানোর চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।
কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও প্যালেস্তাইন গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে তিনটি দেশের গলাতেই। তার মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যায়। ১৯৯৭ সালে ইজরায়েলি স্কুলছাত্রীদের উপর গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে জর্ডানের সেনার বিরুদ্ধে। ওই বছর ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের এজেন্টরা ধরা পড়েন আম্মানে। তাঁরা হামাস রাজনীতিক খালেদ মাশালকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মাশালকে যে বিষ খাইয়ে হত্যার ছক হয়েছিল, তার অ্যান্টিডোট (বিষক্রিয়া প্রতিরোধের ওষুধ) তাদের হাতে তুলে দিতে হবে বলে বেঞ্জামিন নেতানইয়াহুর সামনে দাবি তোলে জর্ডান। তাতে রাজি হয়নি ইজরায়েল। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। তার পর অ্যান্টিডোট জর্ডানের হাতে তুলে দেয় ইজরায়েল।
২০১৭ সালে ১৭ বছর বয়সি এক প্যালেস্তিনীয় কিশোর জর্ডানে অবস্থিত ইজরায়েলি দূতবাসের নিরাপত্তারক্ষীর শরীরে কোপ বসায়। তাতে ওই নিরাপত্তারক্ষী গুলি চালান। গুলিবিদ্ধ হয় ওই কিশোর। মারা যান অন্য এক প্যালিস্তিনীয় নাগরিকও। সেই ঘটনার পর দীর্ঘ ছ'মাস জর্ডানে ইজরায়েলের দূতাবাসটি বন্ধ ছিল। ওই নিরাপত্তারক্ষীর ভূয়সী প্রশংসা করেন নেতানইয়াহু। তাঁকে ইজরায়েলে ডেকে নেন।
The picture in daylight of the Gaza hospital. As I said before, whoever committed this crime should be held responsible. But some things start to look very suspicious.
— Roman Sheremeta 🇺🇦 (@rshereme) October 18, 2023
1/n pic.twitter.com/XnQSf3GjNn
২০১৯ সালের শেষ দিকে জর্ডান এবং ইজরায়েলের সম্পর্ক আরও তলানিতে এসে ঠেকে। প্রকাশ্যে সে কথা স্বীকারও করে নেন জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আব্দুল্লা। তার পর দুই দেশের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়। গত বছরই প্রথম বার কোনও ইজরায়েলি প্রেসিডেন্ট জর্ডানে পা রাখেন। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে ফের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসতে শুরু করে। জর্ডানের রাজ পরিবার হাশেমিতরা সেই দেশে ১৯২১ সাল থেকে সিংহাসনে রয়েছে। গত ১০০ বছর ধরে জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদের অভিভাভকও তারাই।
১৯২৪ সালে ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণাধীন প্যালেস্তাইনের সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল হাশেমিত পরিবারকেই আল-আকসা মসজিদের অভিভাবক হিসেবে বেছে নেয়। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে আল-আকসা অন্যতম পবিত্র স্থান এবং ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। গত ১০০ বছরে একাধিক বার আল-আকসা মসজিদের সংস্কার করেছে জর্ডানের রাজ পরিবার।
ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে জর্ডানের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নেই। কারণ ইজরায়েলের সঙ্গে জলচুক্তি ভেঙে বেরনো সম্ভব নয় জর্ডানের পক্ষে। অর্থনৈতিক ভাবেও ইজরায়েল এবং আমেরিকার উপর নির্ভরশীল তারা। বিশেষ করে অতিমারি পরবর্তী কালে পর্যটন শিল্প জোর ধাক্কা খেয়েছে যেখানে। তাই যুদ্ধ চলতে থাকলেও ক্ষতি জর্ডানের।
কিন্তু মঙ্গলবার গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণের পর নিন্দায় সরব হয়েছে জর্ডান। প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধান না হলে, এই মানবিক সঙ্কট কাটবে না বলে মন্তব্য করেছে তারা। এমনিতেই প্যালেস্তাইন, সিরিয়া, ইরাক থেকে প্রচুর শরণার্থী জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছেন। তারই মধ্যে নতুন করে শরণার্থীরা ঢুকতে শুরু করেছেন। তাই প্যালেস্তিনীয়রা ভিটেমাটি ছাড়া হোন, তাও চায় না জর্ডান।