করোনাভাইরাস নিয়ে চাপ বাড়ানো আমেরিকার সঙ্গে সখ্যে খুশি নয়, তাই ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মেজাজ চিনের
পাকিস্তানের পর নেপালকে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়ে সীমান্ত বিতর্ক উস্কে দেওয়ার কৌশলও নিয়েছেন জিনপিংরা
নয়াদিল্লি: এতদিন যেখানে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতীয় ও চিনা সেনার ছোটখাট সংঘাত বাঁধছিল, সেখানেই এবার চিনা হামলায় মৃত্যু হয়েছে ভারতীয় সেনার এক কর্নেল ও দুই জওয়ানের।
কিন্তু কেন ভারতের বিরুদ্ধে হঠাৎ আগ্রাসন বাড়াচ্ছে চিন? কেন, ৩ হাজার ৪৮৮ কিলোমিটার সীমান্তের একাধিক জায়গায় ক্রমশ আক্রামণাত্মক মেজাজ দেখাচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মি?
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাড়তি বন্ধুত্বই না পসন্দ চিনের! আন্তর্জাতিক স্তরে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও তাইওয়ানের সঙ্গে ভারতের বাড়তি বন্ধুত্বও মাথাব্যাথার কারণ চিনাদের কাছে।
করোনা আবহে এদেশে চিনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ভারত। সেটাও হজম করতে হয়েছে চিনকে।
সম্প্রতি ভারতকে জি-৭ গোষ্ঠীতে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত বলে মন্তব্য করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যা ভালভাবে নেয়নি চিন। সরাসরি কোনও প্রতিক্রিয়া না দিলেও চিনের সরকারি গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে যার কড়া সমালোচনা করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইসব কারণেই পাকিস্তানের পর কখনও নেপালকে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়ে সীমান্ত বিতর্ক উস্কে দেওয়া আবার কখনও লাদাখ থেকে সিকিম---প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনা তৈরি করে নয়াদিল্লিকে বার্তা দিতে চাইছে বেজিং।
প্রাক্তন সেনাকর্তাদের মতে, ভারতকে কৌশলগত বার্তা দিতে চাইছে চিন। তাই ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আরেকাংশের মতে, একইসঙ্গে করোনা ভাইরাস নিয়ে চিনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া-সহ একাধিক দেশ। তা থেকে নজর ঘোরাতেই সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি করছে চিনা সেনা।
সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের সঙ্গে চিনের সীমান্ত বিরোধ শুরু হয় ২০১৭ সালে ডোকলামে, রাস্তা তৈরি নিয়ে। সীমান্তে চিনা সেনার চোখে চোখ রেখে প্রায় ২ মাসের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সেনা। শেষমেষ পিছু হঠতে হয়েছিল চিনকে।
ডোকলামের ওই ঘটনার পর থেকেই ভারত-চিন সীমান্তে সামরিক স্ট্র্যাটেজি ঢেলে সাজানোর ওপর জোর দেয় ভারত। ভারত-চিনের ৩,৪৮৮ কিমি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ৭৩টি স্ট্র্যাটেজিক রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই ৬১টি রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে।
বাকি ১২টি রাস্তার কাজও চলছে জোরকদমে। যাতে বাধা দিতে চেষ্টা করেছে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। যদিও দিল্লির তরফে বেজিংকে পরিস্কার করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারত নিজের সীমানার মধ্যেই রাস্তা তৈরি করছে। আর এই কাজ কোনওভাবেই থামানো যাবে না।
শুধু রাস্তাই নয়, একের পর স্ট্র্যাটেজিক ব্রিজও তৈরি করেছে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন। যার সাহায্যে খুব সহজেই ভারতীয় সেনা পৌঁছে যাচ্ছে একেবারে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায়।
পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যাকার মতো দুর্গম এলাকায় এতদিন পায়ে হেঁটে নজরদারি চালাতে হল ভারতীয় সেনাকে। কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক রোড তৈরির ফলে এখন গাড়ি করেই সেইসব এলাকায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ভারতীয় জওয়ানরা।
প্রাক্তন এক সেনাকর্তা জানান, লিপুলেখে সড়কের উদ্বোধন করেছে ভারত। এর ফলেও চিনের উদ্বেগ বেড়েছে। লাদাখ-সিকিমের মতো দুর্গম এলাকাতেও এখন ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট মোতায়েন করেছে ভারতীয় সেনা
ট্যাঙ্ক ছাড়াও বোফর্সও মোতায়েন করা হয়েছে চিন সীমান্তে। আমেরিকার থেকে কেনা আলট্রা লাইট হোবিডসন এম৭৭ কামানও মোতায়েন হয়েছে সেখানেই।
পাশাপাশি হঠাত্ করে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তা মোকাবিলায় আনা হয়েছে ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিকল। ২০১৯ সালে পূর্ব লাদাখে চিন সীমান্তে সেনা মহড়া করে ভারত দেখিয়ে দিয়েছে, এখন আর শুধু পদাতিক বাহিনীই নয়, ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, চালকহীন বিমান, স্পেশাল ফোর্সও প্রতি মুহূর্তে তৈরি রয়েছে।
চোখের পলকে পাল্টা হামলা করতে তৈরি করা হয়েছে ইন্টিগ্রেটেড ব্যাটেল গ্রুপ বা আইবিজি। পশ্চিমবঙ্গের পানাগড়ে পাহাড়ে লড়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর-কে।
একদিকে স্ট্যাটেজিক রোড, ব্রিজ বানিয়ে একেবারে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় পৌঁছে গিয়ে চিনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা, অন্যদিকে সেনার আধুনিকীকরণ করা-- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাও ভারতের বিরুদ্ধে চিনা আগ্রাসনের অন্যতম কারণ।