এক্সপ্লোর

ব্লগ : "পশ্চিমবঙ্গে হারেরই যোগ্য ছিলেন মোদি"

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পর্ব শেষ। ক্ষমতা ধরে রাখলেন মমতা। আশানুরূপ ফল করতে ব্যর্থ বিজেপি। কোথায় ত্রুটি ছিল ? প্রত্যাশিত ফল না করতে পারায় কি মোদির ভাবমূর্তিতে কোনও দাগ লাগল ? চলছে কাটাছেঁড়া, বিশ্লেষণ...

 

ভারতীয় নির্বাচনে কালেভদ্রে সুন্দর বিষয় হয়ে থাকে। নিশ্চিতভাবেই তা গত দশকে ছিল না। অধিকাংশ দেশেই রাজ্য বিধানসভা সহ নির্বাচনের বিশাল প্রক্রিয়াটা খুব শান্তভাবে হয়। কিন্তু, ভারতে নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকে বিশৃঙ্খল করে তোলেন রাজনীতিক এবং তাঁদের অনুগামীরা। সদ্য শেষ হওয়া পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে শুধুমাত্র অন্যতম তিক্ত লড়াই-ই নয়, এটা নিশ্চিতভাবে বিজেপির অসাধুতার গভীরতাকে তুলে ধরেছে। এমনকী ক্ষমতায় আসার জন্য এরা নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানকেও টেনে নামিয়ে এনেছে। 

বিজেপি এবং এই দলের দুই প্রধান মুখ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর পরাজয়ের তাৎপর্য খতিয়ে দেখার আগে, এটা অনুমান করে নেওয়া ভালো যে এই ধারণা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে যে গত সাত বছরের মধ্যে বিজেপির এই হার সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ। ৭৭টি আসন এবং ৩৮.১ শতাংশ ভোট পাওয়ার পর বিজেপির গর্ব অনুভব করার কারণ রয়েছে। অন্যদিকে নিশ্চিতভাবেই কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু এবং অসমে বর্তমানে নির্বাচিত হওয়ার মতো জায়গায় নেই। একইভাবে সিপিএমেরও নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছে। যে দলটা কিছু আগেও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রাজত্ব করত। বাম-কংগ্রেস জোট একটিও আসন জেতেনি। কিন্তু, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে, বামেরা ৭৬টি আসনে জয়লাভ করেছিল। সেক্ষেত্রে বিজেপির হয়ে যে বলবেন তিনি বলতেই পারেন যে দলের পরজয়টা আদৌ 'চূর্ণ' হয়ে যাওয়ার মতো নয়। ২০১৬-য় ১০.২ শতাংশ থেকে ২০২১-এ ৩৮.১ শতাংশ ভোট পেয়েছে দল। বিজেপি যে কটা আসন পেয়েছে, প্রায় সবগুলিই কংগ্রেস ও বামেদের পরিবর্তে।

কিন্তু এটা সামগ্রিক চিত্রর থেকে অনেক দূরে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনটা এর মানদণ্ড নয়, বরঞ্চ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনটা। যখন বিজেপি ৪০.২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২ শতাংশ কমে যাওয়াটা হয়ত তাৎপর্যহীন মনে হতে পারে, বিশেষত তাঁর কাছে যিনি পরিসংখ্যান বিচার করে চলেন। বাস্তব বিষয়টা হচ্ছে, মোদি এবং শাহর আদেশ দক্ষিণ ভারতে চলে না। তামিলনাড়ু ও কেরলে বিজেপির পরাজয়েই তা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। অদ্রাবিড়ীয় অংশে তাই বাংলাকেই শেষ বড় পুরষ্কার হিসেবে চোখ করেছিল বিজেপি। যেটা তাদের মুঠো থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। বাংলাকেও তাঁর আজ্ঞাবহ করে তুলতে মোদি তাঁর সবকিছু দিয়েছিলেন। এবং তাই এই বিষয়টি উহ্য রেখেও পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে নির্বাচনটা তাঁর আসল লক্ষ্য। কয়েকদিন আগেই একটি জনসভায় বক্তব্য রাখার সময় তিনি নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমাতে বলেছিলেন, চারপাশে মানুষের সমুদ্র দেখছেন। এমনকী কোনও জনসভায় এত লোক দেখা গিয়েছে কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। এই বক্তব্যের জেরে তিনি বিশ্বজুড়ে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর সরকারের অজ্ঞতার জন্য হাজার হাজার মানুষ কোভিড মহামারীতে মারা যাচ্ছেন। নীতিগতভাবে তাঁর ডেপুটি অমিত শাহ একইভাবে ভবিষ্যবাণী করেছিলেন, বিজেপি ২০০ আসনে জিতবে।

বিজেপির কাছে এটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া পরাজয়ের থেকেও বেশি, এই হার মোদির অপমান। ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সম্মান প্রাপ্য, কিন্তু মোদি এটাকে নিজের দাসীতে পরিণত করেছেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ সপ্তাহ ধরে আট দফায় নির্বাচন করানো। সাধারণ নির্বাচন ছাড়া এতগুলি দফা হওয়া একটা নজিবিহীন বিষয়। এটা একটা ইঙ্গিত দেয় যে, মোদি এই নির্বাচনটাকে লোকসভা নির্বাচনের মতোই গুরুত্বপূর্ণভাবে নিয়েছিলেন। এর পিছনে কারণ এটাই যে, বিজেপি যাতে টাকা ঢালার জন্য সপ্তাহব্যাপী সময় পায় এবং ভোটে জেতার জন্য অন্যান্য বিষয়গুলির ব্যবস্থা করতে পারে। এভাবে তৃণমূল এবং অন্য বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে সুবিধা লাভ করতে চেয়েছিল বিজেপি। তা সত্ত্বে বিজেপি ও মোদি হেরে গেলেন। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা, যেগুলি সব মোদির পকেটে রয়েছে, তারা প্রায়ই বহু পুরানো দুর্নীতির অভিযোগে তৃণমূল নেতাদের ডেকে পাঠাচ্ছিল। কিছু তৃণমূল নেতাকে কিনে নেওয়া গিয়েছে। এবং তাঁদের দল বেঁধে বিজেপি শিবিরে যোগ দিতে প্ররোচিত করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিজেপি ও মোদি হেরে গেলেন।  ভারতে বিজেপিই প্রথম দল নয় যারা সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছে, কিন্তু মোদি ও শাহ সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছেন প্রতিশোধস্পৃহায়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা দেখিয়েছেন। এবং হিন্দুদের অহঙ্কারকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য হিন্দুদের প্ররোচিত করেছেন। আর নির্বাচন কমিশন রাজনীতিকদের সাম্প্রদায়িক উস্কানি থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছেন, কিছু করেনি। তা সত্ত্বেও বিজেপি ও মোদি হারলেন।

কোনও সন্দেহ নেই, আগামী দিনগুলিতে এই নির্বাচন নিয়ে টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটাছেঁড়া হবে। ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়াকে মূল ফ্যাক্টর হিসেহে দেখে আসেন রাজনৈতিক পণ্ডিত ও ভোট-বিশ্লেষকরা। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে এই ধারণা বৃথা প্রমাণিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক আবেগের পাশাপাশি ভোটে প্রচুর টাকা ঢেলেছে বিজেপি। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয়কে ট্রোল করা এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে দেশে এরকম একটা মহামারী চলছে, সেই সময় দায়মুক্ত হয়ে এত জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করা-পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিকে(যিনি ভোটে জিততে জানেন) ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে।

প্রাচীন আর্যসভ্যতায়, জয়লাভের জন্য তাঁর ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে অশ্বমেধা যজ্ঞ করতেন শাসক। মোদি এই ত্যাগ করবেন না। কিন্তু, তিনি কোভিডে আলগা দিয়েছেন এবং হাজার হাজার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন যাতে তিনি এবং অমিত শাহ রোড শো করতে পারেন। তবে বাংলায় তিনবার হারার পর তাঁর জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে কি না তা এখনই বলাটা খুব তাড়াহুড়়ো হয়ে যাবে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় তাঁর অব্যবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কাছেও তাঁর ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়বে। প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জয়লাভের পর বলেছেন, 'বাংলা আজ ভারতকে বাঁচিয়ে দিল।' মুহূর্তের আলঙ্কারিক প্রয়োগ ছাড়া তাঁর এই বিশ্লেষণকে ধরে নিলে ভুল হবে। একটা বিষয় হচ্ছে, তৃণমূল বিজেপির থেকে বেশি নীতি-পরায়ণ নয়। বাংলায় দিদির প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধাভক্তি রয়েছে, তাকে দেশের অন্য প্রান্তের মানুষ অন্য চোখে না দেখে বরঞ্চ বিজেপি ও মোদির এবং বিভাজনের রাজনীতির পরাজয় হিসাবে দেখুক। এই সময়টা মোদি পেরিয়ে যেতে চাইবেন এবং তাঁর অনুগামীরা দেশকে মনে করিয়ে দেবেন যি তিনি একটি যুদ্ধে হারতে পারেন, কিন্তু এখনও যুদ্ধজেতার ক্ষমতা রাখেন। সবথেকে তিক্ত সত্য এটাই যে, দেশের একটা নতুন রাজনৈতিক দিশা প্রয়োজন যা অধর্ম ও অসত্যের জলা থেকে রাজনীতিকে বের করে আনবে। দেশের এই অন্ধকার সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ফল এই আশার আলো এনেছে যে আগামীদিন সম্ভবত আরও ভাল হবে।  

(বিনয় লালের ব্লগ থেকে...। এই প্রতিবেদনের মতামত সম্পূর্ণ লেখকের। এর সঙ্গে এবিপি আনন্দর কোনও সম্পর্ক নেই)।

 

আরও দেখুন
Advertisement
Advertisement
Advertisement

সেরা শিরোনাম

West Bengal Live: ক্যানিং থেকে গ্রেফতার তেহরিক উল মুজাহিদিনের সদস্য জাভেদ আহমেদ মুন্সি
ক্যানিং থেকে গ্রেফতার তেহরিক উল মুজাহিদিনের সদস্য জাভেদ আহমেদ মুন্সি
Rohit Sharma: নেটে চোট রোহিতের, চতুর্থ টেস্টের আগেই ভারতীয় শিবিরে বিরাট ধাক্কা
নেটে চোট রোহিতের, চতুর্থ টেস্টের আগেই ভারতীয় শিবিরে বিরাট ধাক্কা
LIC Policy Surrender: মেয়াদপূরণের আগে LIC পলিসি সারেন্ডার করছেন, এই আর্থিক ক্ষতি হবে !
মেয়াদপূরণের আগে LIC পলিসি সারেন্ডার করছেন, এই আর্থিক ক্ষতি হবে !
West Bengal News Live Updates: ভারতের সঙ্গে হওয়া একাধিক চুক্তি বাতিলের দাবি বাংলাদেশের অধ্য়াপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মহম্মদের
ভারতের সঙ্গে হওয়া একাধিক চুক্তি বাতিলের দাবি বাংলাদেশের অধ্য়াপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মহম্মদের
Advertisement
ABP Premium

ভিডিও

Suvendu Adhikari: ঘর দিতে কাটমানি চাইছেন তৃণমূল বুথ সভাপতি? ভিডিও পোস্ট শুভেন্দুর | ABP Ananda LIVECanning News: ক্যানিং থেকে গ্রেফতার সন্দেহভাজন কাশ্মীরি জঙ্গি | ABP Ananda LIVETiger Fear Update:  জেলা সফরে যমুনা, ঝাড়গ্রাম ঘুরে এবার পুরুলিয়ায় চলে গেল বাঘিনী যমুনা | ABP Ananda LIVEBangladesh News : ভারতীয় পরিচয় পত্র বানিয়ে নাশকতার ঘুঁটি সাজাচ্ছিল আনসারুল্লা বাংলার জঙ্গি!

ফটো গ্যালারি

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
West Bengal Live: ক্যানিং থেকে গ্রেফতার তেহরিক উল মুজাহিদিনের সদস্য জাভেদ আহমেদ মুন্সি
ক্যানিং থেকে গ্রেফতার তেহরিক উল মুজাহিদিনের সদস্য জাভেদ আহমেদ মুন্সি
Rohit Sharma: নেটে চোট রোহিতের, চতুর্থ টেস্টের আগেই ভারতীয় শিবিরে বিরাট ধাক্কা
নেটে চোট রোহিতের, চতুর্থ টেস্টের আগেই ভারতীয় শিবিরে বিরাট ধাক্কা
LIC Policy Surrender: মেয়াদপূরণের আগে LIC পলিসি সারেন্ডার করছেন, এই আর্থিক ক্ষতি হবে !
মেয়াদপূরণের আগে LIC পলিসি সারেন্ডার করছেন, এই আর্থিক ক্ষতি হবে !
West Bengal News Live Updates: ভারতের সঙ্গে হওয়া একাধিক চুক্তি বাতিলের দাবি বাংলাদেশের অধ্য়াপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মহম্মদের
ভারতের সঙ্গে হওয়া একাধিক চুক্তি বাতিলের দাবি বাংলাদেশের অধ্য়াপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মহম্মদের
Bangladesh Mayanmar Border: বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মায়ানমারের রাখাইনে সামরিক হেড কোয়র্টারই কব্জায় বিদ্রোহী সেনার ? আরও চাপে ইউনূস প্রশাসন ?
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মায়ানমারের রাখাইনে সামরিক হেড কোয়র্টারই কব্জায় বিদ্রোহী সেনার ? আরও চাপে ইউনূস প্রশাসন ?
Durgapur News: পুলিশের তাড়া, নিয়ন্ত্রণ হারাল ওভারলোডেড ট্রাক্টর, রাস্তার পাশেই বাইকে পরিবারের ৩ সদস্য; যা ঘটল দুর্গাপুরে
পুলিশের তাড়া, নিয়ন্ত্রণ হারাল ওভারলোডেড ট্রাক্টর, রাস্তার পাশেই বাইকে পরিবারের ৩ সদস্য; যা ঘটল দুর্গাপুরে
Virat Kohli restaurant: নিয়মবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ, বিরাট কোহলির রেস্তোরাঁকে পাঠানো হল নোটিস
নিয়মবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ, বিরাট কোহলির রেস্তোরাঁকে পাঠানো হল নোটিস
Asit Majumdar: জনসংযোগে বেরিয়ে নর্দমায় পড়ে গেলেন TMC MLA! পায়ে ধরল চিড়
জনসংযোগে বেরিয়ে নর্দমায় পড়ে গেলেন TMC MLA! পায়ে ধরল চিড়
Embed widget