Bankura Profile: টেরাকোটাশিল্প ও লালমাটির গন্ধ, মল্ল রাজত্বের কেন্দ্রভূমি বাঁকুড়ায় ইতিহাসের হাতছানি
Bankura District News: শুশুনিয়া সহ আশপাশের এলাকায় প্রাচীন ও নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার উদ্ধার হয়। বাঁকুড়া জেলা একসময় ছিল রাজা চন্দ্রবর্মণে শাসনাধীন।
বাঁকুড়া: পরতে পরতে লুকিয়ে ইতিহাস। একাধিক নিদর্শন এই জেলাকে করে তুলেছে অনন্য। রাজনৈতিক পটভূমি হোক বা পর্যটন, জেলার গুরুত্ব সব ক্ষেত্রেই ছাপ ফেলেছে। একনজরে বাঁকুড়ার জানা অজানা কাহিনি।
ইতিহাস: বাঁকুড়ার প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষের বসবাস। ডিহরে প্রাচীন জনবসতির নিদর্শন পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে দ্বারকেশ্বর নদের অংশে উত্তর তীরে তাম্র-প্রস্তর যুগীয় জনবসতি গড়ে উঠেছিল। আদি বাসিন্দা ছিল একাধিক প্রোটো-অস্ট্রালয়েড ও প্রোটো-দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ। পরবর্তী প্রাগৈতিহাসিক যুগে আর্য জাতি এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। শুশুনিয়া সহ আশপাশের এলাকায় প্রাচীন ও নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার উদ্ধার হয়। বাঁকুড়া জেলা একসময় ছিল রাজা চন্দ্রবর্মণে শাসনাধীন। শুশুনিয়া পাহাড়ের গায়ে থাকা ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা শিলালিপি তার প্রমাণ দেয়। নবম দশম শতকে বাঁকুড়া জেলা একাধিক ভূম রাজার অধীনে ছিল। তার মধ্যে মল্লভূমের রাজত্ব ছিল সবথেকে বড়। রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর। মল্লভূম ছাড়াও ছাতনা এলাকায় সামন্তভূম, জঙ্গলমহলের একাংশে শিখরভূম, ও পশ্চিমের একাংশ মানভূম সাম্রাজ্যর অন্তর্ভূক্ত ছিল। ব্রিটিশ আমলে প্রথমে এই জেলা বর্ধমান অন্তর্ভুক্তির অংশ ছিল। পরে জঙ্গলমহল জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। কিছুদিন বিষ্ণুপুরকে জেলা সদর করে এই জেলা শাসন করে ব্রিটিশরা। বাঁকুড়া জেলা ছিল রাঢ় অঞ্চলের অধীনে। কিছুদিন এই এলাকার নাম ছিল পশ্চিম বর্ধমান। ১৮৮১ সালে এই জেলার নাম হয় বাঁকুড়া। বাঁকুড়া শহরকে সদর করে বাঁকুড়া জেলা আত্মপ্রকাশ করে।
অবস্থান: এই জেলার উত্তরে ও পূর্বে পূর্ব বর্ধমান এবং পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণে পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ-পূর্ব হুগলি এবং পশ্চিমে পুরুলিয়া জেলা। দামোদর নদ বাঁকুড়া ও বর্ধমান জেলা দুটিকে পৃথক করেছে।
- মোট আয়তন ৬,৮৮২ বর্গকিমি (২,৬৫৭ বর্গমাইল)
- জনসংখ্যা- ৩৫ লক্ষ ৯৬ হাজার ২৯২
- মহকুমা- ৩
- ব্লক- ২২
- গ্রাম পঞ্চায়েত- ১৯০
- গ্রাম- ৫ হাজার ১৮৭
- পুরসভা- ৩
- থানা- ২৩
ভূ পরিচয়: রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এই জেলা। বাঁকুড়া জেলা রাজ্যের মেদিনীপুর বিভাগের অন্তর্গত পাঁচটি জেলার অন্যতম একটি জেলা। এই জেলার উত্তরে ও পূর্বে পূর্ব বর্ধমান এবং পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণে পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ-পূর্ব হুগলি এবং পশ্চিমে পুরুলিয়া জেলা। দামোদর নদ বাঁকুড়া ও বর্ধমান জেলাদুটিকে পৃথক করেছে। এই জেলাকে পূর্বের বঙ্গীয় সমভূমি ও পশ্চিমের ছোটোনাগপুর মালভূমির মধ্যকার সংযোগসূত্র বলা যায়। জেলার পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভাগের জমি নিচু ও উর্বর পলিমাটিযুক্ত। পশ্চিম ভাগের জমি ধীরে ধীরে উঁচু হয়েছে। এই অঞ্চলে স্থানে স্থানে ছোটোখাটো টিলা দেখতে পাওয়া যায়।
অর্থনীতি: জেলার মূল অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। জেলার পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভাগের সমভূমি এলাকায় আমন, বোরো ধান ছাড়াও বিপুল পরিমান আলু উৎপাদন হয়। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভাগে সেচের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় বছরে একবারই আমন ধান চাষ হয়। জেলার বড়জোড়া ও দ্বারিকা শিল্পতালুকে বেশ কিছু মাঝারি ও ছোট শিল্প রয়েছে। মেজিয়া ব্লকে রয়েছে কালিদাসপুর কয়লাখনি। গঙ্গাজলঘাটি ব্লকে রয়েছে মেজিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সরকারী চাকরি ছাড়াও এই শিল্প তালুক, কয়লা খনি ও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কিছু মানুষ কাজ করেন। এছাড়াও পাঁচমুড়ার মৃৎ শিল্প, বিকনার ডোকরা শিল্পের মতো বিভিন্ন কুটিরশিল্পে বহু মানুষ যুক্ত।
রাজনীতি: ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলা ছিল বামেদের শক্ত ঘাঁটি। ২০১১ সালের পর ধীরে ধীরে বামেদের যত শক্তি ক্ষয় হয় ততই শক্তিশালী হয়ে ওঠে তৃণমূল। ২০১৬ থেকে ২০২১ এই সময় জেলার ১২ টি বিধানসভা, তিনটি পুরসভা থেকে শুরু করে অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত, সমস্ত পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ ছিল তৃণমূলের দখলে। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে ১২ টি বিধানসভা আসনের আটটি ছিনিয়ে নেয় বিজেপি। শালতোড়া, ছাতনা, রানিবাঁধ, রায়পুর, তালডাংরা, বাঁকুড়া, বড়জোড়া, ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর, ইন্দাস, সোনামুখীর মতো বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে এই জেলায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থা: সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই জেলার উপর দিয়ে চলে গেছে রানিগঞ্জ খড়্গপুর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক। এছাড়াও রয়েছে পুরুলিয়া বাঁকুড়া ৬০ এ জাতীয় সড়ক। এছাড়াও বাঁকুড়া দুর্গাপুর, বাঁকুড়া ঝাড়গ্রাম, বেলিয়াতোড় বর্ধমান, বিষ্ণুপুর কোতুলপুর, বাঁকুড়া শালতোড়া, বাঁকুড়া রানীবাঁধ রাজ্য সড়ক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। জেলার বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর দুটি প্রধান শহর ছুঁয়ে গেছে দক্ষিন পুর্ব রেলপথের আদ্রা খড়্গপুর শাখা। বাঁকুড়া মশাগ্রাম বিডি আর রেলপথ বিস্তীর্ণ অংশকে রেল যোগাযোগে যুক্ত করেছে। প্রস্তাবিত বিষ্ণুপুর তারকেশ্বর রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। কলকাতা বিমানবন্দরে এসে, কলকাতা থেকে বাঁকুড়া যাওয়া যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বড় শহরগুলি থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার নিয়মিত ট্রেন পরিষেবা রয়েছে। কলকাতা থেকে বাঁকুড়া যেতে, পেয়ে যাবেন একাধিক বাসও।
পর্যটন: মধ্যযুগীয় পশ্চিমবঙ্গের মল্ল রাজত্বের কেন্দ্রভূমি বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই পর্যটনের দিক থেকেও আকর্ষণীয়। ঐতিহ্য, উজ্জ্বল স্থাপত্য মন কাড়ে আপামর বাঙালির। যুগ যুগ ধরে বাঁকুড়া জেলা রাজ্য-দেশ-বিদেশের একাধিক পর্যটকের অন্যতম আকর্ষণ। এই জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র মুকুটমনিপুর। এছাড়াও মল্ল রাজাদের প্রাচীন রাজধানী বিষ্ণুপুর, পাহাড়ি উপত্যকা ঝিলিমিলি, শুশুনিয়া পাহাড়, বিহারীনাথ পাহাড়, জয়পুরের জঙ্গল ও মা সারদার পবিত্র জন্মস্থান জয়রামবাটিতে সারা বছর বহু পর্যটক আসা যাওয়া করেন।
মুকুটমণিপুর- মুকুটমণিপুরে গড়ে ওঠা বাঁধটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঁধ। কুমারী ও কংসাবতী নদীর সঙ্গমস্থলে তৈরি হয় এই বাঁধ।
বিষ্ণুপুর- বিষ্ণুপুর মন্দিরনগরীর পরতে পরতে লুকিয়ে ইতিহাস। বঙ্গে পাথরের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে পোড়ামাটির ইটগুলি বিকল্প হিসাবে এসেছিল এবং বাংলা পায় ‘টেরাকোটা’ নামে এক নিখুঁত কারুকার্যের খোঁজ।
জয়রামবাটি- ‘বৈকুণ্ঠ হতে লক্ষ্মী এলো পৃথিবীর এই মাটিতে, জয়রামবাটিতে’। মা সারদার পুণ্য জন্মভূমি জয়রামবাটি। মা-এর জন্মস্থানে রয়েছে মাতৃমন্দির।
বিহারীনাথ পাহাড়- জল- জঙ্গল- পাহাড়ের এই মেলবন্ধনে শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশের মাঝে দাঁড়িয়ে ১৪৪৯ ফুটের বিহারীনাথ পাহাড়।
শুশুনিয়া পাহাড়- বাঁকুড়া জেলার উত্তর-পশ্চিমে দাঁড়িয়ে ১৫০০ ফুট উঁচু শুশুনিয়া পাহাড়। পাহাড়ের গা দিয়ে বয়ে চলেছে গন্ধেশ্বরী নদী। ইতিহাস অনুসারে, এই পাহাড়ে রাজা চন্দ্রবর্মণের দুর্গ ছিল।
আরও পড়ুন: Coochbehar History : রাজ্যে যোগ, রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে হেরিটেজ তকমা, কোচবিহারের কতটা জানা ?