(Source: ECI/ABP News/ABP Majha)
Coochbehar History : রাজ্যে যোগ, রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে হেরিটেজ তকমা, কোচবিহারের কতটা জানা ?
Coochbehar Profile : কোচবিহারের ইতিহাস, অবস্থান, ভূ-পরিচয় থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি, পর্যটন। কতটা জানা, কী-ই বা অজানা ? কোচবিহার সফর শুরু করা যাক।
কোচবিহার : সময়ের স্ত্রোতে একাধিক শাসক বদল। গ্রামে-গঞ্জে থাকা বেশিরভাগ মানুষের ছন্দময় জীবনের কলতান। বিভিন্ন সময়ে একাধিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। সমতলের প্রান্তিক জেলা রাজনীতি সচেতনতা থেকে রাজ্যে অন্তর্ভুক্তি। রাজ্য তথা দেশের রাজনীতিতে একাধিক উল্লেখোগ্য মুখের সঙ্গে একাধিক প্রাণখোলা ঘোরার জায়গা। ট্রেন, বাসে জীবনযাপনের মাঝে আকাশপথে যুক্ত হওয়ার দোরগোড়ায়। কতটা চেনেন জানেন কোচবিহার ?
কোচবিহারের ইতিহাস, অবস্থান, ভূ-পরিচয় থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি, পর্যটন। কতটা জানা, কী-ই বা অজানা ? কোচবিহার সফর শুরু করা যাক।
ইতিহাস - বর্তমানে কোচবিহার জেলা (Cooch Behar District) যে অংশটিতে রয়েছে প্রাচীনকালে সেই অংশের নাম ছিল প্রাগ জ্যোতিষপুর, পরবর্তীকালে এই অঞ্চল কামরূপ নামে পরিচিতি লাভ করে। কিছু সময় এই অঞ্চলে খেন বংশের রাজত্ব ছিল যাদের তিন রাজা ছিলেন নীলধ্বজ, চক্রধবজ এবং নীলাম্বর। মুসলিম শাসকদের আক্রমণে পরাজিত হন নীলাম্বর। এরপর এই এলাকা ছেড়ে মুসলিম শাসকরা চলে যান। যার পরে অনেকটা সময় অরাজক এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে অঞ্চলটি। এরপর ১৫১০ সাল নাগাদ মহারাজ চন্দনের হাত ধরে কোচ রাজবংশের রাজত্বের সূচনা হয়। এরপর প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে ২৪ জন শাসক রাজত্ব করেছেন কোচবিহারে।
১৭৭৩ সালে ভুটান আক্রমণের সুযোগ নিয়ে কোচবিহার রাজ্যের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চুক্তি হয় সেই থেকে কোচবিহার পরিণত হল করদ মিত্র রাজ্য হিসেবে।
পরবর্তীকালে কোচবিহারের মহারাজারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কোচবিহারের শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নতি সাধনে ব্রতী ছিলেন। কোচবিহারে বিভিন্ন স্কুল কলেজ ইত্যাদি তৈরি হয় এই সময়।। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণকে বলা হয় আধুনিক কোচবিহারের রূপকার, মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে বিয়ে হয় ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতি দেবীর। এরপর থেকেই রাজ্যে মহিলা শিক্ষার প্রসার শুরু হয় ব্যাপকভাবে। নৃপেন্দ্র নারায়ণের সময়েই কোচবিহারের রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে একাধিক স্থাপত্য নির্মিত হয় এবং কোচবিহারকে একটি পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের ২৮ আগস্ট মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি হয় এবং এই চুক্তির ফলে ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয় কোচবিহার রাজ্য। এরপর ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় রূপান্তরিত হয় কোচবিহার।
অবস্থান - হিমালয়ের কাছাকাছি অবস্থিত কোচবিহার এর উত্তর দিকে রয়েছে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলা, দক্ষিণে রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত। পূর্ব দিকে অসম ও বাংলাদেশ, পশ্চিম দিকেও রয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার সীমানার পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্ত। প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে এই জেলার।
ভূ-পরিচয় - এই জেলায় পুরোটাই সমতল ভূমিতে। তোর্সা, তিস্তা, রায়ডাক, জলঢাকা ইত্যাদি এই জেলার প্রধান নদী। কোথাও কোথাও কিছুটা উঁচু নিচু ভূ- ভাগ দেখা গেলেও জেলার গোটাটাই মূলত সমতল।
অর্থনীতি - জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল এই জেলার অধিকাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। কৃষি ছাড়াও সামান্য ব্যবসা রয়েছে সীমান্তকে কেন্দ্র করে। বড় বা ভারী শিল্প তেমন কিছু নেই, রয়েছে কিছু ছোট শিল্প। কোচবিহার শহরের অদূরে চকচকা শিল্প কেন্দ্রে কিছু শিল্প রয়েছে। মেখলিগঞ্জে একটি শিল্পতালুক গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে। পাট, তামাক এই জেলার অর্থকরী ফসল।
রাজনীতি - স্বাধীনতার সময় মূলত কোচবিহার ইংরেজদের মিত্র রাজ্য থাকায় রাজশাসনে ইংরেজ বিরোধী কোনো আন্দোলন দমন করা হয়েছে। তবে এই জেলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। বিভিন্ন আন্দোলনে রক্তাক্ত হয়েছে বারবার। খাদ্য আন্দোলন, বা ভেজাল তেলের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অন্যদিকে আলাদা রাজ্যের দাবিতে গ্রেটার কোচবিহারের আন্দোলন অথবা ফরওয়ার্ড ব্লকের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। জেলা থেকে সন্তোষ রায়, ফজলে হক কংগ্রেস আমলে মন্ত্রী ছিলেন, বামেদের সময় কমল গুহ, শিবেন চৌধুরী, দীনেশ ডাকুয়া , অনন্ত রায় একাধিক দফতরের দায়িত্ব সামলেছেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর জেলা থেকে হিতেন বর্মন, বিনয় কৃষ্ণ বর্মন, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, উদয়ন গুহ রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতর সামলেছেন বা সামলাচ্ছেন। কোচবিহারের সাংসদ নিশ্চিত প্রামাণিক বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ দফতরের দায়িত্ব রয়েছেন। রাজনৈতিক সংঘর্ষে বিভিন্ন সময় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কোচবিহার, একাধিক মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা - রাজধানী শহর কলকাতা থেকে কোচবিহারের দূরত্ব ৭০০ কিলোমিটারের কিছুটা বেশি । প্রান্তিক এই জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা মূলত ট্রেনের মাধ্যমে বেশি চলে। শিয়ালদা ও হাওড়া থেকে একাধিক ট্রেন নিউ কোচবিহার স্টেশনে আসে। যার মধ্যে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, পদাতিক এক্সপ্রেস, তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, সরাইঘাট এক্সপ্রেস, কামরূপ এক্সপ্রেস সহ বেশ কিছু দূরপাল্লার ট্রেন। নিউ কোচবিহার জংশন স্টেশনটি দেশের অন্যতম বড় জংশন স্টেশন। দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে যেতে হলে নিউ কোচবিহার স্টেশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও কলকাতা থেকে কোচবিহার বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি বাস চলাচল করে। তবে এতে সময় লাগে অনেক।। একসময় কোচবিহার কলকাতা বিমান পরিষেবা চালু থাকলেও এখন বন্ধ। যা ফের দ্রুতই চালু হওয়ার সম্ভাবনা। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই গতি পাবে। কোচবিহারে মহারাজাদের আমলে তৈরি হয় কোচবিহার স্টেট ট্রান্সপোর্ট, বর্তমানে তা উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা নামে পরিচিত। কোচবিহারের অভ্যন্তরে এবং কোচবিহারের আশেপাশের জেলাগুলির সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার বাস। এছাড়া বেসরকারি বাসও রয়েছে অনেক।
পর্যটন- ইতিহাস প্রসিদ্ধ কোচবিহারের পর্যটনের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, রাজ আমলের বিভিন্ন নিদর্শন যেমন কোচবিহার প্রাসাদ, মদনমোহন মন্দির, সাগরদিঘী, বানেশ্বর শিব মন্দির, গোসানিমারি মন্দির, এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পুরনো বাড়ি যেমন লেন্স ডাউন হন, ভিক্টর প্যালেস, পারিজাত ভিলা প্রভৃতি। কোচবিহার শহর তৈরি হয়েছে পরিকল্পনামাফিক, যার ফলে রাস্তাঘাট অনেকটাই প্রশস্ত। ইতিমধ্যে কোচবিহারকে হেরিটেজ শহর হিসেবে ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সেইমতো শহরের সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে । বিভিন্ন পুরনো ভবন গুলিকে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। ইতিহাসের পাশাপাশি এই জেলায় রয়েছে রসিক বিল যেখানে প্রতিবছর হাজার হাজার পাখি হাজির হয়। এই জেলার পর্যটনের সম্ভাবনা কে পর্যটকদের মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে রাজ্য সরকার।
(তথ্য- শুভেন্দু ভট্টাচার্য, সম্পাদনা- অঞ্জন চক্রবর্তী )
আরও পড়ুন- মাটিতে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ! ২ দিন পরে 'স্বাধীনতা'! চেনা মালদার অচেনা দিক