এক্সপ্লোর

অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘নায়ক’

নায়ক ৫০। সেপ্টেম্বরের ৩ মহানায়ক ৯০-এ। লিখছেন আবীর মুখোপাধ্যায়

সন্ধ্যারানিকে পরিচালকের অপমানের জেরে এক বার ফ্লোরে ধুন্ধুমার ঘটিয়েছিলেন!
টাকার অভাবে বন্ধ হতে চলা ছবির কাজে অর্থ জোগান দিতেও পিছ’পা ছিলেন না।  পড়ন্তবেলায় রসিকতা করে কাজ চেয়েছিলেন নাকি সত্যজিৎ রায়ের কাছে! তাঁর মহাকাব্যিক জীবনের কাহিনি যেন আজও শেষ হবার নয়!  পর্দার মতো জীবনেও তিনি যেন মহানায়কোচিত! image1 পুলু, তুই একটু বাইরে যা তো   সে দিন কি তবে অনুজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সামনে অভিনয় করতে অস্বস্তিতে পড়ছিলেন মহানায়ক? একের পরে এক শট ‘এনজি’! নট গ্র্যান্টেড! বারবার রি-টেক! সংলাপ বলতে বলতে হোঁচট খাচ্ছেন! জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখে ক্লান্তির ছাপ। পরিচালক দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের পাশেই বসে ছিলেন সহ-অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘বাজে একটা শট। বদলে দিতে বলো না।’’ উঁহু! উত্তম তা বললেন না। অনুজ-অভিনেতাকে বললেন, ‘‘বোস না। এক্ষুনি হয়ে যাবে। শট ওকে করে চা খাব।’’ ক্যামেরার পিছন থেকে পরিচালক এগিয়ে এলেন, ‘‘তাহলে একটা টি-ব্রেক দিই।’’ নারাজ মহানায়ক! ‘‘না, না। আগে এই শটটা আমি ঠিক করব।’’ ফের এনজি! পর পর এনজি হচ্ছে কেবল! বিন্দু বিন্দু ঘামছেন মহানায়ক! আচমকা সৌমিত্রের দিকে ফিরে বললেন, ‘‘পুলু, তুই একটু বাইরে যা তো।’’ ‘‘কী!’’ মহানায়কের কথায় হতবাক সৌমিত্রবাবু! বাইরে চলে গেলেন। একটু পরে শট ওকে করে ফ্লোরের বাইরে এলেন উত্তমকুমার। সিগারেট চেয়ে নিয়ে বললেন, ‘‘না, নার্ভাস লাগছিল না। তোকে দেখে ভীষণ সেলফ-কনশাস হয়ে পড়ছিলাম।’’ ‘‘সেলফ-কনশাস?’’ ‘‘না মানে উচ্চারণের, জিভের ওই ব্যাপারটা হচ্ছিল তো। তোর জিভটা তো পরিষ্কার!’’   এ বার পেরেছি তো ছোটবাবু?   অভিনয় নিয়ে তাঁর এমন খুঁতখুঁতানির গল্প আজও শোনা যায় টলিপাড়ায়। তাঁর তুখড় সমালোচক ছিলেন ভাই তরুণকুমার। একবারের কথা। পর পর সাত সাতটা ছবি রিলিজ সেবার। সুপ্রিয়াদেবীর বিপরীতে ‘রক্ততিলক’, ‘যদি জানতেম’,  অপর্ণা সেনের সঙ্গে ‘যদুবংশ’, ‘আলোর ঠিকানা’, বাসবী নন্দীর সঙ্গে ‘রোদন ভরা বসন্ত’, পীষূষ বসুর ছবি সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘বিকালে ভোরের ফুল’! তখনই স্পেশাল স্ক্রিনিং ‘অমানুষ’-এর। পাশপাশি বসেছেন তরুণকুমার, উত্তমকুমার, ছবির পরিচালক শক্তি সামন্ত। খুব কাছের কয়েকজন সাংবাদিকও। ছবি দেখে সবাই খুব প্রশংসা করছেন। সন্ধে গড়াতেই রাত পার্টি শুরু হল উত্তমকুমারের বাড়িতে। ৪৬/এ, গিরীশ মুখার্জি রোডে। এমন আসর সে সময় প্রায়ই বসাতেন মহানায়ক। বেশির ভাগ দিন তাঁর পরনে থাকত চুনোট করা ধুতি। গলায় কলকার কাজ করা বুকের বোতাম-ছুট পাঞ্জাবি। মুখে মোহন হাসি। সে দিন জমজমাট খানাপিনার আসরে সবার মুখে তখনও ‘অমানুষ’-এ মহানায়কের অভিনয়ের কথা। কেবল চুপ তরুণকুমার! নজর এড়ায়নি অগ্রজের। ঘুরতে ঘুরতে ঠিক ভাইয়ের সামনে। ‘‘ছোটবাবু এত চুপচাপ কেন?’’ ‘‘চুপ কোথায়!’’ ‘‘ছবিটা কি তোর ভালো লাগেনি? দর্শকরা নেবে না বলছিস!’’ গ্লাস নামিয়ে দাদার চোখে চোখ রাখলেন তরুণকুমার। তারপর তাঁর পরিচিত ভঙ্গিতে জোরের সঙ্গে বললেন, ‘‘কে বলেছে নেবে না? আলবাত নেবে! হল থেকে তোলা যাবে না।’’ ‘‘তাহলে কি আমার অভিনয়...!’’ কথা শেষ হল না মহানায়কের। ঠোঁটের কোণে সিগারেটটা জ্বলছে। ঠোঁট অল্প ফাঁক। ঠিক যেন নায়ক-এর ঘাড়-ফেরানো ক্লোজআপ। তরুণকুমার বললেন, ‘‘ঠিক বলেছ। তোমার অভিনয় আমার একদম ভাল লাগেনি। এমন অভিনয় তোমার কাছ থেকে আশা করিনি। এমন প্রগলভতা তোমাকে মানায় না দাদা।’’ তরুণকুমার থামার পরেও একটু চুপ করে রইলেন উত্তমকুমার। ঠোঁট থেকে ফুরিয়ে আসা সিগারেটটা ছাইদানে ঠেসে দিতে দিতে বললেন, ‘‘দ্যাখ, ছবির চিত্রনাট্য যেমন ডিমান্ড করবে, আমাকে তো সেটাই করতে হবে। চিত্রনাট্য যা চেয়েছে, তাই করেছি। কখনও তেমন চিত্রনাট্য পেলে, তেমন অভিনয় করব।’’ কয়েক মাস পরেই তেমন চিত্রনাট্য পেলেন উত্তম। সমরেশ বসুর কাহিনি নিয়ে ছবি, ‘বিকেলে ভোরের ফুল’। দু’জনে ছবি দেখছেন। উত্তম তরুণকুমারকে বললেন, ‘‘কী ছোটবাবু, এ বার পেরেছি তো?’’ কী বলবেন তরুণকুমার! শ্রদ্ধায় দাদার দিকে তাকিয়ে, একটা প্রণাম করলেন! ঠিক হল কিনা একটু জেনে নেবেন নিজের অভিনয়ের ভালমন্দ নিয়ে কেউ কিছু বললে ভুলতেন না। তখন সদ্য সদ্য মুক্তি পেয়েছে উত্তমের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। শুটিংয়ের ফাঁকে জোর আড্ডা বসেছে মুভিটোন স্টুডিয়োতে। এক প্রবীণ সাংবাদিক অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করলেন, ছবিতে বৃদ্ধ রাইচরণকে কেমন লাগল? ‘‘বেশ লাগল। সব ঠিকই তো।’’ ‘‘ব্যস, এইটুকুই?’’ তাতে কানুবাবু যা বললেন তা অনেকটা এ রকম, ‘‘উত্তম খুব মন দিয়ে অভিনয় করেছে। তবে কি জানো, রাইচরণ যখন বয়স্ক হয়ে গিয়েছে, তখন উত্তমের উচিত ছিল চোখের দৃষ্টিটাকে একটু ঝাপসা করে নেওয়া। ওর চোখ দুটো কমবয়সি চোখের মতোই ঝকঝক করছিল।’’ এই কথার সময়ই উত্তমকুমার ফ্লোর থেকে বেরিয়ে মেকআপ রুমের দিকে যাচ্ছিলেন। কানুবাবুর কথাগুলো তাঁর কানে গিয়েছিল। কোনও উত্তর দেননি। কথাটা যে তাঁর মনে ধরেছিল, বোঝা গেল কয়েক বছর বাদে। মুক্তি পেয়েছে সুশীল মজুমদারের ‘লাল পাথর’। বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয়ে আছেন উত্তমকুমার। এত দিনে বোধহয় নিজের ভুলটা শুধরে নেওয়ার সুযোগ পেলেন। ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পরে সেই সাংবাদিককে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘কানুদার কাছ থেকে একটু জেনে নেবেন তো এ বার দৃষ্টিটায় ঝাপসা ভাব এসেছে কি না!’’   লেখক সাজতে সাহিত্যিকের কাছে   কোনও একটি চরিত্রের গভীরে ঢুকে পড়তে কী না করেছেন! এমনও হয়েছে, পথ-চলতি মানুষের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন নিজের ছবির চরিত্র। ঠিক তক্ষুনি, আলাপ জমিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। একবার পঞ্জাবি ব্যবসায়ীর চরিত্র করতে গিয়ে ভবানীপুরের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের আস্তানার কাছে এক পঞ্জাবিকে দেখে পিছু ধাওয়া করেন! অভিনয়ে এমনই একশো ভাগ পারফেকশন আনার জন্যই ‘বউ ঠাকুরানির হাট’ করতে গিয়ে শিখেছিলেন ঘোড়ায় চড়া। ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ করতে গিয়ে শিখলেন মাঠে লাঙল চালানো! টেনিস খেলায় হাত পাকালেন ‘বিচারক’ ছবির শুটিং-এর আগে! ‘স্ত্রী’ ছবিতে ধ্রুপদ গানের দৃশ্যের জন্য চলে গিয়েছিলেন পার্ক সার্কাসে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের বাড়ি, তাঁর রেওয়াজ শুনতে ও দেখতে! এমনই একটি গল্প শোনা যায় ওঁর ‘এখানে পিঞ্জর’ ছবিতে কাজ করা নিয়ে। প্রফুল্ল রায়ের কাহিনি। পরিচালক দিলীপ মুখোপাধ্যায়। লেখকের চরিত্রে উত্তমকুমার। চিত্রনাট্য পড়ে তিনি পরিচালককে বললেন, লেখকের সঙ্গে দেখা করবেন। লেখকরা কী ভাবে থাকেন, কী ভাবে লেখেন, তাঁদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা কেমন— সেই সব জানতে চান। এ দিকে পরিচালকের প্রস্তাব এক কথায় না করে দিলেন প্রফুল্লবাবু, ‘‘না, না। সে হয় না।’’ দিলীপ মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘তা হলে আপনি যদি ওঁর ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে যান?’’ বিনা আমন্ত্রণে তাতেও রাজি নন লেখক! শেষে নিজের বাড়িতেই দু’জনকে আমন্ত্রণ জানালেন পরিচালক। দেখা হল, লেখকের সঙ্গে মহানায়কের! সে দিন কথায় কথায়, নানা প্রশ্নে উত্তম জেনে নিয়েছিলেন একজন লেখকের রোজনামচা। ছবিতে সেই জানাবোঝা দিয়েই গড়ে নিয়েছিলেন তাঁর বাঙালি লেখকের চরিত্র।   মানিকদা, আমাকে আর ছবিতে নিচ্ছেন না   ইন্ডোর হোক, বা আউটডোর— শ্যুটিং-এ আসতেন এক্কেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে। বিকাশ রায়ের পরিচালনায় ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এর শ্যুটিঙের একটি ঘটনা বললে, খানিকটা আন্দাজ হয়। ছবিতে উত্তমকুমার যে চরিত্রটি করেছেন, সেটি করার কথা ছিল সুনীল দত্তের। কোনও কারণে তা হয়নি। ছবির আউটডোর হচ্ছে দিঘাতে। ভোরের শট। ভোর-ভোর বিকাশ রায় পৌঁছে দেখলেন তাঁর আগেই উত্তম গিয়ে বসে আছেন! ‘‘তুমি এসে গেছ? তোমাকে ডাকতে লোক পাঠালাম যে!’’ ‘‘ভোরের শট। একবার মিস হয়ে গেলে, পুরো দিন নষ্ট! তাই রিস্ক নিইনি। কারও জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই চলে এসেছি!’’ বিকাশ রায় কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন উত্তমের দিকে। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, কেউ চা দেয়নি উত্তমকে। ব্যস্ত হতেই, আপত্তি জানালেন উত্তম। বললেন, ‘‘ওরা ঠিক চা দেবে, আপনি শট রেডি করুন!’’ এই খুঁতখুঁতে মানুষটিই আবার পড়ন্ত বেলায় এসে কি নির্বাসনে যেতে চেয়েছিলেন স্বেচ্ছায়? নইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কেনই বা বলবেন অমন কথা? লোডশেডিংয়ের জেরে চূড়ান্ত ক্ষতির মুখে তখন টলিপাড়া। মাঝে মাঝে শ্যুটিং শিডিউল ভেঙেচুরে একাকার। মেকআপ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে আর্টিস্টদের। খবরের কাগজে সে নিয়ে লেখালিখিও চলছে। একদিন মিটিং হল টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে। ঠিক হল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সমস্যার কথা জানানো হবে। গেলেন ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা। ছিলেন সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একটি গাড়িতে তিনজন। সামনে সত্যজিৎ। পিছনে তাঁর দুই নায়ক! ওঁদের কথা উড়ছে পথের হাওয়ায়! উত্তম রসিকতা করে বলছেন, ‘‘কী মানিকদা, আমাকে আর ছবিতে নিচ্ছেন না!’’ পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে সত্যজিতের উত্তর, ‘‘তুমি এমন একটা বয়সে পৌঁছেছ, না বুড়ো না জোয়ান! এই বয়সের রোল না পেলে তো আর তোমাকে নেওয়া যায় না। এই বয়সের রোল পাওয়া মুশকিল!’’ ‘‘ছবি বিশ্বাস চলে যাওয়ার পর থেকে সেরকম দারুণ একটা জমকালো বুড়ো নেই!’’ উত্তম আর সত্যজিতের কথোপকথনের স্মৃতি থেকে সৌমিত্রবাবু লিখেছেন, ‘‘তখন আমি ঠাট্টা করে বললাম, ‘না না উত্তমদা ছাড়ো তো! ও সব বুড়ো এখন পাওয়া যাবে না। তুমি আর আমি বুড়ো হলে, তখন আবার ইন্ডাস্ট্রিতে ভাল বুড়ো আসবে।... তারপর অনেক সময়ে উনি যখন হতাশায় ক্লান্ত, কোনও কারণে মনটন খারাপ, বলতেন, ‘দূর আর ভাল লাগছে না!’’’   সন্ধ্যারানির চোখে জল   ফ্লোরে এমনকী তার বাইরে অন্যদের, বিশেষ করে অগ্রজদের যে ভাবে সম্মান করতেন, তা বোধ হয় তাঁর কাছে শেখার মতো। এক বার ফ্লোরের মধ্যে এক পরিচালক সন্ধ্যারানির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বসলেন। তাতে এতটাই অপমানিত হলেন তিনি, চোখে জল এসে গিয়েছিল। উত্তমকুমার সে দিন স্টুডিয়োতেই ছিলেন। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এসে বলেন, ‘‘সন্ধ্যারানি আমাদের স্টুডিয়োপাড়ার লক্ষ্মী। ওঁকে যিনি অপমান করেছে, তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে। না’হলে আমি তো নয়ই, ফ্লোরে কেউ কাজ করবে না।’’ হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলেন পরিচালক! অগ্রজদের সঙ্গে দেখা হলে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন। তেমন সম্পর্ক ছিল কাননদেবীর সঙ্গে। তাঁকে ‘দিদি’ ডাকতেন। দেখা হলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন। কাননদেবী যখন ‘দেবত্র’ করলেন, ডেকেছিলেন উত্তমকে। উত্তমকুমারের হাতে তখন অনেক ছবি। তবু কাননদিদি ডেকেছেন, যাবেন না? তাই আবার হয় নাকি? অন্য পরিচালকদের কাছ থেকে ডেট ধার করেও ডেট দিয়েছিলেন দিদিকে! তাতে তরুণকুমার পর্যন্ত অবাক হয়ে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘তোমার হাতে এতগুলো ছবি। তারপরেও?’’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘কী জানিস বুড়ো, এমন ভুল করলে, জীবনে আর এই সুবর্ণ সুযোগ ফিরে আসবে না। ভাব তো! আমরা ছেলেবেলায় যাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম, বাবা-মাও যাঁর অভিনয়ের ভক্ত, সেই কাননদির ছবিতে কাজ করব, এটা কি কম সৌভাগ্যের কথা!’’ কাজ বন্ধ করবেন না, টাকাটা রাখুন   উপুড়হস্ত, উদার উত্তমকুমারের গল্প আজও ইন্ডাস্ট্রিতে ঘোরে ফেরে। হাজারিবাগে আউটডোর। ছবির নাম ‘জীবনমৃত্যু’। নায়ক-নায়িকা উত্তম-সুপ্রিয়াকে রাখা হয়েছে সরকারি ডাকবাংলোয়। উত্তমকুমার প্রযোজককে বললেন, ‘‘না না, শুধু আমরা কেন! এখানেই সকলে থাক।’’ তাতে যে এলাহি খরচ! প্রযোজক নিমরাজি। ‘‘তা’হলে আমায় ছেড়ে দিন। আমি এ ছবিতে কাজ করব না।’’ মহানায়কের এই কথাতেই কাজ হল! ‘সাগরিকা’র কাজ চলছে। মাঝ পথে প্রযোজক অসুস্থ। টাকার অভাবে শ্যুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। চিন্তিত সুচিত্রা সেন, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্ররা। নিরুপায় হয়ে পরিচালক সরোজ দে উত্তমকুমারকে ধরলেন। মহানায়ক বললেন, ‘‘কাজ বন্ধ কোরো না। হাজার তিরিশেক টাকা দেব, তুমি কাজ চালিয়ে নাও!’’ সে টাকার অবশ্য দরকার হয়নি, কিন্তু উত্তমকুমারের ওই আশ্বাস তাঁর অভিনয়ের মতোই ‘মিথ’ হয়ে আছে টলিপাড়ায়। অভিনেতা মণি শ্রীমাণির মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। এ দিকে টাকার জোগান নেই। খবর পেয়ে তরুণকুমার সব বললেন দাদাকে। সরাসরি এর-তার কাছ থেকে চাঁদা তুলে টাকা দিলে মণির আঘাত লাগতে পারে। তা হলে উপায়? বিশ্বরূপা রঙ্গমঞ্চে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন মহানায়ক। ঠিক হল, কেউ পারিশ্রমিক নেবে না। অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন তরুণকুমার এবং সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। গান গাইলেন উত্তম। তবলায় অসিতবরণ। সেই অনুষ্ঠানের সংগ্রহ করা তহবিল থেকেই অভিনেতা-কন্যার বিয়ের অনেকটাই অর্থ-জোগান হল। টেকনিশিয়ানে কাজ চলছে ‘যদুবংশ’ ছবির। শট দিতে গিয়ে উত্তমকুমারের খেয়াল হল, উপর থেকে একটা আলো পড়ার কথা ছিল সেটা জ্বলেনি। জ্বালানোর কথা যার, সেই লাইটম্যান কালী আনমনা। শট শেষ হল। উত্তমকুমার মেকআপ রুমে ডাকলেন কালীকে। কালী তো ভয়ে কুঁকড়ে একসা। দাদা নিশ্চয় বকাবকি করবেন। কাছে যেতেই উত্তমকুমার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী রে, কিছু হয়েছে?’’ প্রশ্ন শুনে কেঁদে ফেললেন কালী। ফের উত্তম জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোকে আজ আনমনা মনে হল...!’’ ‘‘মেয়ের বিয়ের ঠিক হয়েছে দাদা। টাকা জোগাড় করতে পারিনি। সেই চিন্তায়...। আর কখনও ভুল হবে না।’’ ঠিক পরদিনেই বাড়িতে ডেকে কালীর হাতে খামবন্দি টাকা তুলে দিয়েছিলেন মহানায়ক! কত যে এমন নজির! রাজ্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের অতিথি হয়ে ডিনারে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ-ই মর্জিবদল! রাজভবনের প্রায় গেটের সামনে থেকে হঠাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন। পাশের সিটেই বসেছিলেন ভাই তরুণকুমার। তিনি অবাক! জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হল ঘোরালে যে বড়!’’ ‘‘নারে, একটা কথা মনে ছিল না। একবার টালিগঞ্জ যেতে হবে।’’ সে রাতে টালিগঞ্জে কোথায় গিয়েছিলেন উত্তম? সে দিন এক টেকনিশিয়ানের মেয়ের বিয়ে ছিল। উত্তমকুমার কথা দিয়েছিলেন, যাবেন। রাজভবনের নৈশভোজে ফিরে গিয়েছিলেন ঠিকই। তার আগে সেই টেকনিশিয়ানের বাড়িতে গিয়ে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করে উপহার দিয়ে, তবে। শর্ত একটাই, গোপন রাখতে হবে   শুধু টলিপাড়ার অলিগলিতে নয়, তাঁর ভবানীপুরের মহল্লাতেও কত যে জুঁই স্মৃতি খেলা করে! পুজোর ঠিক আগের কথা। মহানায়কের মহল্লায় দাউ দাউ আগুনে মণ্ডপে পুড়ে ছাই হয়ে গেল দুগ্গা ঠাকুর!  গোটা পাড়াজুড়ে শোকের পরিবেশ। সকলেই মাথা নিচু করে ঘুরছে। ঘটে-পটে পুজোর কথা বলছেন কেউ কেউ। কেউ বলছেন, কুমোরটুলি থেকে নতুন করে মূর্তি আনার কথা। কিন্তু কে দেবে, এই শেষ সময়ে অতগুলো টাকা? রাত পার হলেই যে পুজো! ভেবে ভেবেই সারা হল পাড়া! পরদিন সানাইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙল মহানায়কের মহল্লার। হন্তদন্ত হয়ে কেউ কেউ ছুটলেন মণ্ডপের দিকে। কী ব্যাপার? তাঁরা দেখলেন, মণ্ডপ আলো করে প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে। ভিড়ের চোখে চোখে প্রশ্ন ঘুরছে। কে দিল টাকা? কার এই দান! প্রতিমাই বা এল কী করে, রাতারাতি এত আয়োজন! সে দিনের মতো গোপনই ছিল উত্তর। বহু পরে রহস্যের সমাধান করে দিয়েছিলেন অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। উত্তমকুমার নাকি স্টুডিয়ো থেকে ফিরছিলেন। মণ্ডপের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন অন্ধকার। ক্লাবের ছেলেদের কাছে পরদিনই জানতে পারেন প্রতিমা পুড়ে যাওয়ার খবর। সব শুনে তিনিই প্রতিমা আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে, ক্লাবের ছেলেদের কাছে একটিই শর্ত ছিল তাঁর। কী সেই শর্ত? উত্তমকুমার প্রতিমা আনার টাকা দিচ্ছেন, কাউকে সে কথা বলা যাবে না! কাউকে না। শুধু পর্দায় নয়, জীবনের গল্পেও তিনি ছিলেন মহানায়ক! ঋণ: মহানায়ক (কৃতী থেকে প্রকাশিতব্য গ্রন্থ, লেখক অশোক বসু), অগ্রপথিকেরা (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)
আরও দেখুন
Advertisement
Advertisement
Advertisement

সেরা শিরোনাম

পূর্ণ কর্মবিরতি থেকে সরে আসছেন চিকিৎসকরা ? ১০ ঘণ্টার মিটিং-শেষে বড় আপডেট
পূর্ণ কর্মবিরতি থেকে সরে আসছেন চিকিৎসকরা ? ১০ ঘণ্টার মিটিং-শেষে বড় আপডেট
'দুর্গাপুজো? সে তো অনেক খরচ' ! মেয়ে বলেছিল, 'সব পারব মা', ঘরভরা শূন্যতার মাঝে ডুকরে উঠলেন মা
ঠাকুরঘরে মা দুর্গার শাড়ি, এবারও বায়না হয়ে গিয়েছিল ঢাকির, এখন শুধুই ঘরভরা শূন্যতা-হাহাকার
Humayun Kabir : 'ছেলেকে দেখলেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে', এবার পুজোয় ঠাকুর দেখতেও যাবেন না তৃণমূলের এই বিধায়ক
'ছেলেকে দেখলেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে', এবার পুজোয় ঠাকুর দেখতেও যাবেন না তৃণমূলের এই বিধায়ক
Durga Puja 2024 : প্রতিমার সঙ্গে পুজো করা হয় তরবারিও,  পুরুলিয়ার জোড়বেড়িয়া রায় বাড়ির দুর্গাপুজো এবার ২৫৬ বছরে
শুধু প্রতিমা নয় এখানে প্রতিমার সঙ্গে পুজো করা হয় তরবারিও
Advertisement
ABP Premium

ভিডিও

RG Kar News: আর্থিক বেনিয়ম মামলায় পঞ্চম গ্রেফতারি সিবিআইয়ের, গ্রেফতার টিএমসিপি নেতা আশিস পাণ্ডেArjun Singh: জগদ্দলে তুমুল উত্তেজনা, অর্জুন সিংয়ের বাড়ির সামনে বোমাবাজি। ABP Ananda LIVEMadhya Pradesh:মধ্যপ্রদেশে বড়সড় ট্রেন দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা। রতলামে মালগাড়ির দুটি বগি লাইচ্যুতED Raid: দিল্লির একটি আর্থিক প্রতারণার মামলায় কলকাতার ৩ জায়গায় একযোগে তল্লাশি ইডির

ফটো গ্যালারি

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
পূর্ণ কর্মবিরতি থেকে সরে আসছেন চিকিৎসকরা ? ১০ ঘণ্টার মিটিং-শেষে বড় আপডেট
পূর্ণ কর্মবিরতি থেকে সরে আসছেন চিকিৎসকরা ? ১০ ঘণ্টার মিটিং-শেষে বড় আপডেট
'দুর্গাপুজো? সে তো অনেক খরচ' ! মেয়ে বলেছিল, 'সব পারব মা', ঘরভরা শূন্যতার মাঝে ডুকরে উঠলেন মা
ঠাকুরঘরে মা দুর্গার শাড়ি, এবারও বায়না হয়ে গিয়েছিল ঢাকির, এখন শুধুই ঘরভরা শূন্যতা-হাহাকার
Humayun Kabir : 'ছেলেকে দেখলেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে', এবার পুজোয় ঠাকুর দেখতেও যাবেন না তৃণমূলের এই বিধায়ক
'ছেলেকে দেখলেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে', এবার পুজোয় ঠাকুর দেখতেও যাবেন না তৃণমূলের এই বিধায়ক
Durga Puja 2024 : প্রতিমার সঙ্গে পুজো করা হয় তরবারিও,  পুরুলিয়ার জোড়বেড়িয়া রায় বাড়ির দুর্গাপুজো এবার ২৫৬ বছরে
শুধু প্রতিমা নয় এখানে প্রতিমার সঙ্গে পুজো করা হয় তরবারিও
Bihar flood: ক্রমশ ভয়াবহ হচ্ছে বিহারের বন্যা পরিস্থিতি
ক্রমশ ভয়াবহ হচ্ছে বিহারের বন্যা পরিস্থিতি
East Bengal FC: এক জয়েই ঘুরে দাঁড়াবে দল, জামশেদপুর ম্যাচের আগে আত্মবিশ্বাসী ইস্টবেঙ্গলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ
এক জয়েই ঘুরে দাঁড়াবে দল, জামশেদপুর ম্যাচের আগে আত্মবিশ্বাসী ইস্টবেঙ্গলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ
IPL 2025 Retention: কেবল ধোনি নন, আইপিএলের নিয়মে আসন্ন মরশুমে 'আনক্যাপড' টিম ইন্ডিয়ার হয়ে খেলা এই তারকারাও
কেবল ধোনি নন, আইপিএলের নিয়মে আসন্ন মরশুমে 'আনক্যাপড' টিম ইন্ডিয়ার হয়ে খেলা এই তারকারাও
RG Kar Protest: রাজ্য সরকারের পুজো অনুদান অস্বীকার আরও এক পুজো কমিটির
রাজ্য সরকারের পুজো অনুদান অস্বীকার আরও এক পুজো কমিটির
Embed widget