Mamata Banerjee: বাধ্য হয়েই সরে এলেন? লোকসভায় ‘একলা চলো’ নীতি মমতার
Lok Sabha Elections 2024: মমতার অভিযোগ, রাহুল যে বাংলায় আসছেন, জোটসঙ্গী হিসেবে একবারও তাঁকে তা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কংগ্রেস।
কলকাতা: সময় থাকতে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বললেও, সেভাবে সাড়া পাননি। তার পর জোট যাও বা হল, তাঁর কথাকে ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হচ্ছে না বলে বার বার অভিযোগ করছিলেন। তবে এবার আর শুধুমাত্র অভিযোগ-অনুযোগে থেমে থাকলেন না তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। I.N.D.I.A জোটে আসন সমঝোতা নিয়ে মতভেদের জেরে এবার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি। জানিয়ে দিলেন, সর্বভারতীয় স্তরে সময় বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় একাই লড়বে তৃণমূল (TMC) । জোটসঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে না। (I.N.D.I.A Alliance)
লোকসভা নির্বাচনের আগে, দ্বিতীয় পর্যায়ে 'ভারত জোড়ো'র আওতায় 'ন্যায় যাত্রা' নিয়ে বেরিয়েছেন কংগ্রেস (Congress) সাংসদ রাহুল গাঁধী (Rahul Gandhi)। দক্ষিণ থেকে উত্তরের পর এবার পূর্ব থেকে পশ্চিমে রওনা দিয়েছেন তিনি। পথে বাংলাও ছুঁয়ে যাওয়ার কথা রাহুল। আর ঠিক তার আগেই বাংলায় 'একলা চলো' নীতির কথা ঘোষণা করলেন মমতা। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন নিয়ে বিরোধের জেরেই এমন সিদ্ধান্ত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মমতা। সেই সঙ্গে কংগ্রেস সামান্য সৌজন্যটুকুও জানায়নি বলে জানিয়েছেন। (Lok Sabha Elections 2024)
মমতার অভিযোগ, রাহুল যে বাংলায় আসছেন, জোটসঙ্গী হিসেবে একবারও তাঁকে তা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কংগ্রেস। তাই মমতা বলেন, "আমার সঙ্গে কারও, কোনও কথা হয়নি। আমরা গোড়াতেই প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওরা প্রথম থেকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। তখনই দল সিদ্ধান্ত নেয়, বাংলায় একা লড়ব আমরা। আমি জোটের সঙ্গী। কিন্তু ওরা সৌজন্য দেখিয়েছি কি? একবারও জানিয়েছি কি যে, 'আপনার রাজ্যে আসছি?' বাংলার ব্যাপারে ওদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। জাতীয় স্তরে কী হবে, নির্বাচনের পরে ভাবব।"
তবে শুধু যে কংগ্রেসের সঙ্গে সমস্যা, তা-ই নয়, বিজেপি বিরোধী I.N.D.I.A জোটে থাকা নিয়ে CPM-এর সঙ্গে সমস্যার কথাও জানিয়েছেন মমতা। কয়েক দিন আগেই সেই নিয়ে মুখ খোলেন তিনি। তাঁকে বলতে শোনা যায়, "I.N.D.I.A জোটের নাম আমিই দিয়েছি। কিন্তু আমার বলতে কষ্ট হচ্ছে যে, মিটিংয়ে গেলে CPM মিটিং পরিচালনা করে, যাদের বিরুদ্ধে জীবন ভর লড়াই করেছি আমি। ওদের কোনও পরামর্শ মানব না আমি। আমাকে অনেক অসম্মান করা হয়। তার পরেও আমি বলেছি, আঞ্চলিক দলগুলি, যে যেখানে শক্তিশালী, তাদের উপর সেখানকার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হোক। বাকি ৩০০ আসনে আপনারা লড়ুন, আমি নিতে যাব না। কিন্তু ওরা কী বলে? বলে, 'আমাদের যা ইচ্ছে তা-ই করব'।"
২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধনের দিন কলকাতায় 'সংহতি মিছিলে' বেরিয়েও একজোটে কংগ্রেস এবং CPM-কে আক্রমণ করেন মমতা। জানান, যারা বড়া বড় কথা বলে, তাদের কেউ রাস্তায় নামার সাহস দেখায়নি। সর্বধর্ম সমন্বয়ের লক্ষ্যে সেই তিনি-ই পথে নেমেছেন। বিজেপি-র বিরুদ্ধে লডডার শক্তি এবং সাহস দুই-ই রয়েছে তাঁর। কিন্তু তাঁকে লড়াই করতে দেওয়া হচ্ছে না। তার পর মাঝে একদিনের ব্যবধান ছিল। বুধবার সটান বাংলায় একা লড়ার কথা জানিয়ে দিলেন মমত।
মমতার ঘোষণার পরই প্রদেশ কংগ্রেস এবং সিপিএম নেতৃত্ব মমতার বিরুদ্ধে কার্যত ফুঁসে উঠেছেন। তাঁদের দাবি, এমনটা হতে পারে বলে আগে থেকেই আঁচ করেছিলেন তাঁরা। ইডি-সিবিআই হানায় জেরবার হয়ে এই মুহূর্তে দিল্লিতে BJP নেতৃত্বকে খুশি করতেই জোটের হাত ছাড়ার সিদ্ধান্ত মমতার। শুধু তাই নয়, মমতা এবং তাঁর দল ফের কেন্দ্রে BJP-র হাত ধরতে পারেন বলেও মন্তব্য করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস এবং CPM নেতৃত্ব। কিন্তু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, একরকম বাধ্য হয়েই মমতা 'একলা চলো' নীতি নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে একাধিক যুক্তি উঠে আসছে। প্রায় তিন দশক আগে কংগ্রেস ছেড়ে এসে তৃণমূলের পত্তন করেছিলেন মমতা। আলাদা দল গড়ার পরও সনিয়া-রাহুলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় ছিল মমতার। বাংলায় বাম দুর্গ ভেঙে পড়লে, তৃণমূল এবং কংগ্রেস মিলেই বাংলায় জোট সরকার গড়ে, যার নেতৃত্বে ছিলেন মমতা। পরে সেই জোট ভেঙে গেলেও, গাঁধী পরিবার এবং জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে মমতার সম্পর্কে চিড় ধরেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে নামতে নামতে একেবারে শূন্যে পৌঁছে গিয়েছে কংগ্রেস। তার উপর আবার মমতার বিরোধিতা করতে গিয়ে CPM-এর সঙ্গে জোট গড়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। মমতার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে। আগে যে সৌজন্য বজায় ছিল, তা থেকে সরে এসে লাগাতার মমতাকে আক্রমণ করতে দেখা গিয়েছে অধীরকে, মাঝে মধ্যে তার জবাব দিয়েছেন মমতাও। সেই ফাটল ইদানীং কালে আরও চওড়া হয়েছে।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আগের থেকে আসন বাড়িয়ে তৃতীয় বারের জন্য বাংলায় ক্ষমতায় ফেরেন মমতা। তার পরই বিজেপি বিরোধী জোটের সলতে পাকানোর কাজে হাত দেন তিনি। নিজে থেকে ছুটে যান দিল্লি। দফায় দফায় সনিয়া, রাহুল, আনন্দ শর্মা, উদ্ধব ঠাকরে, উদ্ধব ঠাকরেদের সঙ্গে বৈঠক করেন। I.N.D.I.A জোটের বৈঠকেও বার বার আঞ্চলিক দলগুলিকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলে এসেছেন মমতা। যে দলগুলি যেখানে শক্তিশালী, সেখানে আসন সমঝোতায় তাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে জানিয়েছিলেন মমতা। বাংলায় যদি তৃণমূল হয়, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, বিহারে রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও সংযুক্ত জনতা দল, তামিলনাড়ুতে DMK, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা (উদ্ধব) এবং ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির কথা উঠে আসে মমতার মুখে। কংগ্রেস ৩০০ আসনে লড়ুক, কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলির ৭২টি আসনে কোনও হস্তক্ষেপ করা যাবে না বলে স্পষ্ট জানান মমতা। কিন্তু তাতে তীব্র আপত্তি জানান অধীর। মমতার দাবি, বাংলায় কংগ্রেস কখনও ১০টি, কখনও আবার ১২টি আসন দাবি করছে বাংলা। পাল্টা অধীরের দাবি, তাঁদের মাত্র ২টি আসন দিয়ে থামিয়ে দিতে চাইছেন মমতা, যা মানার প্রশ্ন ওঠে না।
আসন সমঝোতা নিয়ে এই মতবিরোধই বাংলায় জোট গড়ার ক্ষেত্রে তৃণমূল এবং কংগ্রেসকে পরস্পরবিরোধী মেরুতে এসে দাঁড় করিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল, যার দরুণই এদিন একা লড়ার কথা ঘোষণা করেছেন মমতা। তাহলে কি I.N.D.I.A জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন মমতা? উঠছে এই প্রশ্নও। মমতা স্পষ্ট করে কিছু জানাননি, বরং নির্বাচন মিটলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন। আপাতত বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই মন্তব্যেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন I.N.D.I.A জোটের শরিকরা। আগে বিজেপি-র সঙ্গে কেন্দ্রে জোট সরকারে ছিলেন মমতা। আবারও তিনি সেই পথে হাঁটবেন কিনা, উঠছে প্রশ্ন। তবে এখনও আশা হারাচ্ছেন না অনেকেই। কারণ বাংলায় প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছলেও, একদিন আগেও মমতার সঙ্গে 'ব্যক্তিগত সুসম্পর্কে'র কথা জানিয়েছেন রাহুল। কিছু দিন আগে জোটের বৈঠকে রাহুলেক নিজের 'প্রিয়' বলে উল্লেখ করেন মমতাও। তাই শেষ পর্যন্ত রাহুল-সনিয়া অথবা সম্প্রতি জোটের মুখ হিসেবে মমতা যাঁর নামের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেই মল্লিকার্জুন খড়্গেকেই সমঝোতায় এগিয়ে আসতে পারেন বলে আশা করছেন অনেকেই।