(Source: Poll of Polls)
গ্রিন মাফলার : যেন এক নীলকণ্ঠ, বিষ কণ্ঠে ধারণ করে প্রকৃতিকে করে বিষমুক্ত
কলমে ড: উৎপল অধিকারী
ধরুন আপনি কলকাতার উপকণ্ঠে কোনও এক বহু পুরনো কোঠা বাড়িতে গেছেন। গাছপালা ও জঙ্গলে ভর্তি এই বাড়িটার ভিতরে যখন আপনি প্রবেশ করবেন তখন কেমন একটা নিস্তব্ধ, গা ছমছমে ভাব আপনাকে গ্রাস করবে। অথচ তার চারপাশে কত কোলাহল, কত হট্টগোল, কত মানুষের কলরব। আপনি যদি সাহসী হন তাহলে এখানে বুক ভরে কিছুটা নির্মল বাতাস গ্রহণ করতে পারবেন। আপনার যদি গ্রামে বাড়ি হয় এবং বাড়ির চারপাশটা আপনি যদি সবুজ বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখেন, তাহলে আপনি যখন অফিস বা কাজ থেকে ক্লান্ত মনে বাড়ি ফিরবেন তখন সেই সবুজ আপনাকে আনন্দ প্রদান করবে এবং বাড়ির ভিতর মনে হবে যেন আপনি নিরিবিলিতে বাস করছেন। কেন এমন হয় ?
আদিম মানুষ প্রথমে জঙ্গলে বাস করত। পরে সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে তারা গাছ কেটে পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করে এবং ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তারা সবুজ জঙ্গল ভুলে কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে ফেলে। কিন্তু, দীর্ঘ সময় ধরে জঙ্গলে থাকার ফলে তাদের অবচেতন মনে জঙ্গল রয়ে গিয়েছে, তাই সবুজতা তাদের প্রশান্তি দেয়। এটি তো মনোজগতের ঘটনা। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, ঘন গাছপালার জঙ্গল কোনও স্থানের শব্দ দূষণ রোধ করে, বায়ু দূষণ হ্রাস করে। মাফলার একটি বিশেষ শীতের পোশাক যা আমাদের মাথা এবং কানকে বাইরের ঠান্ডা থেকে বাঁচায়। ঠিক তেমনই ঘন বৃক্ষরাজি বা জঙ্গল বা গুল্ম জাতীয় গাছ একত্রিতভাবে তৈরি করে গ্রিন মাফলার। এগুলি শব্দ দূষণ এবং বায়ুদূষণের হাত থেকে কেবলমাত্র আমাদের বাঁচায় তাই নয়, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ কমায়, অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায় এবং অগণিত উপকারী পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গের স্বাভাবিক বাসস্থান সৃষ্টি করে ও নান্দনিকতায় ভরিয়ে তোলে।
উচ্চ তীব্রতা এবং উচ্চ প্রাবল্যের কোনও শব্দ যদি মানুষের সহনশীল ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করে এবং তা মানবদেহে, প্রাণীজগতে এবং পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে থাকে তখন তাকে বলে শব্দদূষণ। এই শব্দ সাধারণত অবাঞ্চিত, কর্কশ এবং সুর বর্জিত। পৃথিবীতে নানা কারণে শব্দ দূষণ হতে পারে - যেমন যানবাহনের শব্দ, বাজি ফোটানোর শব্দ, কলকারখানার শব্দ এবং বিস্ফোরণজনিত শব্দ ইত্যাদি।
বিজ্ঞানী গ্রাহাম বেলের নাম অনুসারে শব্দ পরিমাপের একক হল ডেসিবেল। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যানবাহন জনিত দূষণের ৭০ ডেসিবেল বেঁধে দিয়েছে, ভারতে শিল্প ক্ষেত্রে বা কলকারখানা যুক্ত স্থানে আট ঘণ্টায় গড়ে ৯০ ডেসিবেল শব্দকে সর্বোচ্চ বলে গণ্য করা হয়েছে।
শব্দদূষণের প্রভাব পড়ে মানুষের শরীর ও মনে। প্রাণীজগৎ এবং সমগ্র পরিবেশের উপরও এর প্রভাব সুস্পষ্ট। শ্রুতিমধুর কোনও শব্দ আমাদের আনন্দের উদ্দীপনা তৈরি করে কিন্তু শ্রুতিকটূ কোনও শব্দ আমাদের মনে তিক্ততা ও বিষাদ আনে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা যদি উচ্চ প্রাবল্যের কোনও শব্দ শুনে থাকি, তাহলে আমাদের অন্তঃকর্ণে অবস্থিত ‘অর্গান অফ কর্টি যন্ত্র’কে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এর কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। এককালীন হঠাৎ কোনও শব্দ আমাদের শ্রবণ ক্ষমতার প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। একে অনেক সময় ‘নয়েজ ইনডিউসড হেয়ারিং লস’ও বলা হয়ে থাকে। যখন কোনও তীব্র শব্দ আমাদের ককলিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন তাকে বলা হয় তাকে ‘অ্যাকুইস্টিক ট্রমা’। এইসব ক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা দেড়শ ডেসিবেল বা তার ঊর্ধ্বে হতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে আমাদের হৃদযন্ত্রের ওপরও এর প্রভাব খুবই বাজে। এই শব্দদূষণ আমাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা যদি ৬০ ডেসিবেল বা তার ঊর্ধ্বে শব্দ শুনে থাকি, তাহলে আমাদের হৃদযন্ত্রের মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন হতে পারে। তীক্ষ্ণ শব্দ আমাদের ভেগাস স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এইভাবে চলতে থাকলে মানব মনের চাপ বৃদ্ধি পায় ও ডিপ্রেশন বা হতাশা মানুষকে গ্রাস করে। সিজোফ্রেনিয়া ও মানসিক বিকারও লক্ষ্য করা যেতে পারে। শব্দ দূষণের ফলে সৃষ্ট অনিদ্রা ও মধুমেহ মানুষের গড় আয়ু অনেকখানি কমিয়ে দেয়।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, শব্দদূষণের ফলে প্রাণীদেরও হতে পারে বধিরতা, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, মাতৃগর্ভে ভ্রুণের মৃত্যু ইত্যাদির মত ঘটনা। বাদুড়ের মতো নিশাচর প্রাণীরা ইকোলোকেশনের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উড়ে বেড়ায়। তারা উচ্চ প্রাবল্যের কোন শব্দ সৃষ্টি করে এবং সেই শব্দ সামনে কোন জায়গাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তাদের কানে এলে তারা বুঝতে পারে সামনে কোন বাধা আছে কি না। কিন্তু শব্দদূষণ এই ধরনের শব্দকে মাস্কিং করে। ফলে তারা স্বাভাবিকভাবে উড়তে পারে না। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ধাক্কা মারে ফলে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ভারত সরকার বর্তমানে গ্রিন মাফলার প্রকল্পটিতে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। দেখা গেছে, চার থেকে ছয় সারিতে যদি পরপর গাছ লাগানো হয়ে থাকে এবং তা যদি কোন ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল বা কোলাহলপূর্ণ কোনও শহর বা গ্রামকে ঘিরে রাখে তাহলে বাইরের শব্দ ওই অঞ্চলটিতে কম আসে। এটি তখন গ্রিন মাফলার হিসেবে কাজ করে। এই মাফলার নীলকণ্ঠের মতো শব্দদূষণ রূপ বিষকে শোষণ করে। ‘ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার’-এর মতে এই ধরনের মাফলার প্রায় ১০ ডেসিমেল শব্দের প্রাবল্য অথবা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শব্দদূষণ কমাতে পারে। আমাদের দেশের অতি পরিচিত দুটি গাছ হল অশোক এবং নিম গাছ। সাধারণত গ্রিন মাফলার তৈরিতে এই গাছ দুটি অবদান বিশেষ অনস্বীকার্য।
ভারত সরকার, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্নস্থানে গাছ লাগাচ্ছেন । এর মধ্যে হাইওয়ের ধারে গাছ লাগানো, ভার্টিকাল গার্ডেন তৈরি করা, গ্রিন ওয়াল তৈরি করা, আরবান ফরেস্ট্রি তৈরি করা, খণ্ডবন তৈরি করা, জলাভূমি সংরক্ষণ, গ্রিন করিডর তৈরি করা এবং রেলওয়ের পাশে গাছ লাগানো।
একটি গবেষণা পত্রে দেখানো হয়েছে, গ্রিন মাফলার শব্দদূষণ যেমন রোধ করে থাকে, তেমনি বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার বা ভাসমান কণার সংখ্যা ও কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ যথেষ্ট ভাবে হ্রাস করে। বাতাসের গুণগত মান পরিমাপের জন্য গবেষকেরা ভাসমান কণা এবং কার্বন মনোক্সাইডের সেনসার ব্যবহার করেন। গ্রিন মাফলার সৃষ্টি করতে যত বেশি গাছ লাগানো হবে ; তত বেশি বিষাক্ত ধোঁয়া, দূষণ ও ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ কমবে। বৃক্ষ নীলকন্ঠের মত সমস্ত বিষকে কন্ঠে ধারণ করে প্রকৃতিকে করবে বিষমুক্ত।
২০১৬ সালে রাও এম বিজয়া ভাস্কর এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগীরা কেস স্টাডি করে যে পেপারটি তৈরি করেন তার নাম ছিল ‘গ্রিন মাফলার: এ ন্যাচারাল বেরিয়ার এগেনস্ট এয়ার এন্ড নয়েজ পলিউশন’।
শব্দ দূষণ পরিমাপের জন্য তাঁরা সাউন্ড লেবেল মিটারস ব্যবহার করেন। তাঁরা ছয় মাস ধরে এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। শব্দ দূষণের মাত্রা প্রায় ১০.২ ডেসিবেল কম হয়েছে। তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছেন, যানজট বা ট্র্যাফিক জ্যাম জনিত কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণ এবং শব্দদূষণ গ্রিন মাফলারের জন্য যথেষ্ট মাত্রায় কম হয়েছে।
পরীক্ষাটি শেষে তাঁরা দেখেন, গ্রিন মাফলার ব্যবহারের ফলে বাতাসে ভাসমান কণার পরিমাণ ৩৪.৬ শতাংশ এবং কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ ২৭.৮% কমেছে।
আরও আছে। এই যে বিষ বাতাস দূষণের গ্রাসে দিল্লি সহ নানা শহর এখন ভারাক্রান্ত, গ্রিন মাফলার এই সংকট থেকেও প্রকৃতি ও মানুষকে সুরাহা দিতে পারে। প্রতিবছর শীতের শুরুতে দিল্লি ও কলকাতার মত মেট্রোপলিটন শহরগুলি দূষণের কবলে পড়ে। এই সময় দিল্লি হয়ে ওঠে কার্যত গ্যাস চেম্বার। হরিয়ানা, চণ্ডীগড় এবং কলকাতার উপকণ্ঠের চাষ জমিতে নাড়া পোড়ানো ও অন্যান্য কারণে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস ঢেকে দেয় এই অঞ্চলগুলিকে। এর ফলে অগণিত মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে ও হাঁপানি রোগীদের মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যায় বহুগুণ। দিল্লিতে সরকার গ্র্যাপ ফোর চালু করেছে ইতিমধ্যেই। লাগু হয়েছে নানা নিয়মকানুন। বাড়ি থেকে কাজ। বাড়ি থেকে প্রয়োজন ছাড়া বেরোতে নিষেধ করা হয়েছে। এই অবস্থায় মূলত শব্দদূষণের প্রকোপ কমানো ছাড়াও গ্রিন মাফলারের মত প্রকল্পের কার্যকারিতা অপরিসীম। প্রকৃতিকে মনুষ্যসৃষ্ট এই সমস্ত রোগ থেকে মুক্ত করতে গ্রিন মাফলারের জুড়ি নেই। বেশি গাছ তাই কম দূষণ। অতএব, সবার এগিয়ে আসা জরুরি।
লেখক পূর্ব বর্ধমানের আঝাপুর হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত লেখকের নিজস্ব।