Shankha Ghosh Death : ...তবুও ভাবি আরো একবার দেখা হয়ে যাবে ঠিক
বাংলা হারাল যে কোনও সঙ্কটকালে গর্জে ওঠা এক কলম ...
'' অন্ত নিয়ে এতটা ভেবো না।
মৃত্যুপথে যেতে দাও
মানুষের মতো মর্যাদায় —-শুধু
তোমরা সকলে ভাল থেকো।''
'' যাবার সময় বলেছিলেন '' কবিতায় লিখে গিয়েছিলেন তিনি । আড়ম্বর চাননি মৃত্যুর পর। চাননি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে। বাড়িতেই ছিলেন। চলেও গেলেন নীরবেই। করোনা অতিমারীর মধ্যে। সকলকে ভালো রাখতে, ভালো ভাবে দেখতে চাওয়া মানুষটির প্রয়াণে অভিভাবকহারা হল বাংলা সাহিত্য জগত। বাংলা হারাল যে কোনও সঙ্কটকালে গর্জে ওঠা এক কলম। সরকার চাইলেও তাই তাঁর পরিবারের মানুষ চাইলেন না গান স্যালুটে বিদায়। করোনা বিধি মেনে নিমতলা শ্মশানে দাহকাজ সারা হবে বর্ষীয়াণ কবির।
জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতা-যুগের পাঁচ নক্ষত্র ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, উত্পল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার। বাকি চার জন চলে গিয়েছিলেন আগেই । চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষও। খালি করে দিয়ে গেলেন বাংলা সাহিত্য - সমাজের অভিভাবকের স্থান।
তাঁর প্রয়াণে শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্য জগত নয়, সামগ্রিক ভাবেই সমাজের ক্ষতি, বললেন শোকস্তব্ধ বিভাস চক্রবর্তী। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এল এক প্রতিবাদী ঋজু চরিত্র, দৃঢ় চেতা মানুষের কথা। বিভাস বললেন, '' উনি আমাদের কাছে শুধু অধ্যাপক বা সাহিত্য জগতে শীর্ষ ব্যক্তিত্ব নন, বিভিন্ন সঙ্কটে এগিয়ে এসেছেন, সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন, কবিতা লিখেছেন। বিভিন্ন সঙ্কটকালে ওর লেখা প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুঝতে সাহায্য করেছেন। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় উনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। উনি যেভাবে নাটকের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন, বিশেষত রবীন্দ্র নাটকের, তা তুলনাবিহীন। ''
বিগত বাম জমানায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কাণ্ডের প্রতিবাদে যাঁদের ধারাবাহিক ভাবে আন্দোলনের রাস্তায় দেখা গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। শঙ্খ ঘোষ বাংলা আকাদেমির সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন সেই সময় । জাতির বিবেক ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, বর্ষীয়াণ কবির প্রয়াণে ভেঙে পড়ে বললেন জয় গোস্বামী। স্বভাব লাজুক, অথচ প্রত্যয়ে দৃঢ়, প্রতিবাদী। এভাবেই শঙ্খ ঘোষকে চিনতেন আপামর বাঙালি। 'যে কোনও অভিঘাতই সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না, ওঁর চলে যাওয়া এই মুহূর্তের দেশের কত বড় ক্ষতি তা এই মুহূর্তে হয়ত বোঝা যাচ্ছে না। শঙ্খ ঘোষ চলে যাওয়ায় দেশটা ফাঁকা হয়ে গেল। ' বললেন কবি শ্রীজাত।
তাঁর থেকে বয়সে অল্প কিছুটা ছোট নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। তাঁর স্মৃতিচারণায় শঙ্খ ঘোষ ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁর মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ের গুণগুলি ছিল। অনুজদের প্রতি তিনি কতটা স্নেহপ্রবণ ছিলেন, তা ফুটি উঠল তাঁর স্মৃতিকথায়। রুদ্রপ্রসাদ বললেন, ' একবার পাশাপাশি বসে নাটক দেখছিলাম। শরীর ভাল ছিল না। চুপ করে বসে ছিলাম। কীকরে জানি না বুঝে গেলেন। হাত টা ধরে জিগ্যেস করলেন। মনে হল দুরারোগ্য ব্যাধির সময় মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ।'
১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্ম তাঁর। তত্কালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। স্বভাব লাজুক, অথচ প্রত্যয়ে দৃঢ়, প্রতিবাদী। এভাবেই শঙ্খ ঘোষকে চিনতেন আপামর বাঙালি। কর্মজীবনে বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। পড়িয়েছেন বিশ্বভারতী ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়েও। পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ, সাহিত্য অ্যাকাডেমি-সহ একাধিক পুরস্কার। পেয়েছেন দেশিকোত্তম, পদ্মভূষণ সম্মান। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল, বাবরের প্রার্থনা, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ধুম লেগেছে হৃদকমলে, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, মূর্খ বড় সামাজিক নয়, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, এ আমির আবরণ।
১৯৭৭ সালে বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ধুম লেগেছে হৃদকমলে কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৮৯ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার।
১৯৯৯ সালে কন্নড় ভাষায় লেখা নাটক অনুবাদের জন্য দ্বিতীয়বার সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মান পান। ১৯৯৯ সালে দেশিকোত্তম সম্মানে ভূষিত করা হয়। ২০১১ সালে পান পদ্মভূষণ সম্মান। ২০১৬ সালে পান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।
কবি লিখেছিলেন .....'' না-পারার যত অপরাধভার নিয়ে
যোজন যোজন হেঁটে গেছি ভ্রামনিক--
জন্মান্তর মানি না, তবুও ভাবি
আরো একবার দেখা হয়ে যাবে ঠিক '' সেই একই সুর ধ্বনিত হল তাঁর সমসাময়িক ঘনিষ্ঠ বিদ্বজনদের গলায়।