Europe Tour : বিঠোভেনের শহর, রামধনু রং, ঘুমের ওপারে নতুন দেশ...
১৭৭০ থেকে ১৮২৭ এই তাঁর জীবৎকাল। সে সময়ের একটা বাড়ি আজও কত সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত। দেশ বিদেশের মানুষ আসছেন এমন এক ক্ষণজন্মা স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাতে।
২৪ মার্চ, ২০২৩
আজ কিছুটা দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি। তারপর সেই লোভনীয় প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। প্রথমেই রাইনের ধারে গিয়ে সৌম্যজিৎ একটা গানের শ্যুটিং করল। তারপর তাদের সঙ্গী হল ব্যান। শ্যুটিং পর্ব সেরে আমরা সোজা ট্রাম ধরে বনের উদ্দেশে রওনা দিলাম। বন হল বিঠোভেনের শহর। শহরের পথে খানিক হাঁটলেই বোঝা যায় ছোট শহর, কিন্তু বেশ হাই প্রোফাইল। ম্যাপ দেখে যখন হেঁটে চলেছি আশপাশে নামিদামি ব্রান্ডের দোকান। পড়ন্ত রোদে গা এলিয়ে রেস্তোরাঁয় ভিড়। বাড়িঘর, স্টেশন, পোস্ট অফিস, চার্চ, ক্যাথিড্রাল, সবই বেশ নজরকাড়া। তুলনামূলক একটা সরু রাস্তায় বিঠোভেনের জন্মস্থান। সেখানেই সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে। অনেকেই হয়ত জানেন বিঠোভেন জীবনের একটা বড় সময় কানে শুনতে পেতেন না। বধির অবস্থাতেই তিনি একের পর এক অনবদ্য কম্পোজিশন তৈরি করে গেছেন। তাঁর ব্যবহৃত নানা বাদ্যযন্ত্র, তাঁর লেখা নোটেশনের খাতা আজও ছুঁয়ে দেখা যায় এই সংগ্রহশালায়। শোনা যায় তাঁর সৃষ্ট সুরের ধারা।
ছোটবেলায় প্রথম ইন্টারকমের মধ্যে একটা সুর শুনেছিলাম। যে সুরটা মনে গেঁথে ছিল। মাঝে মাঝেই গুনগুন করতাম। পরে বেশ কিছু বাড়ির লিফটে একই সুর বাজবে শুনে চমকে উঠি। অনেক পরে জেনেছিলাম সে সুরটার নাম ‘ফুরে লিজা’- স্রষ্টা বিঠোভেন। ১৭৭০ থেকে ১৮২৭ এই তাঁর জীবৎকাল। সে সময়ের একটা বাড়ি আজও কত সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত। দেশ বিদেশের মানুষ আসছেন এমন এক ক্ষণজন্মা স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাতে। বেরিয়ে দেখি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভেজা পথের ধারেই চুটিয়ে গান করছেন একদল মানুষ। তাঁদের প্রাণশক্তি যেন গানের মধ্যে দিয়ে আশপাশের মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে। পথের ধারে আমরাও বেশ কিছুক্ষণ গান শুনলাম, খেলাম। ফিরতি ট্রামে চড়ে যখন কোলন ফিরছি তখন আকাশে এক আশ্চর্য রামধনুর উদয় হল। সে রামধনুর দু'প্রান্তই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কী উজ্জ্বল তার রং। আমার স্বল্প জীবনে বঙ্গদেশে কখনো এমন আকাশ জোড়া রামধনু দেখিনি। আনন্দে ট্রাম থেকে নেমেই পড়লাম সবাই মিলে। রাইনের ধারে সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি তো হলোই, মনের ক্যামেরাতেও তা চির বন্দী হয়ে রইল। বাড়ির পথে ফুরে লিজার সুর তখনো কানে বাজছে।
২৫ মার্চ, ২০২৩
খুব ভোরে উঠে রওনা দিতে হল। প্রচুর অ্যান্টিক কেনার ফলে লাগেজও বেড়েছে। ব্যান এবং নানা দুজনে দুটো গাড়ি নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রস্তুত হয়ে আমাদের সবাইকে পৌঁছে দিলো কোলন স্টেশনে। আজ আমাদের হামবুর্গ যাওয়া। জার্মান ফোক রকস্টার স্টেফান স্টপক তার সঙ্গীত জীবনের ৩০ বছর পূর্তিতে এক কনসার্ট আয়োজন করেছেন। সেখানেই আমন্ত্রিত হয়ে গাইবে সৌম্যজিৎ সঙ্গে সৌরেন্দ্র।
ট্রেন থেকে নেমে আমরা সোজা পৌঁছে গেলাম অনুষ্ঠান মঞ্চে। মঞ্চের আবহ অনেকটা ফ্যাকট্রি শেডের মত। রক কনসার্টের প্রস্তুতি দেখে আমরা হোটেলে চলে গেলাম। আজ শুধুই অনুষ্ঠান। কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে সেজেগুজে আবার বিকেলে আমরা হাজির হলাম অনুষ্ঠান মঞ্চে। গ্রিনরুমে এলাহি খাবার আয়োজন। খেয়ে, সাউন্ড চেক করে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কনসার্ট শুরু হল। রক কনসার্ট। তাই দর্শকরা সবাই দাঁড়িয়ে দেখছেন। হলের প্রতিটা কোনা শুধু মাথা আর মাথা। গান চলতে লাগলো। সৌরেন্দ্র- সৌম্যজিতের ডাক পড়ল কিছুটা পরে। ওরা মঞ্চে উঠতেই কয়েক হাজার জার্মান শ্রোতা উৎসাহে চিৎকারে হাততালিতে ফেটে পড়লেন। আমি মঞ্চের ছবি তোলার চাইতেও যেন চারপাশের মানুষের আনন্দে ভেসে যাচ্ছিলাম। দর্শক হিসেবে তো দেখলামই, ক্রু হিসেবেও দেখলাম মঞ্চের পিছনে কী অসম্ভব ডিসিপ্লিন। যে যার কাজ নিঃশব্দে করে চলেছে। কাউকে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করতে হচ্ছে না। অথচ সবাই হাসিমুখে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। জার্মানদের থেকে এই ডিসিপ্লিন প্রতিটি মানুষের শেখা প্রয়োজন। রাতেই আমাদের বাস হামবুর্গ থেকে। মাঝরাতে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে যখন বাসে উঠলাম তখন রাত সোয়া একটা। রাত ঘুমের ওপারে নতুন দেশ অপেক্ষা করে রয়েছে।
আরও পড়ুন : ব্রিজের গায়ে অজস্র তালা ঝোলানো, ভালবাসার প্রতীক
চলবে...