এক্সপ্লোর

Independence Day Exclusive: চশমাটা মৃত্যুর পরে নিও, ফাঁসির মঞ্চে হোঁচট খেলে ভাববে ভয় পাচ্ছি, দাদাকে বলেন কানাইলাল

Freedom Fighter Kanailal Dutta: কানাইলাল দত্ত। বাংলা থেকে শুরু করে গোটা ভারতবর্ষে যিনি বিপ্লবের বীজ বপণ করেছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার শপথ পালন করার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হননি।

চন্দননগর: ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘দ্বাপরে কানাই ছিল নন্দের নন্দন, কলিতে তাঁতির কুলে দিলা দর্শন, তাহারে ছলিয়াছিল অক্রুর গোঁসাই, গোঁসাইকে কানাই দিল বৃন্দাবনে ঠাঁই, গোঁসাই হল গুলিখোর কানাই নিল ফাঁসি, কোন চোখে বা কাঁদি বল কোন চোখে বা হাসি’।

কানাইলাল দত্ত। বাংলা থেকে শুরু করে গোটা ভারতবর্ষে যিনি বিপ্লবের বীজ বপণ করেছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার শপথ পালন করার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হননি। মৃত্যুর ১১০ বছর পরেও কানাইলাল দত্তের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় গোটা দেশে।

ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন। অধুনা হুগলির চন্দননগরের ছবিটা কিন্তু বেশ আলাদা ছিল। সেখানে তখন ফরাসি উপনিবেশ। যে কারণে গঙ্গার তীরের এই শহরের নাম ছিল “ফরাসডাঙ্গা”। ১৮৮৮ সালের ৩০ অগাস্ট চন্দননগরের সর্ষেপাড়ার মোড়ে মামার বাড়িতে ভোর পাঁচটায় জন্ম হয় কানাইলালের। দিনটি ছিল জন্মাষ্টমী। সেই কারণেই কানাইলাল নামকরণ।

চন্দননগরের জিটি রোডের ওপর সেই বাড়িটির যদিও এখনও ভগ্নপ্রায় দশা। কানাইলালের জন্মভিটে বললে সকলে একবাক্যে খয়েরি রংয়ের বাড়িটির হদিশ দিয়ে দেন। সেই বাড়িতে এখনও কানাইলালের মা ব্রজেশ্বরী দেবীর বংশধরেরা থাকেন। বাড়িটির লাগোয়া রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে কানাইলাল অ্যাভিনিউ। জিটি রোডের একেবারে সামনের একটি ঘরে রয়েছে বরেণ্য বিপ্লবীর আবক্ষমূর্তি। বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়ছে। মূর্তির পাশে জমেছে ঝুল। তবু, রোজ কানাইলালের জন্মভিটে দেখতে আসেন উৎসাহীরা।

চন্দননগরেই কেটেছে কানাইলালের শৈশব, কৈশোর। তাঁর বাবা চুনীলাল দত্ত কর্মসূত্রে ছিলেন মহারাষ্ট্রে। একটু বড় হওয়ার পর কানাইলালও পাড়ি দেন বাবার কাছে। ১৯০৩ বা ১৯০৪ সালে তিনি চন্দননগরে ফেরেন। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ডুপ্লে স্কুলের পরে নামকরণ হয় কানাইলাল বিদ্যামন্দির। চন্দননগর স্ট্র্যান্ড লাগোয়া সেই স্কুলে রয়েছে কানাইলালের আবক্ষমূর্তি। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালিত হয় স্কুলে।

চন্দননগরে ফিরেই কানাইলাল দেখা করেছিলেন তাঁর শিক্ষক চারুচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। গোটা চন্দননগর জুড়ে তখন বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু হয়েছে। গোপনে তরুণ বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করছিলেন চারুচন্দ্র। তাঁর তত্ত্বাবধানেই কানাইলালের বেড়ে ওঠা।

কীভাবে ব্রিটিশ বিরোধী স্রোত বইতে শুরু করল গঙ্গাপাড়ের এই শহরে? ইতিহাস বলছে, ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত ৬ বছর চন্দননগর দখল করে রেখেছিল ব্রিটিশরা। মন্দির, মসজিদ ও গির্জা ছাড়া শহরের সব বড় বাড়ি, এমনকী, ইন্দ্রনারায়ণের প্রাসাদ পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। ফরাসি ও শহরের পুরনো বাসিন্দাদের আটক করে অত্যাচার চালিয়েছিল। মোট চারবার চন্দননগর দখল করেছিল ব্রিটিশ সেনা। তাই ব্রিটিশদের প্রতি চন্দননগরের মানুষের তীব্র ঘৃণা জন্মেছিল।

সেই সূত্র ধরেই চন্দননগরে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ শুরু। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে একের পর এক অগ্নিপুরুষের জন্ম এই শহরে। মোতিলাল রায়, কানাইলাল দত্ত, পরে রাসবিহারী বসু জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটান চন্দননগরে। চন্দননগর তখন ব্রিটিশ পুলিশের নজর এড়িয়ে আত্মগোপন করার একটা বড় আশ্রয়স্থল। জনশ্রুতি হচ্ছে, ১৯০৪ সালে বিজয়াদশমীর দিন সন্ন্যাসীর বেশে চন্দননগরে আসেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের ভাই তথা যুগান্তর দলের কর্ণধার বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। অন্যদিকে মোতিলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, রাসবিহারী বসু, সাগরকালী ঘোষের মতো কয়েকজন অভিন্নহৃদয় বন্ধু মিলে সৎপথালম্বী সম্প্রদায় বলে একটি দল গড়ে তুলেছিলেন। যাঁদের কাজ ছিল দেশপ্রেমের প্রচার, পুণ্যার্থীদের সাহায্য, শরীরচর্চা, দুঃস্থদের সাহায্য করা। পাশাপাশি তাঁরা জাতীয়তাবাদী কথাবার্তাও বলতেন। সেই সময় বাগবাজারে চারুচন্দ্র রায় একটি দল তৈরি করেছিলেন। পাশাপাশি গোন্দলপাড়ায় একটি দল তৈরি করেছিলেন বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে এই শহরেই তিনটি বিপ্লবী আন্দোলনের যোগসূত্র তৈরি হয়। যুগান্তর, অনুশীলন সমিতি ও চন্দননগরের নিজস্ব দল। কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট যাকে তাঁর রিপোর্টে চন্দননগর গ্যাং বলে উল্লেখ করেন। কানাইলালও যোগ দেন সেই চন্দননগর গ্যাংয়ে, চারুচন্দ্রের নেতৃত্বে।

তবে কিছুদিন পরে অস্থিরতা গ্রাস করতে শুরু করে কানাইলালকে। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক হত্যা সংগঠিত করা। কিন্তু দলের একের পর এক পরিকল্পনা ব্যর্থ হচ্ছে। কানাইলাল উপলব্ধি করেন, পলিটিক্যাল মার্ডার সফল না হলে সশস্ত্র বিপ্লবের ওপর থেকে দেশবাসীর আস্থা উঠে যাবে। মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি।

বিপ্লবী বারীন ঘোষের সঙ্গে কথা বলে তিনি কলকাতায় চলে এসেছিলেন। চারুচন্দ্র রায় অবশ্য সে খবর জানতেন না। বারীন ঘোষের দলের সঙ্গে কলকাতায় বোমা তৈরির কাজে যোগ দেন কানাইলাল। ১৯০৮ সালের ২ মে। উত্তর কলকাতার ১৫ নম্বর গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে মানিকতলা বোমা মামলায় অস্ত্র আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন কানাইলাল। পরে আলিপুর বোমা মামলায় তাঁর নাম জড়িয়ে যায়। কানাইলালের সঙ্গেই গ্রেফতার হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী বা নরেন গোঁসাই।

নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ছিলেন শ্রীরামপুরের বাসিন্দা। তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। পুলিশের কাছে তিনি রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে যান। পুলিশের কাছে তাঁর দেওয়া এজাহার আদালতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করতে হতো। আর তা হলে অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ-সহ একাধিক বিপ্লবীর ফাঁসি হয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। কানাইলাল ও তাঁর সঙ্গেই গ্রেফতার হওয়া সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঠিক করেন, যে করেই হোক আদালতে কিছু বলার আগেই নিকেশ করতে হবে নরেন গোঁসাইকে।

সেই সময় জেল ভাঙার একটা পরিকল্পনাও তৈরি হয়েছিল। ঠিক হয়, চারজন বন্দি জেল ভেঙে পালাবেন। সেই চারজনের মধ্য়ে একজন হলেন কানাইলাল। কিন্তু তিনি বেঁকে বসেন। জেল ভেঙে পালানোয় তাঁর সায় ছিল না। কারাগারে অরবিন্দ ঘোষ ততদিনে নিজেকে একটু আলাদা করে নিয়েছেন। তিনি ধ্যানে মগ্ন, তাঁর মননে তখন আধ্যাত্মিকতার বিরাজ। কানাইলালের অবশ্য সেসবে আগ্রহ নেই। ধ্যান বা গীতাপাঠের রাস্তায় হাঁটেননি। তিনি ছোট থেকেই দস্যি। জেলেও তার অন্যথা হয়নি। এমনকী, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জেলেও তিনি মজা, খুনসুটিতে মগ্ন। কখনও বন্দিদের ধুতির খুঁট বেঁধে দিচ্ছেন, তো কখনও বিস্কুট চুরি করে খাচ্ছেন।

কানাইলাল ঠিক করেন, আদালতে হাজিরা দেওয়ার আগে নরেন গোঁসাইকে হত্যা করবেন তিনি। বয়সে তাঁর চেয়ে সামান্য বড় সত্যেন্দ্রনাথ বসু জানান, তিনিও থাকবেন কানাইলালের সঙ্গেই।

জেলে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় রিভলভার। কেউ কেউ বলেন, কাঁঠালের ভেতরে নাকি রিভলভার রেখে দেওয়া হয়েছিল। কানাইলাল নিজে অবশ্য রহস্য উন্মোচন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ক্ষুদিরাম বসুর ভূত এসে নাকি তাঁকে রিভলভার দিয়ে গিয়েছিল! ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। আর কানাইলালের ফাঁসি হয় ওই বছরেরই ১০ নভেম্বর।

নরেন গোঁসাইকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে অসুস্থতার ভান করে জেল হাসপাতালে ভর্তি হন সত্যেন্দ্রনাথ। তার তিনদিন পরে পেটে যন্ত্রণা হওয়ার অভিনয় করে হাসপাতালে ভর্তি হন কানাইলালও। শোনা যায়, জেল হাসপাতালের এক চিকিৎসক তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি দুজনকেই ভর্তি করে নেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বিছানার মধ্যে লুকিয়ে রিভলভার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে পুলিশি তল্লাশি হতো না। সত্যেন্দ্রনাথের তাই রিভলভার লুকিয়ে রাখতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু কানাইলালের কাজটা সহজ ছিল না। পুলিশের এক সার্জেন্ট, হিগিন্স তাঁকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখতেন। শোনা যায়, কানাইলাল তাঁর জামার ভেতরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রিভলভার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ততদিনে কানাইলাল আর এক মোক্ষম চাল চেলেছেন। পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনিও রাজসাক্ষী হতে চান। তিনি নরেন গোঁসাইয়ের চেয়েও বেশি তথ্য জানেন বলে পুলিশকে আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে বলেন, সত্যেন্দ্রনাথকেও তিনি রাজসাক্ষী হতে রাজি করাবেন। ব্রিটিশ সরকার যা শুনে খুব প্রসন্ন হয়। একদিন সকালে হাসপাতালে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পাঠানো হয় নরেন গোঁসাইকে।

সেই সময়কার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর পুলিশের কাছে জমা দেওয়া এজাহার অনুযায়ী, নরেনকে সামনে পেয়ে বিছানার ওপর বসে বালিশের তলা থেকে রিভলভার বার করে গুলি চালান সত্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু সেই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। নরেন ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, গোটাটাই পরিকল্পিত। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল হিগিন্স। তাঁকে ডাকার চেষ্টা করে নরেন। ততক্ষণে কানাইলালও গুলি চালিয়েছেন। নরেনের পিঠে যা বিঁধে যায়। পালানোর চেষ্টা করেন নরেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল হাসপাতালে তাঁকে ধাওয়া করেন কানাইলাল ও সত্যেন্দ্রনাথ। হিগিন্স সত্যেন্দ্রনাথকে জাপ্টে ধরে ফেলেন। সেখানেও দামাল কানাইলাল। হিগিন্সের তলপেট লক্ষ্য করে লাথি মারেন তিনি। মাটিতে ছিটকে পড়েন দুঁদে পুলিশ অফিসার। নরেনের পিছনে ধাওয়া করেন কানাইলাল ও সত্যেন্দ্রনাথ। ফের গুলি চালান কানাই। নর্দমার মধ্যে পড়ে যান নরেন।

ইতিহাসবিদ, চন্দননগরেরই বাসিন্দা অধ্যাপর বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “জেলকর্মীদের বয়ান অনুযায়ী, সেই সময় নরেন গোঁসাই নাকি বলে উঠেছিলেন, ‘তিন বাপ, তিন বাপ, তিন বাপ।’ সম্ভবত, শরীর ফুঁড়ে তিনটি বুলেট ঢুকে যাওয়ার কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি। কানাইলালের রিভলভারে তখনও দুটি গুলি অবশিষ্ট ছিল। সেই দুটিও নরেনের শরীর লক্ষ্য করে চালিয়ে দেন কানাইলাল। তারপরই পুলিশকে বলেন, ‘অ্যারেস্ট মি।’ পরে তাঁকে বলা হয়েছিল, ক্ষুদিরামের সঙ্গী প্রফুল্ল চাকি তো নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন, তিনি কেন সেই পথে হাঁটলেন না? কানাইলাল জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি পলিটিক্যাল মার্ডার সফল করতে চেয়েছিলাম। এত ব্যর্থ হচ্ছিলাম। একটা সফলতা রাখতে হবে। আমি জানি আমার ফাঁসি হবে। কিন্তু সেটাই আমি চাই।“

বিশ্বনাথ আরও বলছেন, “মামলা চলাকালীন কানাইলালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর দাদা আশুতোষ দত্ত। কানাইলাল বলেছিলেন, ‘মাকে এখানে এনো না। সহ্য করতে পারবে না।’ নব্বইয়ের দশকে প্রয়াত হন আশুতোষ। তিনি নিজেই এই ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন।“

শিবনাথ শাস্ত্রী জেলে আরেক মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ সত্যেন্দ্রনাথকে মৃত্যুর আগে প্রস্তুত করার ব্যাপার ছিল। তখনও কানাইলাল জীবিত। তাঁর গারদের পাশ দিয়েই যেতে হয়েছিল শিবনাথকে। জেল থেকে ফিরে তিনি লেখেন, ‘কানাইকে দেখিলাম। পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মতো পায়চারি করিতেছে। বহু যুগ তপস্যা করিলে তবে কেউ ওকে আশীর্বাদ করার পুণ্য অর্জন করিবে।’

মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ার পর পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তবে সেই রাস্তায় হাঁটেননি কানাইলাল। তাঁকে আইনজীবী বলেছিলেন, আপনি আপিল করুন। এটা তো নিম্ন আদালত। এরপর হাইকোর্ট আছে, সুপ্রিম কোর্ট আছে, প্রিভি কাউন্সিল আছে, তোমাকে আমরা বার করে আনব। কানাইলাল বলেছিলেন, ‘দেয়ার শ্যাল বি নো অ্যাপিল।’ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘ওহে, কানাই শিখিয়ে দিয়ে গেল কোথায় শ্যাল ব্যবহার করতে হয়, আর কোথায় উইল।’

মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত হাসিঠাট্টায় মেতে ছিলেন কানাইলাল। এক পুলিশ অফিসার তাঁকে কটাক্ষ করেছিল, কাল তো তোমার ফাঁসি, দেখব এত হাসি কোথায় যায়! দমেননি কানাইলাল। তাঁর চোখে ছিল হাইপাওয়ারের মোটা কাচের চশমা। মৃত্যুর আগে জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন দাদা আশুতোষ। বলেছিলেন, ‘তোর চশমাটা দে। একটা কিছু তো আমার কাছে রাখি।’ কানাইলালের জবাব, ‘দাদা, চশমাটা আমি এখন দিতে পারব না। চোখে হাইপাওয়ার তো। ফাঁসির মঞ্চে যদি হোঁচট খাই, এরা ভাববে বাঙালির ছেলে আমি মৃত্যুর আগে ভয় পাচ্ছি। চশমাটা আমার মৃত্যুর পরে নিও।’

ইতিহাসবিদ বিশ্বনাথ বলছেন, “কানাইলালের বড়দাদা তাঁর নাতনি শর্বরী বসুকে বলেছিলেন, পরে তিনি আমাকে বলেন, কানাইলালের গলায় দড়ি পরিয়ে দেওয়ার পর তিনি একজন পুলিশকে ডেকে বলেছিলেন, মৃত্যুর পর চশমাটা আমার বড়দাদাকে দিয়ে দিও। সেই চশমাই কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে রাখা রয়েছে। শোনা যায়, কানাইলালের গলায় দড়ির ফাঁস ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। সেই কারণে তাঁর মৃত্যু হতে দেরি হয়।“

মৃত্যুর সময়ও কানাইলালের তেজ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ আধিকারিকেরা। পুর্ণচন্দ্র দে, সাগরকালী ঘোষ, মোতিলাল রায়, আশুতোষ দত্তরা তাঁর মৃতদেহ নিতে যাওয়ার পর তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাদের দেশে এরকম ছেলে ক’টা আছে!

কানাইলাল বলে গিয়েছিলেন, আমার মৃত্যুর পর দেহ নিয়ে শোক নয়, শোভাযাত্রা কোরো। যাতে সকলে অনুপ্রাণিত হয়। হয়েওছিল তাই। ১০ নভেম্বর, ১৯০৮। সে এক অবিস্মরণীয় দিন। আলিপুর জেল থেকে কানাইলালের মরদেহ বেরতেই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে রাজপথ কার্যত অবরুদ্ধ। জনতার বাঁধভাঙা আবেগ। ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত শেষযাত্রায় সামিল অসংখ্য মানুষ।

সেই ভিড় ব্রিটিশ শাসকদের এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিল যে, কানাইলালের মৃত্যুর পর নিয়ম করে দেওয়া হয়, কোনও বিপ্লবীর মরদেহ তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে না। শেষকৃত্য হবে পুলিশের প্রহরায়। যে কারণে কয়েকদিন পরেই সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ফাঁসির পর মরদেহ পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হয়নি।

কানাইলালের শেষ ইচ্ছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কানাইলাল বলেছিলেন, ‘মাকে এনো না। আর আমার দেহ নিয়ে জাঁকজমক করে শোভাযাত্রা কোরো। হাজার হাজার লোক দেখবে, অনুপ্রাণিত হবে।’ ব্রিটিশ পুলিশ লিখেছিল, শুধু কলকাতাতেই দশ হাজার লোকের জমায়েত হয়েছিল। সারা দেশে লক্ষাধিক মানুষ জড়ো হয়েছিল। প্রায় সব বাড়িতে সেদিন অরন্ধন।

তাঁর এক আত্মীয় মহামায়া দিন্দা নিজের বইয়ে লিখেছিলেন, ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময়ও কানাইলালের একটা ভূমিকা ছিল। বাড়ির মেয়েদের বিদেশি চুড়ি ভেঙে ফেলতে বলেছিলেন।

কোনও ধর্মীয় চিহ্ন তাঁর বিপ্লব চেতনায় প্রভাব ফেলতে পারেনি। সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে মিশতেন। সব শ্রেণির মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। গরিব মানুষের সঙ্গে নাড়ির যোগ। কলেরার সময় বস্তিতে দিনরাত এক করে কাজ করতেন। অসহায় মানুষ তাঁর বন্ধু। লাঠিখেলা জানতেন খুব ভাল। ছকভাঙা রাস্তায় হেঁটেছিলেন বলেই মৃত্যুর এত বছর পরেও ঔজ্জ্বল্য কমেনি কানাইলালের। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে রয়েছে তাঁর নাম।

তথ্যসূত্র: ইতিহাসবিদ বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

আরও দেখুন
Advertisement
Advertisement
Advertisement

সেরা শিরোনাম

Nimtala Fire: নিমতলা ঘাটের কাছে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভস্মীভূত একাধিক কাঠের গোলা
নিমতলা ঘাটের কাছে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভস্মীভূত একাধিক কাঠের গোলা
Suvendu Adhikari : লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও কেলেঙ্কারি? 'প্রমাণ হাতে নিয়ে' দাবি শুভেন্দুর
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও কেলেঙ্কারি? 'প্রমাণ হাতে নিয়ে' দাবি শুভেন্দুর
Holi 2025 : ২০২৫ এ এই দিনে পড়েছে হোলি, জানলে খুশিতে লাফাবেন আপনিও
২০২৫ এ এই দিনে পড়েছে হোলি, জানলে খুশিতে লাফাবেন আপনিও
WB Tab Scam: ট্যাব কেলেঙ্কারি নিয়ে বিস্ফোরক বাঁকুড়ার TMC সাংসদ অরূপ, 'কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত..'
ট্যাব কেলেঙ্কারি নিয়ে বিস্ফোরক বাঁকুড়ার TMC সাংসদ অরূপ, 'কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত..'
Advertisement
ABP Premium

ভিডিও

Dear Lottery: লটারি-কেলেঙ্কারির তদন্তে ম্য়ারাথন তল্লাশি ইডির। ABP Ananda LiveCM Mamata Banerjee: 'আমরাই ওদের ধরতে পেরেছি', ট্যাব কেলেঙ্কারি নিয়ে মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রীঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন (পর্ব ২, ১৫.১১.২৪): লটারি-কেলেঙ্কারির তদন্তে, ম্যারাথন তল্লাশি ইডিরঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন (পর্ব ১, ১৫.১১.২৪): কসবায় TMC কাউন্সিলরকে গুলি করার চেষ্টা, অল্পের জন্য রক্ষা

ফটো গ্যালারি

ব্যক্তিগত কর্নার

সেরা প্রতিবেদন
সেরা রিল
Nimtala Fire: নিমতলা ঘাটের কাছে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভস্মীভূত একাধিক কাঠের গোলা
নিমতলা ঘাটের কাছে মধ্যরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ভস্মীভূত একাধিক কাঠের গোলা
Suvendu Adhikari : লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও কেলেঙ্কারি? 'প্রমাণ হাতে নিয়ে' দাবি শুভেন্দুর
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও কেলেঙ্কারি? 'প্রমাণ হাতে নিয়ে' দাবি শুভেন্দুর
Holi 2025 : ২০২৫ এ এই দিনে পড়েছে হোলি, জানলে খুশিতে লাফাবেন আপনিও
২০২৫ এ এই দিনে পড়েছে হোলি, জানলে খুশিতে লাফাবেন আপনিও
WB Tab Scam: ট্যাব কেলেঙ্কারি নিয়ে বিস্ফোরক বাঁকুড়ার TMC সাংসদ অরূপ, 'কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত..'
ট্যাব কেলেঙ্কারি নিয়ে বিস্ফোরক বাঁকুড়ার TMC সাংসদ অরূপ, 'কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত..'
Kolkata News: ভর সন্ধেয় কসবার TMC কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে লক্ষ্য করে গুলি! অল্পের জন্য রক্ষা
ভর সন্ধেয় কসবার TMC কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষকে লক্ষ্য করে গুলি! অল্পের জন্য রক্ষা
IPL 2025 Player Auction: ৩৬৬ ভারতীয়, ২০৮ বিদেশি, আইপিএল নিলামে উঠছেন কারা? ক্রিকেটারদের তালিকা প্রকাশ্যে আনল বোর্ড
৩৬৬ ভারতীয়, ২০৮ বিদেশি, আইপিএল নিলামে উঠছেন কারা? ক্রিকেটারদের তালিকা প্রকাশ্যে আনল বোর্ড
Rahul Gandhi: ছাড়পত্র মেলেনি, ঝাড়খণ্ডে ২ ঘণ্টা আটকে রইল রাহুলের বিমান ; প্রধানমন্ত্রীর সভার জন্য দেরি ?
ছাড়পত্র মেলেনি, ঝাড়খণ্ডে ২ ঘণ্টা আটকে রইল রাহুলের বিমান ; প্রধানমন্ত্রীর সভার জন্য দেরি ?
PM Modi : যান্ত্রিক সমস্যা, ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে আটকে প্রধানমন্ত্রীর বিমান !
যান্ত্রিক সমস্যা, ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে আটকে প্রধানমন্ত্রীর বিমান !
Embed widget